রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের নেতা হাবীবুর রহমান রবিনের সঙ্গে পরিবারের অমতে গোপনে বিয়ে করেছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আফসানা ফেরদৌস। পুলিশ তাদের বিয়ের কাবিননামা অর্ধপোড়া অবস্থায় উদ্ধার করেছে বলে একটি সূত্র জানায়। একই সঙ্গে আফসানার মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারজনকে আটক করা হয়েছে। তবে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
নিহত আফসানা মিরপুরের শেওড়াপাড়ার সাইক পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৩ আগস্ট মিরপুরের আল হেলাল হাসপাতাল থেকে বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তার গলায় কালো রঙের একটি গভীর দাগ দেখা যায়।
আফসানা রাজধানীর মানিকদির যে বাসায় ভাড়া থাকতেন ওই বাসার দোতলার বাসিন্দা দেলোয়ারা বেগম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, আফসানা ছিল অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। বাসায় ওঠার সময় সে জানিয়েছিল প্রেম করে বিয়ে করায় মা-বাবা সম্পর্ক মেনে নেয়নি। তাই তারা এখানে থাকছে। একই বাড়ির নিচ তলায় থাকায় নিয়মিত আফসানার বাসায় যেতেন জানিয়ে দেলোয়ারা বেগম বলেন, আফসানা ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত ভালো ছিল। পুলিশ ওই বাসা থেকে অর্ধপোড়া অবস্থায় রবিন-আফসানার বিয়ের কাবিননামাসহ আরও কিছু কাগজপত্র পেয়েছে বলে তিনি জানান।
এদিকে আফসানার সঙ্গে রবিনের গোপনে বিয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তার (আফসানা) মামা হাসানুজ্জামান মিন্টু বলেন, বিষয়টি আমি নিশ্চিত নই। প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছি আফসানা ও রবিন বিয়ে করেছে। মিন্টুর দাবি, আফসানাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার আগে তাকে পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করেছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ এগিয়ে যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন এবং তিনি ওই বক্তব্য রেকর্ড করে রেখেছেন বলেও জানান। মিন্টু আরও বলেন, আফসানা মানিকদির যে বাসায় থাকতেন তার মালিক ও আশপাশের লোকজন জানিয়েছেন,
স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী পরিচয় দেয়া কয়েকজন আফসানাকে হত্যার আগে নির্যাতন করে। এরপর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে।
তবে ওই বাড়ির বাসিন্দা দেলোয়ার বেগম কোনো চিৎকার শোনেননি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, যদি একবার চিৎকার করত তাহলে আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও আফসানাকে বাঁচাতাম। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও আফসানার লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক আবুল খায়ের মো. সফিউজ্জামান বলেন, এটা আত্মহত্যা না হত্যা- এখনই বলতে চাই না। সেটা মন্তব্য করা হয়ে যাবে। তবে শ্বাসরোধেই মৃত্যু হয়েছে তার।
তিনি বলেন, ময়নাতদন্তে বিস্তারিত সবই দেখা হয়। প্রথমে তাকে শনাক্ত করা না যাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে পরিচয় শনাক্ত হওয়ার কারণে আমরা ডিএনএ প্রোফাইলিং করছি। গলায় অর্ধচন্দ্রাকার দাগ থাকার পুলিশি দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, এসব আমি বলতে চাই না। তাকে পাশবিক/শারীরিক নির্যাতন কোনো আলামত পাওয়া যায়নি এবং তিনি অন্তঃসত্ত্বাও ছিলেন না।
আফসানার আরেক মামা ও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক তৌফিক ইলাহী বলেন, এ হত্যাকাণ্ডে রবিন ও তার বন্ধুরা জড়িত। এখনও অপরিচিত মোবাইল থেকে আফসানার আত্মীয়-স্বজনদের সমঝোতার প্রস্তাব ও বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দেয়া হচ্ছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার আগেই এটিকে আত্মহত্যা বলা হচ্ছে।
আফসানার ভাই ফজলে রাব্বী জানান, আফসানা তেজগাঁও এলাকায় থাকার সময় রবিনের সঙ্গে প্রেম হয়। একপর্যায়ে সম্পর্ক ভেঙে গেলে তেজগাঁও ছেড়ে চলে যায় আফসানা। ঘটনার ১০ দিন আগে দু’জনের পরিচিত বন্ধুরা আবার তাদের এক করে দেয়। মৃত্যুর দু’দিন আগে পুনরায় সম্পর্ক ভেঙে দেন আফসানা। এ নিয়ে আফসানাকে দেখে নেয়ারও হুমকি দেয় রবিন। এর দু’দিন পরই তার মৃত্যু হল। রবিনের সঙ্গে আফসানার বিয়ে হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে কাফরুল থানার ওসি সিকদার মোহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। তাদের স্বজনরা কেউ হত্যা মামলা করতে আসেননি। ঘটনাটি হত্যা না আত্মহত্যা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তদন্তে হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে এর সঙ্গে জড়িতদের পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেন ওসি। আফসানার বাসা থেকে কিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। কাবিননামার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ছাত্র ইউনিয়নের সংবাদ সম্মেলন : এদিকে আফসানা হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলন করে। এতে বলা হয়, আফসানা হত্যাকারীদের বিচার চাইলে ছাত্রলীগের সমস্যা কোথায়? ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা আফসানা হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রার্থীদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। তারা খুনিদের রক্ষার চেষ্টা করছে। সংবাদ সম্মেলনে আফসানা হত্যায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা রবিনের গ্রেফতার দাবি করা হয়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, রবিনের পক্ষে যেসব নম্বর থেকে ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে ওইসব নম্বর ব্যবহারকারীদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে।
ছাত্র ইউনিয়ন আফসানার মৃত্যুর ঘটনার সঠিক তদন্ত ও প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে আজ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি, ২২ আগস্ট একই দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি পেশ ও সারা দেশে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের ঘোষণা করে। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকি আক্তার। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সাধারণ সম্পাদক জিলানী শুভ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী, শামীম আহমেদ, তুহিন কান্তি দাস, মো. ফয়েজুল্লাহ, জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী ও কাজী রিতা। – যুগান্তর