ঝুলে আছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ জঙ্গিদের আপিল

মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দেশের শীর্ষ জঙ্গিদের আপিল সুপ্রিমকোর্টে ঝুলে আছে দীর্ঘদিন যাবত। এদের মধ্যে নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১৫৪ জন রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আরও তিন শতাধিক জঙ্গির আপিল রয়েছে।

বিচারিক আদালতে ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হলেও মামলাজটের দীর্ঘসূত্রতায় বছরের পর বছর দূর্ধষ এসব জঙ্গিদের বিষয়টির কোনো সুরাহা হচ্ছে না। মামলাগুলো চূড়ান্ত নিষ্পত্তির লক্ষে আপিলে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব মামলার কয়েকটি আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স হিসেবেও শুনানির অপেক্ষায় আছে।

বিশেষ করে গোপালগঞ্জের কোটালি পাড়ার মুফতি আব্দুল হান্নান, শরীয়তপুরের মালেক হোসেন ওরফে মালেক জিহাদী ওরফে মালেক বেপারী, একই জেলার কামরুজ্জামান স্বপন, চাঁদপুরের শরীফ শাহেদুল বিপুল, গাইবান্ধার মামুনুর রশীদ ওরফে জাহিদ, ঢাকার হানিফ হাসান সুমন, বাগেরহাটের মো. নিজাম উদ্দিন রনি ওরফে রেজা, গাজীপুরের আরিফুর রহমান হাসিব ওরফে আকাশ, বাগেরহাটের সাইদুল মুন্সী ইমন ওরফে পলাশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাসুদ আনিসুল ইসলাম ওরফে ভুট্টো, ঢাকার আব্দুল্লাহ আল সোয়াইন ফারুক ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে আকাশ, গোপালগঞ্জের এনায়েতুল্লাহ জুয়েল ওরফে ওয়ালিদ, নীলফামারীর আশ্রাফুল ইসলাম ওরফে আব্বাস খান, রাজশাহীর আদনান সামী আম্বার ওরফে জাহাঙ্গীর ও সাতক্ষীরার শফিউল্লাহ তারেক ওরফে আবুল কালাম।

তারা বর্তমানে গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার ও কাশিমপুর কারাগারে আছে। এদের মধ্যে গাজীপুর কারাগারে বোমা হামলা দায়ে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত ১০ জঙ্গির আপিল গত বুধবার থেকে শুনানি শুরু হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের মূলনেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানসহ শীর্ষ ৬ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয়। এরপর আর কোনো জঙ্গির ফাঁসির রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। অথচ দেশের বিভিন্ন কারাগারে ১৫৪ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি রয়েছে।

সূত্র মতে, যশোরের উদীচি অনুষ্ঠানে রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ, পল্টনে সিপিবি জনসভা, সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর, খুলনা ও মিরপুরে কাদিয়ানি মসজিদে, দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা, ঝালকাঠিতে বিচারকের ওপর বোমা হামলাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বোমা হামলার ঘটনায় গত ১০ বছরে ১৫৪ জঙ্গিকে ফাঁসির দন্ড দেয় নিম্ন আদালত। ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারজনের ফাঁসি রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তারা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন। মামলাগুলো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ফাঁসির দণ্ড বহাল তাকা ওই চার জঙ্গি হলো শেরপুরের আমজাদ হোসেন বাবু, নারায়ণগঞ্জের এইচ এম মাসুমুর রহমান, জামালপুরর আক্তারুজ্জামান ও ময়মনসিংহের আসাদুজ্জামান চৌধুরী পনির ওরফে আসাদ। এছাড়াও ৫ শতাধিক জঙ্গিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।

সাজা কার্যকর না হওয়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, মূল আদালত যদি জঙ্গিদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানও করেন তা কার্যকর হয় না, যদি হাইকোর্ট সেটাকে কনফার্ম না করে, বা বহাল না রাখে।

তিনি বলেন, পঞ্চম সংশোধনীর প্রেক্ষিতে এখন মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দণ্ডিত যে কোনো লোক আপিল করলে অটোমেটিক আপিল হিসেবে হিসেবে ট্রিট হয়, লিভ পিটিশন হিসেবে নয়। তাই প্রত্যেকটা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তিনটা কোর্টে বিচারের সুযোগ নিতে পারছে। ট্রায়াল কোর্টে, হাইকোর্টে আপিলে এবং সুপ্রিম কোর্টে আপিল হিসেবে ট্রিট হচ্ছে। ফলে দুটি কোর্টে এটি আপিল হিসেবে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে।

তারপরও আপ্রাণ চেষ্টা তারা করছেন উল্লেখ করে মাহবুবে আলম বলেন, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বিচারপতিদেরও আইনের ফরমালিটিজ অবজার্ভ করেই বিচার করতে হয়। সুতরাং আইন মোতাবেকই চলতে হচ্ছে। ও আইন মোতাবেকই এগুলো নিস্পত্তি হবে। এবং সুপ্রিম কোর্ট এগুলো বহাল রাখে তাহলে এগুলো কার্যকর হবে। তাই সবাইকে ধের্য্য ধরে একটু অপেক্ষা করতে হবে।

