রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলোর মধ্যে একটি হলো তারাবির নামাজ আদায় করা।
এশার নামাজের পর জামাতে এই নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে। মুসল্লিরা আগ্রহ-উৎসাহের সঙ্গে এই নামাজে অংশগ্রহণ করেন। কুরআনের পাখি হাফেজে কুরআনের সুমধুর কন্ঠের তেলাওয়াতে বিভোর হয়ে থাকেন অনেকটা সময়।
আকন্ঠ মুগ্ধতায় দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। এ যেন কুরআনপ্রেমীদের এক মিলনমেলা। যেখানে যুবক, বৃদ্ধ -বালক, ধনী গরীব সবাই অংশ নেয়।
তারাবির নামাজ আদায় করা রমজানের সুন্নাত। হাদিস শরীফে তারাবি নামাজের অনেক ফজিলতের কথা উল্লেখ হয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়বে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৬)
সর্বপ্রথম যিনি এই নামাজ চালু করেছেন তিনি হলেন রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিষয়টি একাধিক হাদিসে বিবৃত হয়েছে।
হাদিস শরিফে আছে, আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রমজানের এক রাতে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। কিছুসংখ্যক সাহাবী তার পেছনে ইক্তিদা করেছেন। দ্বিতীয় রাতেও তিনি নামাজ পড়েছেন। এ রাতে প্রচুর মুসল্লি হয়েছে। এরপর তৃতীয় বা (রাবী বলেছেন) চতুর্থ রাতে সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে জড়ো হয়েছেন; কিন্তু ওই রাতে তিনি কামরা থেকে বের হননি।
সকাল হলে তিনি সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা যে এসেছো তা আমি দেখেছি। তবে, আমি তোমাদের কাছে আসিনি এ আশঙ্কায় যে, না জানি এই নামাজ তোমাদের ওপর ফরজ করে দেওয়া হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৭৬১)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবির নামাজ প্রথম পড়েছেন। এরপরও বলা হয়, উমর (রা.) তারাবির নামাজ চালু করেছেন। এর কারণ হল, তিনিই সর্বপ্রথম উবাই ইবনে কা‘বের (রা.) পেছনে জামাতের ব্যবস্থা করেছেন। তার নির্দেশে উবাই ইবনে কা‘ব (রা.) লোকদের নিয়ে তারাবির জামাত শুরু করেছেন।
আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কারী (রহ.) বলেন, রমজানের এক রাতে উমরের (রা.) সঙ্গে বের হলাম। দেখি, লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট জামাত করে নামাজ পড়ছে। কেউ একা একা পড়ছে আর কেউ ইমামতি করছে, কিছু লোক তার ইক্তিদা করছে।
উমর (রা.) বললেন, মনে হচ্ছে, সবাইকে যদি এক ইমামের পিছনে জমা করিয়ে দিই তাহলে ভালো হবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন এবং সবাইকে উবাই ইবনে কা‘বের (রা.) পেছনে দাঁড় করিয়ে দেন। আরেক রাতে তার সঙ্গে বের হলাম।
লোকজন উবাই ইবনে কা‘বের (রা.) পেছনে জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ছেন। উমর (রা.) তখন বললেন, এটা উত্তম বিদআত। সাহাবায়ে কেরাম রাতের প্রথমাংশে (তারাবির) নামাজ পড়তেন। উমর (রা.) বললেন, এই নামাজ থেকে ওই নামাজ উত্তম, যার সময় তারা ঘুমিয়ে থাকে। অর্থাৎ শেষ রাতের নামাজ। (সহিহ বুখারি, হাদিস ২০১০, আলমুগনী, ইবনে কুদামা ২/১৬৬)
খতম তারাবির নামাজ পড়িয়ে বিনিময় নেওয়া যাবে কি না? এ বিষয় নিয়ে নানা মন্তব্য দেখা যায়। গ্রহণযোগ্য মত হলো, খতম তারাবি পড়িয়ে কোনো প্রকার বিনিময় নেওয়া বৈধ নয়। হাদিয়ার নামে দিলেও জায়েজ হবে না। এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতন হিসাবে দিলেও জায়েজ নয়।
এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম যে মতামত ও দলিল পেশ করে থাকেন তা হলো , ইবাদত বন্দেগী হিসাবে আমরা যা পালন করে থাকি, সাধারণত তা তিন প্রকার
(ক) মাকাসিদ তথা খালেস ও মূল ইবাদাত: যেমন নামাজ, রোজা, হজ, সাওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও দোয়া দুরূদ ইত্যাদি
(খ) ওয়াসাইল তথা সহায়ক ইবাদাত:- যেমন ইমামত, ইকামত, দীনী শিক্ষাদান ও ওয়াজ নসীহত ইত্যাদি।
(গ) রুকইয়াত তথা বালা-মুসীবত থেকে পরিত্রাণ, রোগ মুক্তি, ব্যবসায় উন্নতি এ জাতীয় দুনিয়াবি কোন উদ্দেশ্যে বৈধ দোয়া, খতম, ঝাড় ফুঁক, তাবিজ-কবয ইত্যাদি।
প্রথম প্রকার তথা মাকাসিদ জাতীয় ইবাদত করে বিনিময় নেয়া-দেওয়া সম্পূর্ণ ও সর্বসম্মতভাবে হারাম। এ ব্যাপারে কোন কালেও কোন মাযহাবের কোন নির্ভরযোগ্য আলেম ফক্বীহ দ্বিমত পোষণ করেননি।
