প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে বাজেট বাস্তবায়ন এবং রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সহায়তার বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পাবে বিশেষ অগ্রাধিকার। এ খাতে অন্তত ৭ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এছাড়া উভয় দেশ বিভিন্ন বিষয়ে ১৫ চুক্তি ও সমঝোতার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
আগামী ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যাচ্ছেন। দেশে ফিরে আসবেন ১১ জুলাই। পাঁচ বছর পর প্রধানমন্ত্রীর এই সফর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বৈশ্বিকসহ নানা ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চার দিনের এই সফরের সময় বিশ্বের অনেকেরই নজর থাকবে দুই দেশের দুই নেতার ওপর। এই সফর ঘিরে ঢাকা-বেইজিং উভয়পক্ষই বেশ কয়েকটি বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার চীন।
এদিকটি মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে ঢাকার পক্ষ থেকে উন্নয়ন ইস্যুকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কৃষি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, আইসিটি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পাবে।
চীনের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তার বিষয়ে এরই মধ্যে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় চীনের কাছে বাংলাদেশ সহযোগিতা চেয়েছে।
রিজার্ভ সংকট সামাল এবং আমদানি ব্যয় মেটাতে চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ঋণ গ্রহণ করা হবে। রিজার্ভের পাশাপাশি চীন থেকে পণ্য আমদানির ব্যয় মেটাতেও এ অর্থ ব্যবহার করা হবে। তবে ঋণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
রিজার্ভের পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নেও আর্থিক সহায়তার বিষয়টিও প্রাধান্য পাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে খুবই কম সুদে এবং দীর্ঘমেয়াদে ঋণ সুবিধার ওপর জোর দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
এই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। সম্ভাবনার বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের বক্তব্যে।
গত ৪ জুলাই কূটনৈতিক বিটের রিপোর্টারদের সংগঠন ডিকাব আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন। এই কূটনীতিক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে ঋণের বিষয়ে সাফল্য আসতে পারে। রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তার ঘোষণা দিতে পারে চীন। এ সফরে তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ইয়াও ওয়েন বলেন, এ প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে রাজি আছে চীন। যে কোনো সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান করব। এ প্রকল্প নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা। এখনো আমরা বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। এদিকে বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ব্যাংক নগদের সঙ্গে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেন আরও সহজ করতেই এ উদ্যোগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ জুলাই বেইজিং পৌঁছাবেন। ৯ জুলাই তিনি চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠক শেষে চুক্তি ও সমঝোতা সই হবে। আগামী ১০ জুলাই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একইদিন চীনের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস অব চায়নার প্রেসিডেন্ট ঝাও লেজির সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। এছাড়া এ সফরে বাংলাদেশের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাচ্ছেন। তারা সেখানে চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিশেষ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এই খাতে অন্তত ৭ চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এই গ্যাস আনার জন্য পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজন হবে একশ কোটি মার্কিন ডলার। চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি হতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে একযোগে কাজ করছে। তবে রাখাইনে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা উঠতে পারে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই বার্তা দিয়েছে বেইজিং। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আরও গভীর করতে চায় দেশটি।
একই সঙ্গে দুই দেশের উন্নয়ন কৌশলগুলোকে আরও একত্রিত, বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার উচ্চ অগ্রগতি, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে গতি বাড়ানো, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটি নতুন স্তরে উন্নীত করতে চায় বেইজিং।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর হবে আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর হবে গেম চেঞ্জার।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, চীন আমাদের বড় উন্নয়ন অংশীদার। আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় চীন ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতুসহ অনেক আইকনিক স্থাপনায় চীন সহায়তা করেছে। উন্নয়ন অভিযাত্রা যেন বেগবান হয়, সফরে এটাই প্রাধান্য পাবে।