মামলার সংশ্লিষ্টরা জানান, বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা যাচ্ছে না। এছাড়া মামলা প্রস্তুত করা, প্রশাসনিক কাজের জটিলতা, মামলা শুনানির জন্য তালিকায় আসতে সময় লাগা হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে মামলার জট থাকাসহ নানা জটিলতার কারণে এসব মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে। এছাড়া এসব মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের কাছে একের পর এক সময়ের আবেদন করেও বিচারিক কার্যক্রমকে দীর্ঘায়িত করছেন।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের বোমা হামলার ঘটনায় উদ্ভূত একটি হত্যা মামলায় লক্ষ্মীপুরের দায়রা জজ আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন জেএমবির জঙ্গি আমজাদ হোসেন বাবু ও এইচ এম মাসুমুর রহমানকে।২০০৬ সালের ১৫ আগস্ট রায় দেওয়া হলেও এখনো ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়নি হাইকোর্টে। একই বছরের বোমা হামলার ঘটনায় শরীয়তপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসির নির্দেশ দেন কামারুজ্জামান ওরফে স্বপন নামের এক জঙ্গিকে।

২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিলেটের দায়রা জজ ফাঁসির দণ্ড দেন জঙ্গি আক্তারুজ্জামানকে। ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে জঙ্গি আবুল কালাম ওরফে শফিউল্লাহর। এই আসামিদেরও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়নি এখনো।

২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ মৃত্যুদণ্ড দেন জঙ্গি আসাদুজ্জামানকে। সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ওই রায় দেওয়া হয়। একই রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় মুফতি হান্নানের দুই সহযোগী বিপুল ও রিপনকে। মুফতি হান্নান ও বিপুল কারাগারে আছেন। রিপন পলাতক। ওই দুজনের ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ অনুমোদনের বিষয়টি সাড়ে পাঁচ বছর ধরে শুনানির অপেক্ষায় ছিল হাইকোর্টে। সম্প্রতি হাইকোর্ট এদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও আপিল বিভাগে আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে।
এসব রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি শেষে উচ্চ আদালতও তাদের ফাঁসি বহাল রাখে। কিছু মামলার আপিল এখনও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এবং মামলাগুলোর পেপার বুক তৈরির কাজ চলছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ জানান, বেশ কিছু জঙ্গির মামলা আপিলে শুনানির জন্য রয়েছে। তবে কতজন জঙ্গির মামলা আপিল শুনানির জন্য আছে সে বিষয়টি তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।

সাব্বির ফয়েজ বলেন, কিছু মামলা হইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স নিশ্চিত করতে এসেছে। আবার কিছু মামলা হাইকোর্ট পেরিয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিলের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে কিছু মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের কাজ চলছে। তবে কতদিনের মধ্যে এসব মামলার আপিল নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়টি সুস্পস্ট করে বলা কঠিন।তিনি বলেন, এসব মামলার পেপারবুক তৈরির কাজ গুরুত্ব সহকারে করা হচ্ছে। অনেক জঙ্গির মধ্যে মুফতি হান্নানসহ নামকরা বেশকয়েকজন জঙ্গির মামলা রয়েছে।

ডেথ রেফারেন্স মামলায় রাষ্ট্রের পক্ষে শুনানি করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান রুবেল। তিনি বলেন, নানা কারণে এ মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে সময় লেগে যাচ্ছে। মামলা প্রস্তুত করা, প্রশাসনিক কাজের জটিলতা, মামলা শুনানির জন্য আসতে সময় লাগা ইত্যাদি কাজিই বেশি সময় লেগে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এ মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের কাছে সময়ের আবেদন করেন। মামলার একপক্ষের আইনজীবীরা শুনানি করতে চাইলেও অন্য পক্ষ আদালতের কাছে সময় আবেদন করে মামলা বিলম্বিত করা হচ্ছে।ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানি করতে প্রধান বিচারপতি নিজে তালিকা তৈরি করে দেন, এজন্য সময় লাগে বলে জানান মনিরুজ্জামান।তিনি বলেন, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টে লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলে আছে। মামলার ভিড়ে অনেক সময় এ মামলাগুলো শুনানির জন্য আদালতের তালিকায় আসতে সময় লাগে।

ওই মামলাগুলো কীভাবে দ্রুত কার্যকর করা যায়- এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অুনিচ্ছুক হাইকোর্টের এক আইনজীবী জানান, উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা মামলাগুলোকে ২ ভাগে বিভক্ত করা যায়। একটি হচ্ছে হাইকোর্ট ডিভিশন, অপরটি এ্যাপিলেট ডিভিশন। এপিলেট ডিভিশনের মামলাগুলো প্রধান বিচারপতি ইচ্ছে করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিস্পত্তি করতে পারেন। আর হাইকোর্ট ভিশনের মামলাগুলো অ্যাটর্নি জেনারেল বা তার সহকারীরা উদ্যোগ নিলে দ্রুত নিস্পত্তি করা সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর