ঢাকা ০২:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতা মানে কী

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৫৩:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪
  • ৩৮ বার

১৯১১-তে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা গোখেলকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইংরেজরা ভারতের অনেক উন্নতি করিয়ে দিলেও ভারতীয়রা স্বাধীনতা চায় কেন। গোখেলের ঝটপট উত্তর ছিল, ভারতীয়রা স্বাধীন হয়ে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অর্থাৎ গোখেলের বিবেচনায় স্বাধীনতা আত্মমর্যাদার সমার্থক ছিল। কবি শামসুর রাহমানের পঙক্তি আছে-‘স্বাধীনতা মানে ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এখানে স্বাধীনতা মানে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে।

খ্যাতকীর্তি মার্কিন ইতিহাসবিদ হানাহ আরেন্ডেটের একটি সাড়া জাগানো প্রবন্ধ আছে, যার শিরোনাম ‘Freedom’। প্রবন্ধটির একটি নজরকাড়া বাক্য হলো, স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব (Freedom means responsibility)। স্বাধীন সত্তায় বিকশিত হওয়া দায়িত্বই তো বটে, বিশেষ করে স্বাধীন জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের জন্য।

স্বাধীনতার তিনটি নির্দেশিত মানে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার মানে এবং তার স্থিতিপত্র তৈরি করা যায়। স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন মানে তা শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্বতা নয়, বা নয় আবেগে উদ্বেলিত হওয়া; স্বাধীনতার উদ্যাপন মানে মনের গহিনে স্বাধীনতার একটি স্থিতিপত্রও তৈরি করা। উল্লেখ্য, বছর বছর এমন স্থিতিপত্র তৈরি করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মানে পরিস্ফুট হবে। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারব স্বাধীনতার মানে অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি কিনা। অবশ্য আমরা কজন তা করি বা কেউ আদৌ তা করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কিন্তু মনে হয় তা করা উচিত। কারণ, তা না হলে স্বাধীনতাকে ঘিরে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণ হয় না।

অবশ্য এমন স্বাধীনতার মানে প্রত্যাশী স্থিতিপত্র তৈরি করতে হলে আমাদের হতে হয় কিংবদন্তির রোমক দেবতা জেনাসের মতো। জানা আছে, জেনাসের দুটো মুখ আর চারটি চোখ ছিল। ফলে সে সামনে-পেছনে উভয় দিকেই দেখতে পেত। অবয়বে আমরা জেনাস হতে পারব না; কিন্তু মানসিকভাবে পারি। মনের চোখ সামনে-পেছনে ছড়িয়ে অতীত-বর্তমানের তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে পারি; এমনকি ভবিষ্যৎও ভেবে নিতে পারি।

তাহলে এবার আসা যাক স্থিতিপত্রের প্রথম খাতের কথায়; যা হলো আত্মমর্যাদা। বহুশ্রুত কবির পঙ্ক্তি আছে ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় বল’। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচা মানে মর্যাদাহীন বাঁচা। ব্যক্তিগতভাবেই হোক আর সমষ্টিগতভাবেই হোক, স্বাধীন সত্তা তাই পরম কাঙ্ক্ষিত। উভয় পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রত্যাশার রূপায়ণ প্রক্রিয়াকে বলে আত্মঅধিকার (self-determination) প্রতিষ্ঠা। ’৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে যখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালিকে ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’, তখন তাতে বাঙালির আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তা নিহিত ছিল। আর আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল সাবাস বাংলা দেশ,

এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,

জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার,

তবুও মাথা নোয়াবার নয়।

আমরা মাথা নোয়াইনি; শত্রুহননের সাফল্যে মাথা তুলে মেরুদণ্ড সোজা করে স্বাধীনতাকে নির্বিঘ্ন করে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিয়েছি। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে কবি সুকান্ত বাঙালির চিরদ্রোহী সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের দ্রোহী সত্তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, তা বলার জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, বাঙালির দ্রোহী সত্তা ভাষিক জাতীয়তাবাদের পাটাতনে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে এক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নির্মাণ করেছে। এ রাষ্ট্রই বাঙালির আত্মমর্যাদার সূচক। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন। স্বাধীনতার সংরক্ষণ আমাদের কৃতিত্ব।

বিগত সাড়ে চার দশকে এ অর্জন ও কৃতিত্বে কি কোনো সংযোজন হয়েছে? একাধিক সূচকের ভিত্তিতে আমাদের নির্দ্বিধ উচ্চারণ হতে পারে যে, আমাদের সংযোজন অনেক। বাহাত্তরের ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে থাকা দেশের নাম। আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে, আছে বিচ্যুতিও। তবুও বাংলাদেশ এখন নানা কারণে তৃতীয় দুনিয়ার এক মডেল দেশ।

কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার অনেক মানে তুলে ধরা হয়েছে। তবে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে যে মানে আছে, তা অর্থনৈতিক মুক্তির। স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে একাধিকবার; স্বাধীনতার প্রসঙ্গ মাত্র একবার। তবে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে মুক্তির সোপান রচিত হয়। আর বঙ্গবন্ধু সার্বিক মুক্তির নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা অর্জিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। সেই কারণে বলা চলে, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর; আর মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে ’৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর থেকে, যা আজও চলমান। মুক্তির এ যুদ্ধ অনিঃশেষ, চলে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। অবশ্য চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন কোনো দেশে বা ব্যবস্থায় সম্ভব হয়নি; কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল থাকাটাই আসল কথা। মুক্তির লক্ষ্যহীন স্বাধীনতা অন্য কথায় স্বাধীনতার প্রহসন বৈ আর কিছু নয়। সুতরাং, বাংলাদেশে সার্বিক মুক্তির যে যুদ্ধ চলমান, তা অব্যাহত থাকবে যতদিন না লক্ষ্য অর্জিত হয়। এ যুদ্ধে আজ পর্যন্ত আমাদের সাফল্য আছে, আছে ব্যর্থতাও। অবশ্য ব্যর্থতার অর্থ হলো, আমরা যা অর্জন করতে পারিনি; কিন্তু যা অর্জন করা উচিত ছিল বা যা অর্জন করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

আর্থসামাজিক অঙ্গনে যে সাফল্যগুলো আমাদের শ্লাঘা ও বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ, তার সূচনা হয়েছিল চরম প্রতিকূল পরিবেশে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে একজন ড. হেনরি কিসিঞ্জারের তির্যক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বাংলাদেশ হবে তলাহীন ঝুড়ি। ড. কিসিঞ্জার কাগুজে কূটনীতিক হিসাবে খ্যাতকীর্তি ছিলেন; কিন্তু বাস্তবে নয়। কারণ বাংলাদেশের অভ্যুদয় রুখে দেওয়ার বাস্তব কূটনীতিতে তিনি ব্যর্থ ছিলেন। আর যা হোক, তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন না। তার প্রমাণ আর্থসামাজিক খাতে শনৈ শনৈ এগিয়ে চলা আজকের বাংলাদেশ। অনস্বীকার্য, শুরুতে বাংলাদেশ তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছিল; কিন্তু আজ বাংলাদেশ নামের ঝুড়িটির শক্ত তলা হয়েছে। উপরন্তু, ঝুড়িটি কানায় কানায় পূর্ণ না হলেও, তা করার আয়োজন-উদ্যোগের কমতি নেই; এবং যা পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল বিশ্বব্যাংকেরও নজর কেড়েছে।

অবশ্য উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে চিরদিন রেখে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভাব ছিল না বা এখনো নেই। কিন্তু তবু বাংলাদেশ তার স্বীয়তানির্ভর (autonomy-based) অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। স্মর্তব্য, স্বাধীনতার পর ষড়যন্ত্রের কারণে বিগত শতকের ষাট-সত্তর দশকে আফ্রিকীয় সমাজতন্ত্র (African Socialism) ব্যর্থ হয়েছিল। আফ্রিকার নিজস্ব ধাঁচের এ সমাজতন্ত্র টিকে থাকলে আফ্রিকার দেশগুলো আজ অনেক এগিয়ে যেতে পারত; কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আজ বাংলাদেশ অন্তত আর্থসামাজিক মানদণ্ডে ঘুরে দাঁড়ানো এক বিস্ময়কর দেশ; এবং অনেক ক্ষেত্রে দেশটি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।

অবশ্য আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধি ও প্রগতির মানে এ নয়, আমরা মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করেছি। আমাদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মধ্যে এখনো বিরাজমান দুস্তুর ব্যবধান। আপাতদৃষ্টিতে ধনীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান; আর সেই কারণে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানও ক্রমবর্ধমান, যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ। রয়েছে সামাজিক অপরাধ-সূচকের ঊর্ধ্বগতি। উপরন্তু আছে শহর আর গ্রামের বৈষম্য। আছে কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও বেকার সমস্যা। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার একটি জায়গায় বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষ যদি খেতে না পায়, বেকার যুবক যদি চাকরি না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’ দেশের মানুষ এখন খেতে পায়; কারণ বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ নয়। গণদারিদ্র্যের হারও কমেছে। কিন্তু বেকারত্ব সমস্যার আশানুরূপ সমাধান এখনো হয়নি। উদ্যোগ আছে, সময়ের ব্যবধানে সাফল্য অনিবার্য।

এবার স্বাধীনতার মানে নিয়ে সবশেষ প্রসঙ্গে আশা যাক। স্বাধীনতার প্রতি আমরা কতটুকু দায়িত্বশীল ছিলাম বা আছি? এতদিনের যা অর্জন, তাতে নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত আমাদের দায়িত্বশীলতা। অন্যদিকে যা কিছু অর্জন করতে পারিনি, তা আমাদের দায়িত্বহীনতার প্রতীক। অবশ্য দায়িত্বহীনতা প্রসঙ্গে পরিস্থিতির প্রতিকূলতা একটি বিবেচ্য অনুষঙ্গ। ধরা যাক গণতন্ত্রের কথা। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আট হাজার আটশত তিরাশি দিনে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আর এ কারণে গণতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের কাঠামোগত অঙ্গীকার (structural commitment) নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারের প্রতীক। কিন্তু তারপর গণতন্ত্র যেন মরু পথে হারানো নদীর ধারার মতো হয়ে গেল; যা অকল্পনীয় ছিল বা যা ছিল পাকিস্তানি ঐতিহ্য, সেই সামরিক শাসন এবং প্রকারান্তরে সামরিক শাসন বাংলাদেশের ওপর চেপে বসল, থাকল একানব্বই পর্যন্ত। প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক স্বৈরাচার পিছু হটেছিল; গণতন্ত্র মুক্তির দরজাও উন্মুক্ত করল; কিন্তু এখন পেছন ফিরে দেখে যদি প্রশ্ন করি, গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কি? উত্তরটি মিশ্র হতে বাধ্য। কারণ আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়েছি, কিন্তু গন্তব্য এখনো বহুদূর। জানা কথা, গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার; গণতন্ত্র স্বল্প সময়ে বা রাতারাতি হয় না। কোথাও তা হয়নি। সুতরাং, গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমাদের ভূমিকা আংশিক। ভূমিকার সম্পূর্ণতার লক্ষ্যে উদ্যোগ অব্যাহত আছে। সুতরাং, আছে আশাবাদও। তবে যতদিন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক না বলে গণতন্ত্রায়নের রাষ্ট্র বলা যৌক্তিক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

স্বাধীনতা মানে কী

আপডেট টাইম : ১০:৫৩:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪

১৯১১-তে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা গোখেলকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইংরেজরা ভারতের অনেক উন্নতি করিয়ে দিলেও ভারতীয়রা স্বাধীনতা চায় কেন। গোখেলের ঝটপট উত্তর ছিল, ভারতীয়রা স্বাধীন হয়ে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অর্থাৎ গোখেলের বিবেচনায় স্বাধীনতা আত্মমর্যাদার সমার্থক ছিল। কবি শামসুর রাহমানের পঙক্তি আছে-‘স্বাধীনতা মানে ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এখানে স্বাধীনতা মানে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে।

খ্যাতকীর্তি মার্কিন ইতিহাসবিদ হানাহ আরেন্ডেটের একটি সাড়া জাগানো প্রবন্ধ আছে, যার শিরোনাম ‘Freedom’। প্রবন্ধটির একটি নজরকাড়া বাক্য হলো, স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব (Freedom means responsibility)। স্বাধীন সত্তায় বিকশিত হওয়া দায়িত্বই তো বটে, বিশেষ করে স্বাধীন জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের জন্য।

স্বাধীনতার তিনটি নির্দেশিত মানে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার মানে এবং তার স্থিতিপত্র তৈরি করা যায়। স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন মানে তা শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্বতা নয়, বা নয় আবেগে উদ্বেলিত হওয়া; স্বাধীনতার উদ্যাপন মানে মনের গহিনে স্বাধীনতার একটি স্থিতিপত্রও তৈরি করা। উল্লেখ্য, বছর বছর এমন স্থিতিপত্র তৈরি করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মানে পরিস্ফুট হবে। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারব স্বাধীনতার মানে অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি কিনা। অবশ্য আমরা কজন তা করি বা কেউ আদৌ তা করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কিন্তু মনে হয় তা করা উচিত। কারণ, তা না হলে স্বাধীনতাকে ঘিরে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণ হয় না।

