একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তাহমিনা। দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায়। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অল্প অল্প করে জমাচ্ছিলেন টাকা। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া টাকা ও গ্রাম থেকে জমি বিক্রি করে আনা টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন কোম্পানরি সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাধ্যের মধ্যে মেলাতে পারেননি ছোট আকারের একটি ফ্ল্যাট।
তাহমিনা বলেন, ‘সবারই ইচ্ছা থাকে আবাসন সমস্যা দূর করার। কারণ নগরজীবনে আয়ের বেশি অংশই চলে যায় বাসাভাড়া বাবদ। ভাবছিলাম জমানো টাকায় ৫০ লাখের মধ্যে ছোট কোনো ফ্ল্যাট পাবো। কিন্তু ৮০ লাখের নিচে পছন্দমতো ফ্ল্যাট নেই। আর বড় ফ্ল্যাট তো কোটি টাকার ওপর। ডাউন পেমেন্টে ফ্ল্যাট কিনলে আবার সন্তানদের লেখাপড়া করানো যাবে না। তাই আপাতত ওই স্বপ্ন আর দেখছি না।’
একই কথা জানান অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অবসরের অর্ধেক টাকায় গ্রামে বাগানবাড়ি করেছি। ইচ্ছা ছিল শহরেও একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। কিন্তু আমার টাকা ৫০ লাখ আর ফ্ল্যাট কিনতে লাগবে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ। রেজিস্ট্রেশন খরচ আছে, অন্যান্য খরচও করা লাগবে। অতিরিক্ত দাম বাড়ায় আমার ফ্ল্যাটের ইচ্ছা ইচ্ছাই থেকে গেলো।’
ফ্ল্যাটের দাম বাড়ার কথা স্বীকার করছেন আবাসন ব্যবসায়ীরাও। তারা জানান, নির্মাণ উপকরণের অতিরিক্ত দাম বাড়ার ফলে ছোট ফ্ল্যাটের খরচই ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা। বড় বা মাঝারি আকারের ফ্ল্যাটের খরচ আরও বেশি পড়ছে। এ অবস্থায় চাইলেও লোকসানে বিক্রি করতে পারবেন না বিক্রেতা।
এ বিষয়ে আইএসও হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল মাহমুদ বলেন, ‘এখন ফ্ল্যাট বিক্রি কম, ছোট-মাঝারির বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। বিক্রি না থাকায় অনেক কোম্পানিই বিনিয়োগ করে লোকসানে রয়েছে।
কম দামে বিক্রিও করতে পারছেন না, পথে বসে পড়বে কোম্পানিগুলো। তবে বড় ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে কিছুটা, সেটাও আশানুরূপ না। নির্মাণ উপকরণের দাম বেশি হলে মধ্য আয়ের মানুষের জন্যও কম দামে ফ্ল্যাট গড়ে দেওয়া সম্ভব।’
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্র বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছিল ১৫ হাজার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার।
ওই অর্থবছরের প্রায় পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। বিক্রি খরা কাটেনি চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরেও। সংকট আরও ঘণীভূত হতে পারে আগামীতে। এমনটা হলে মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ্যের বাইরে চলে যাবে আবাসন খাত। যদিও ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি দূর হবে, সংকট সহসাই কেটে যাবে। এতে কমবে নির্মাণ উপকরণের দাম। যদি এমনটা হয় তাহলে আবারও ক্রেতা পাবেন কম দামেই ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট।
এ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সাবেক সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভুঁইয়া বলেন, ‘বেশি দামে রড-সিমেন্ট কিনে কোনো ব্যবসায়ী কম দামে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট গ্রাহকদের দিতে পারবে না। এজন্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম আগে কমানো উচিত। এটি হলে সব ধরনের ক্রেতাই কিনতে পারবে ফ্ল্যাট। তবে এখন বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।’
নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি
মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে রডের দাম প্রতি টনে ৩৫ হাজার টাকা বেড়েছে। ২০২০ সালে এক টন রড কিনতে খরচ পড়তো ৬৪ হাজার, ২০২১ সালে সেটা ৭০ হাজার টাকা হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে হয় ৯৪ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে রেকর্ড গড়ে প্রতি টন এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। দাম বেড়ে যায় সিমেন্ট, বালু, পাথর, ইট, গ্রিল ও রেলিংয়ের। বেড়ে যায় লেবার খরচও।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা বিক্রেতারা জানান, কোম্পানি ও রডের মানভেদে দাম বেড়েছে চার থেকে আট হাজার টাকা। নির্বাচনের আগে যে রড প্রতি টন ৮৫ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল, সেটি এখন ৯০ হাজার টাকা হয়েছে। ৯০ হাজার টাকার প্রতি টন রড এখন ৯৫ থেকে ৯৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৯৪ হাজার টাকার রড এখন আবারও লাখ টাকা বা তার কাছাকাছি হয়েছে।
রড-সিমেন্টের মতোই বালু, পাথর, গ্রিল, রেলিং ও লেবার খরচের দামেরও পার্থক্য দেখা গেছে নির্বাচনের আগে-পরে। বিক্রেতারা বলছেন, নির্বাচনের পরপরই ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি ফুট এলসি পাথর ২১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে পাইলিংয়ের পাথর বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা পর্যন্ত। ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে লালবালু প্রতি সিএফটি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়ে সাদাবালু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ ও সাদা লোকাল বালু ১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভরাট বালুর দামও বেড়েছে। প্রায় দুই টাকা দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা সিএফটি।
বাড়তি ইটের দামও। এখন প্রতি হাজার এক নম্বর ইট বিক্রি হচ্ছে ১৩ হাজার টাকায়, মাসখানেক আগেও যেটা ১১ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। দুই নম্বর (মানভেদে) ইট ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। খোয়ার দামও বেড়েছে। প্রতি সিএফটি খোয়া বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা, আর পুরোনো ইটের খোয়া বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকায়।
আল্লাহর দান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণত নির্মাণের সিজন শুরু হয় নভেম্বরে। এসময়ে নির্মাণ উপকরণের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। তাছাড়া মূল উপকরণ রডের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে অন্যগুলোতে।