পক্ষান্তরে তৃতীয় প্রকার আমলের বিনিময় গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হালাল। শুরু থেকে অদ্যাবধি এ ব্যাপারে কোন মাজহাবের নির্ভরযোগ্য কোন মুজতাহিদ ফক্বীহ দ্বিমত পোষণ করেননি। (রদ্দুল মুহতার ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৫৫,৫৮ পৃষ্ঠা, আল মুদওয়ানাতুল কুবরা ৩য় খন্ডঃ ৪৩১ পৃষ্ঠা, ফাতওয়া রশীদিয়া-৪১৭পৃষ্ঠা)
আর দ্বিতীয় প্রকার তথা আজান, ইমামত, কুরআন- হাদিস তথা দীনী তা’লীম এ জাতীয় পর্যায়ের ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ ও প্রদান অন্যান্য মাজহাবে জায়েজ থাকলেও হানাফি মাজহাবের পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামের মতে নাজায়েজ।
কিন্তু উলামায়ে মুতাআখখিরীন (পরবর্তী যুগের আলেমরা) শরীআতের বিশেষ উসূল তথা মূলনীতির ভিত্তিতে বিশেষ কতক ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ ও প্রদানকে বৈধ বলেছেন।
সে উসূল হলো এ শ্রেণীর যে সব ইবাদত ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং শি’আরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত অথবা দীনের স্থায়িত্ব তার উপর নির্ভরশীল বিধায় বিনিময়ের আদান-প্রদান বৈধ না হলে এ যুগে এসব ইবাদত কায়েম রাখা সম্ভব হবে না, তাই দীনের স্থায়িত্বের প্রয়োজনেই তা জাযেজ।
ফিক্বাহবিদরা সে সব ইবাদতকে চিহ্নিতও করেছেন আর তা হলো: ফরজ ওয়াজিব নামাজের ইমামতি, আজান-ইকামত, দীনি শিক্ষাদান ইত্যাদি। (সূত্র: রদ্দুল মুহতার-৬ষ্ঠ খন্ডঃ ৬৯০, ৬৯১ পৃষ্ঠা। ইমদাদুল ফাতাওয়া ১ম খণ্ড ৪৭৬ পৃষ্ঠা ইমাদদুল মুফতীন ৩১৩ পৃষ্ঠা, ইমদাদুল আহকাম-৩য় খণ্ড ৫২৭ পৃষ্ঠা)
পক্ষান্তরে এ দ্বিতীয় প্রকারের যে সব ইবাদাত ফরজ-ওয়াজিব নয় এবং শি’আরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত নয়, দীনের স্থায়িত্বও তার উপর নির্ভরশীল নয় যেমন: তারাবিহ এবং সওয়াব রেসানীর উদ্দেশ্যে কুরআন খতম করা। এ সব ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ ও বিনিময় প্রদানকে কোন আলেম জায়েজ বলেননি বরং নির্ভরযোগ্য সব ফিক্বাহবিদ লেনদেনকে হারাম বলেছেন।
(ফাতওয়া রশীদিয়া ৩২৪, ইমদাদুল ফাতাওয়া ১ম খণ্ড ৪৮৪ পৃষ্ঠা, ইমদাদুল মুফতীন ৩১৫, ইমদাদুল আহকাম ৩য় খণ্ড ৫১৭, আহসানুল ফাতওয়া ৩য় খণ্ড ৫১৪, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৮ম খণ্ড ২৪৭, ফাতওয়া দারুল উলুম ৪র্থ খণ্ড ২৭৩)
এছাড়াও হাদিস শরীফে কুরআন তেলাওয়াত করে বিনিময় নেওয়ার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি এসেছে, হজরত আবদুর রহমান ইবনে শিবল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন তিলাওয়াত করো, তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না এবং তার প্রতি বিরূপ হয়ও না। কুরআনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং তা দিয়ে সম্পদ কামনা করো না।’ (মুসনাদে আহমদ: ৩ / ৪২৮)
তবে যদি চাঁদা না তোলা হয়। বরং কেউ ব্যক্তিগতভাবে কুরআনের পাখিদেরকে ভালোবেসে নিজ উদ্যোগে হাদিয়া পেশ করেন তাহলে শরিআতে তার অনুমতি আছে এবং এটা আলেম-উলামা ও তালেবে ইলমদের খেদমতের অন্তর্ভুক্ত, যার প্রতি আল্লাহ তা’আলা কুরআনে কারীমের সূরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াতে উৎসাহিত করেছেন।
আলেম-ওলামা ও তালেবে ইলমদের খেদমত করাকে সৌভাগ্য মনে করে ব্যক্তিগতভাবে হাফেজে কুরআনদেরকে হাদিয়া প্রদান করা আল্লাহর কাছে অতি উত্তম কাজ বলেই বিবেচিত।
অর্থাৎ বর্তমানের আমাদের সমাজে যেভাবে চাঁদার মাধ্যমে টাকা তুলে তারাবির হাফেজদের দেওয়া হয়- এ পদ্ধতিটি শরিয়তসম্মত নয়। এখানে নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে একদিকে যেমন পারিশ্রমিক হয়ে যায় অন্যদিকে চাঁদার কারণে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেকের টাকা নেওয়া হয়।
এর বিপরীতে উত্তম পদ্ধতি হলো- ব্যক্তিগতভাবে মুসল্লিরা নিজের সামর্থ অনুযায়ী হাফেজদের হাদিয়া দেবেন। এটির নির্ধারিত সীমারেখা নেই। কেউ চাইলে তার সব সম্পত্তিও হাফেজদের দিয়ে দিতে পারেন। তারাবির হাফেজদের এভাবেই সম্মানিত করা অধিক সুন্দর ও উত্তম পদ্ধতি।