অবশ্য এমন স্বাধীনতার মানে প্রত্যাশী স্থিতিপত্র তৈরি করতে হলে আমাদের হতে হয় কিংবদন্তির রোমক দেবতা জেনাসের মতো। জানা আছে, জেনাসের দুটো মুখ আর চারটি চোখ ছিল। ফলে সে সামনে-পেছনে উভয় দিকেই দেখতে পেত। অবয়বে আমরা জেনাস হতে পারব না; কিন্তু মানসিকভাবে পারি। মনের চোখ সামনে-পেছনে ছড়িয়ে অতীত-বর্তমানের তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে পারি; এমনকি ভবিষ্যৎও ভেবে নিতে পারি।

তাহলে এবার আসা যাক স্থিতিপত্রের প্রথম খাতের কথায়; যা হলো আত্মমর্যাদা। বহুশ্রুত কবির পঙ্ক্তি আছে ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় বল’। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচা মানে মর্যাদাহীন বাঁচা। ব্যক্তিগতভাবেই হোক আর সমষ্টিগতভাবেই হোক, স্বাধীন সত্তা তাই পরম কাঙ্ক্ষিত। উভয় পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রত্যাশার রূপায়ণ প্রক্রিয়াকে বলে আত্মঅধিকার (self-determination) প্রতিষ্ঠা। ’৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে যখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালিকে ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’, তখন তাতে বাঙালির আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তা নিহিত ছিল। আর আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল সাবাস বাংলা দেশ,

এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,

জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার,

তবুও মাথা নোয়াবার নয়।

আমরা মাথা নোয়াইনি; শত্রুহননের সাফল্যে মাথা তুলে মেরুদণ্ড সোজা করে স্বাধীনতাকে নির্বিঘ্ন করে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিয়েছি। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে কবি সুকান্ত বাঙালির চিরদ্রোহী সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের দ্রোহী সত্তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, তা বলার জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, বাঙালির দ্রোহী সত্তা ভাষিক জাতীয়তাবাদের পাটাতনে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে এক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নির্মাণ করেছে। এ রাষ্ট্রই বাঙালির আত্মমর্যাদার সূচক। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন। স্বাধীনতার সংরক্ষণ আমাদের কৃতিত্ব।

বিগত সাড়ে চার দশকে এ অর্জন ও কৃতিত্বে কি কোনো সংযোজন হয়েছে? একাধিক সূচকের ভিত্তিতে আমাদের নির্দ্বিধ উচ্চারণ হতে পারে যে, আমাদের সংযোজন অনেক। বাহাত্তরের ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে থাকা দেশের নাম। আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে, আছে বিচ্যুতিও। তবুও বাংলাদেশ এখন নানা কারণে তৃতীয় দুনিয়ার এক মডেল দেশ।

কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার অনেক মানে তুলে ধরা হয়েছে। তবে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে যে মানে আছে, তা অর্থনৈতিক মুক্তির। স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে একাধিকবার; স্বাধীনতার প্রসঙ্গ মাত্র একবার। তবে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে মুক্তির সোপান রচিত হয়। আর বঙ্গবন্ধু সার্বিক মুক্তির নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা অর্জিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। সেই কারণে বলা চলে, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর; আর মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে ’৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর থেকে, যা আজও চলমান। মুক্তির এ যুদ্ধ অনিঃশেষ, চলে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। অবশ্য চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন কোনো দেশে বা ব্যবস্থায় সম্ভব হয়নি; কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল থাকাটাই আসল কথা। মুক্তির লক্ষ্যহীন স্বাধীনতা অন্য কথায় স্বাধীনতার প্রহসন বৈ আর কিছু নয়। সুতরাং, বাংলাদেশে সার্বিক মুক্তির যে যুদ্ধ চলমান, তা অব্যাহত থাকবে যতদিন না লক্ষ্য অর্জিত হয়। এ যুদ্ধে আজ পর্যন্ত আমাদের সাফল্য আছে, আছে ব্যর্থতাও। অবশ্য ব্যর্থতার অর্থ হলো, আমরা যা অর্জন করতে পারিনি; কিন্তু যা অর্জন করা উচিত ছিল বা যা অর্জন করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

আর্থসামাজিক অঙ্গনে যে সাফল্যগুলো আমাদের শ্লাঘা ও বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ, তার সূচনা হয়েছিল চরম প্রতিকূল পরিবেশে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে একজন ড. হেনরি কিসিঞ্জারের তির্যক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বাংলাদেশ হবে তলাহীন ঝুড়ি। ড. কিসিঞ্জার কাগুজে কূটনীতিক হিসাবে খ্যাতকীর্তি ছিলেন; কিন্তু বাস্তবে নয়। কারণ বাংলাদেশের অভ্যুদয় রুখে দেওয়ার বাস্তব কূটনীতিতে তিনি ব্যর্থ ছিলেন। আর যা হোক, তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন না। তার প্রমাণ আর্থসামাজিক খাতে শনৈ শনৈ এগিয়ে চলা আজকের বাংলাদেশ। অনস্বীকার্য, শুরুতে বাংলাদেশ তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছিল; কিন্তু আজ বাংলাদেশ নামের ঝুড়িটির শক্ত তলা হয়েছে। উপরন্তু, ঝুড়িটি কানায় কানায় পূর্ণ না হলেও, তা করার আয়োজন-উদ্যোগের কমতি নেই; এবং যা পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল বিশ্বব্যাংকেরও নজর কেড়েছে।

