ইস্তিখারা করার বিধান
বৈধ কাজে ইস্তিখারা করা সুন্নত বা মুস্তাহাব। কেননা নবীজি (সা.) নিজে ইস্তিখারা করতেন এবং অন্যকে ইস্তিখারা করতে উৎসাহিত করতেন।
আল্লামা ইবনু বাত্তাল (রহ.) বলেন, মুমিনের উচিত সূক্ষ্ম ও স্থূল সব বিষয়ে ইস্তিখারা করার পর অগ্রসর হওয়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করা, যেন তিনি কল্যাণের পথে অগ্রসর করেন এবং তাকে অকল্যাণ থেকে রক্ষা করেন। হাদিসের বর্ণনা মতে, নবীজি (সা.) কোরআনের মতো ইস্তিখারার দোয়া শিখিয়েছেন, যা দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইস্তিখারা মুসলমানের জন্য তেমনি সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ, যেমন প্রতি নামাজে কোরআন তিলাওয়াত গুরুত্বপূর্ণ।
কোন কোন বিষয়ে ইস্তিখারা করবে
এমন বৈধ কাজ, যা করা ও না করার ব্যাপারে শরিয়তের কোনো নির্দেশনা থাকে না। অর্থাৎ ফরজ, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব বিষয় কোনো প্রকার চিন্তা-ভাবনা ছাড়া ব্যক্তি সম্পন্ন করবে এবং হারাম ও মাকরুহ কাজ কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়া ত্যাগ করবে। বিপরীতে এমন কাজের ব্যাপারে ইস্তিখারা করবে, যার ব্যাপারে শরিয়তের কোনো নির্দেশনা নেই।
জাবের বিন আবদুল্লাহ আল-সুলামি (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে নবীজি (সা.) ইস্তিখারা করার নিয়ম বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের সব বিষয়ে ইস্তিখারা করার শিক্ষা দিতেন; যেভাবে তিনি তাদের কোরআনের সুরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজের উদ্যোগ নেয়, তখন সে যেন দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে। অতঃপর বলে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আস্তাখিরুকা বি ইলমিকা ওয়া আস্তাকদিরুকা বি কুদরাতিকা ওয়া আসআলুকা মিন ফাদলিকাল আযিম, ফা ইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু, ওয়া তা‘লামু ওয়ালা আ‘লামু ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ুব। আল্লাহুম্মা ইনকুন্তা তা‘লামু আন্না হাজাল
আমরা (এখানে নিজের কাজের কথা মনে মনে উল্লেখ করবে) খাইরুন লি ফি দ্বিনি ওয়া মা‘আশি ওয়া আক্বিবাতি আমরি (অথবা বলবে : আ জিলি আমরি ওয়া আজিলিহি) ফাকদিরহু লি, ওয়া ইয়াসসিরহু লি, সুম্মা বা রিকলি ফিহি, ওয়া ইন কুন্তা তা‘লামু আন্না হাজাল আমরা (এখানে নিজের কাজের কথা মনে মনে উল্লেখ করবে) শাররুন লি ফি দ্বিনি ওয়া মা‘আশি ওয়া আক্বিবাতি আমরি (অথবা বলবে : আ জিলি আমরি ওয়া আজিলিহি) ফাসরিফহু আন্নি ওয়াসরিফনি আনহু ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাইসু কানা সুম্মা আরদিনি বিহি’ (এরপর নিজের কাজের কথা উল্লেখ করে দোয়া করবে)।
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার জ্ঞানের সাহায্যে আপনার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আমি আপনার শক্তির সাহায্যে শক্তি ও আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। কেননা আপনিই ক্ষমতাবান; আমি ক্ষমতা রাখি না। আপনি জ্ঞান রাখেন, আমার জ্ঞান নেই এবং আপনি অদৃশ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত।