অবশ্য উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে চিরদিন রেখে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভাব ছিল না বা এখনো নেই। কিন্তু তবু বাংলাদেশ তার স্বীয়তানির্ভর (autonomy-based) অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। স্মর্তব্য, স্বাধীনতার পর ষড়যন্ত্রের কারণে বিগত শতকের ষাট-সত্তর দশকে আফ্রিকীয় সমাজতন্ত্র (African Socialism) ব্যর্থ হয়েছিল। আফ্রিকার নিজস্ব ধাঁচের এ সমাজতন্ত্র টিকে থাকলে আফ্রিকার দেশগুলো আজ অনেক এগিয়ে যেতে পারত; কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আজ বাংলাদেশ অন্তত আর্থসামাজিক মানদণ্ডে ঘুরে দাঁড়ানো এক বিস্ময়কর দেশ; এবং অনেক ক্ষেত্রে দেশটি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।

অবশ্য আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধি ও প্রগতির মানে এ নয়, আমরা মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করেছি। আমাদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মধ্যে এখনো বিরাজমান দুস্তুর ব্যবধান। আপাতদৃষ্টিতে ধনীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান; আর সেই কারণে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানও ক্রমবর্ধমান, যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ। রয়েছে সামাজিক অপরাধ-সূচকের ঊর্ধ্বগতি। উপরন্তু আছে শহর আর গ্রামের বৈষম্য। আছে কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও বেকার সমস্যা। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার একটি জায়গায় বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষ যদি খেতে না পায়, বেকার যুবক যদি চাকরি না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’ দেশের মানুষ এখন খেতে পায়; কারণ বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ নয়। গণদারিদ্র্যের হারও কমেছে। কিন্তু বেকারত্ব সমস্যার আশানুরূপ সমাধান এখনো হয়নি। উদ্যোগ আছে, সময়ের ব্যবধানে সাফল্য অনিবার্য।

এবার স্বাধীনতার মানে নিয়ে সবশেষ প্রসঙ্গে আশা যাক। স্বাধীনতার প্রতি আমরা কতটুকু দায়িত্বশীল ছিলাম বা আছি? এতদিনের যা অর্জন, তাতে নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত আমাদের দায়িত্বশীলতা। অন্যদিকে যা কিছু অর্জন করতে পারিনি, তা আমাদের দায়িত্বহীনতার প্রতীক। অবশ্য দায়িত্বহীনতা প্রসঙ্গে পরিস্থিতির প্রতিকূলতা একটি বিবেচ্য অনুষঙ্গ। ধরা যাক গণতন্ত্রের কথা। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আট হাজার আটশত তিরাশি দিনে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আর এ কারণে গণতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের কাঠামোগত অঙ্গীকার (structural commitment) নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারের প্রতীক। কিন্তু তারপর গণতন্ত্র যেন মরু পথে হারানো নদীর ধারার মতো হয়ে গেল; যা অকল্পনীয় ছিল বা যা ছিল পাকিস্তানি ঐতিহ্য, সেই সামরিক শাসন এবং প্রকারান্তরে সামরিক শাসন বাংলাদেশের ওপর চেপে বসল, থাকল একানব্বই পর্যন্ত। প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক স্বৈরাচার পিছু হটেছিল; গণতন্ত্র মুক্তির দরজাও উন্মুক্ত করল; কিন্তু এখন পেছন ফিরে দেখে যদি প্রশ্ন করি, গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কি? উত্তরটি মিশ্র হতে বাধ্য। কারণ আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়েছি, কিন্তু গন্তব্য এখনো বহুদূর। জানা কথা, গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার; গণতন্ত্র স্বল্প সময়ে বা রাতারাতি হয় না। কোথাও তা হয়নি। সুতরাং, গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমাদের ভূমিকা আংশিক। ভূমিকার সম্পূর্ণতার লক্ষ্যে উদ্যোগ অব্যাহত আছে। সুতরাং, আছে আশাবাদও। তবে যতদিন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক না বলে গণতন্ত্রায়নের রাষ্ট্র বলা যৌক্তিক।