হে আল্লাহ! আপনার জ্ঞানে আমার এ কাজ (এখানে নিজের প্রয়োজনের নাম উল্লেখ করবে অথবা মনে মনে স্মরণ করবে) আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য (কিংবা বলবে আমার দ্বিনদারি, জীবন-জীবিকা ও কর্মের পরিণামে) কল্যাণকর হলে আপনি তা আমার জন্য নির্ধারণ করে দিন। সেটা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তাতে বরকত দিন। হে আল্লাহ! আর যদি আপনার জ্ঞানে আমার এ কাজ আমার দ্বিনদারি, জীবন-জীবিকা ও কর্মের পরিণামে (কিংবা বলবে, আমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য) অকল্যাণকর হয়, তাহলে আপনি আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে দিন এবং সেটাকেও আমার থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আমার জন্য সর্বক্ষেত্রে কল্যাণ নির্ধারণ করে রাখুন এবং আমাকে সেটার প্রতি সন্তুষ্ট করে দিন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৮৪১)
ইস্তিখারার সুফল পেতে করণীয়
প্রাজ্ঞ আলেমরা ইস্তিখারার সুফল পেতে তিনটি বিশেষ আমলের কথা বলেন—
১. অন্তরকে শূন্য করা : ইস্তিখারার সুফল পেতে ব্যক্তি অন্তর থেকে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও যুক্তি দূর করবে এবং পুরোপুরি নিজেকে আল্লাহর হাতে সমর্পণ করবে। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ইস্তিখারাকারী ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হলো নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ মাথা থেকে ঝেরে ফেলা নতুবা সে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনাকারী বলে গণ্য হবে না, বরং নিজের প্রবৃত্তিকে প্রাধান্যকারী হবে। কল্যাণ কামনার ক্ষেত্রে তার দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হবে। (নাইলুল আওতার : ৩/৯০)
২. নিষ্ঠার সঙ্গে দোয়া করা : ইস্তিখারার অর্থ কল্যাণ কামনা করা। মুমিন কোনো বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হলে বা কল্যাণের পথে চলতে চাইলে আল্লাহর কাছে নির্দেশনা কামনা করবে। এ ক্ষেত্রে যে যত বেশি নিষ্ঠার সঙ্গে দোয়া করবে আল্লাহ তাকে ততটা সুপথ দান করবেন।
৩. পরে সন্তুষ্ট থাকা : ইস্তিখারার পর অন্তরে যে নির্দেশনা লাভ করবে, মুমিন তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, দুটি জিনিস ইস্তিখারাকে ফলপ্রসূ করে। পূর্বে নিষ্ঠার সঙ্গে কল্যাণ কামনা করা এবং পরে তাতে সন্তুষ্ট থাকা। আর ত্রুটি হলো কাজ করার আগে ইস্তিখারা না করা এবং পরে তাতে সন্তুষ্ট না থাকা। (সহিহ ফিকহুস সুন্নাহ ওয়া আদিল্লাতুহু : ১/৪২৭)
ইস্তিখারার বিকল্প আমল
সুহৃদ, জ্ঞানী, অভিজ্ঞ ও নেককার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করাকে আলেমরা ইস্তিখারার উত্তম বিকল্প বলেছেন। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ইস্তিখারার আগে এমন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা মুস্তাহাব, যার কল্যাণকামিতা, আন্তরিকতা, সচেতনতা, দ্বিনদারি ও প্রজ্ঞার ব্যাপারে জানা যায়। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)
অবশ্য ইস্তিখারা ও পরামর্শ দুটি করাই উত্তম। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্রষ্টার সঙ্গে ইস্তিখারা করল, সৃষ্টির সঙ্গে পরামর্শ করল এবং নিজ কাজে দৃঢ় রইল, সে লজ্জিত হয় না।’ (আল ওয়াবিলুস সাইয়িব, পৃষ্ঠা-১১২)
আল্লাহ সবাইকে সঠিকভাবে ইস্তিখারা করার তাওফিক দিন। আমিন।