ঢাকা ০৭:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চালের বাজার

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১৪:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৪
  • ৮০ বার

মাত্রই শেষ হলো আমন মৌসুম। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সাধারণত ডিসেম্বরের শুরু থেকে বাজারে আমন ধানের চাল আসতে শুরু করে। এরপর জানুয়ারিতে পুরোদমে বাজারে আমন চালের সরবরাহ দেখা যায়। তবে গত সপ্তাহ থেকে মিল, পাইকারি ও খুচরা-প্রায় সব পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৬ টাকা।  প্রচুর মজুদ থাকার পরেও ধানের দাম বেড়েছে। বাজারের কারসাজির জন্য কর্পোরেট কোম্পানি এবং মিলারদের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ধান কাঁটার মৌসুমে মিল মালিক ও বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো কৃষকদের কাছ থেকে আমন ধান খুব কম দামে কিনলেও এখন পিক মৌসুমে তারা অনেক বেশি দামে ধান বিক্রি করছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি কৃষকের কাছে আমন ধান বিক্রি হয় ৯০০-৯৮০ টাকা মণ (৪০ কেজি)। বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, “অনেক কর্পোরেট কোম্পানি ও মিলাররা ধান কাঁটার মৌসুমে কম দামে প্রচুর পরিমাণে ধান কিনেছে এবং তারা এখন চালের দাম বাড়াচ্ছে। “কর্পোরেট কোম্পানি এবং বড় অটো মিলাররা চাল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা চালের ব্যবসা থেকে সাধারণ ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং এখন সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে এর দাম বাড়াচ্ছে,” বলেন তিনি। কৃষি-অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জাহাঙ্গির আলম খান বলেন, পিক সিজনে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের বাজার কারসাজি দায়ী। “কর্পোরেট কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণে ধান কিনলেও তারা বাজারে চাল সরবরাহ করে না। সাধারণ নির্বাচনের পরপরই চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির জন্য সরকারের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা দায়ী,” বলেন তিনি। রাজধানীসহ সারাদেশে গত ৭-৮ দিনে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।  রাজধানীর কারওয়ানবাজার, বাবুবাজার, মিরপুর-৬ ও মোহাম্মদপুর পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় উন্নত মানের মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬৪-৬৫ টাকা থেকে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, মাঝারি মানের ২৮ চাল আগের ৫০ টাকা থেকে ৫৪ টাকা কেজি, পাইজাম ৫০ টাকা থেকে ৫২ টাকা কেজি এবং মোটা চাল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। মুক্ত রাইস এজেন্সি কারওয়ানবাজারের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান তালুকদার বলেন, করপোরেট কোম্পানি ও মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছে। “তারা গত ৭-৮ দিনে সব ধরনের চালের দাম প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ২০০-২৫০ টাকা বাড়িয়েছে। গত ৫-৬ মাস ধরে দাম স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পরপরই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়,” বলেন তিনি। নওগাঁ ধান ও চাল পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, প্রতি মণ ধানের দাম বেড়েছে ১ হাজার ২৫০ টাকা, এতে চালের দাম বেড়েছে। সাধারণত, ধান কাটা শুরু হওয়ার ২-৩ মাস পরে সরবরাহ হ্রাসের সাথে ধানের দাম বেড়ে যায়, তিনি দাবি করেন। “মিলার ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী অবৈধভাবে ধান মজুত করছেন। সরকার যদি অবৈধ মজুদদারদের উচ্ছেদ করে বাজারে ধানের সরবরাহ বাড়াতে পারে তবে চালের দাম কমতে পারে,” বলেন তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) চলতি মৌসুমে ৫৯.৩৩৫ লাখ হেক্টর জমি থেকে ১৭১.৭৮৮ লাখ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে চাল আমদানি করেনি সরকার। আবার বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে গম আমদানিও কমেছে। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ফলে এর বড় একটি চাপ পড়েছে খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারি গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। ছয় মাসের ব্যবধানে এটি কমেছে সাড়ে তিন লাখ টনের বেশি। এ পরিস্থিতিতে চাল আমদানি না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে কিছু পরিমাণ হলেও আমদানি করা দরকার ছিল। তাদের ভাষ্য, সরকারিভাবে দেশে ধানের রেকর্ড উৎপাদনের কথা বলা হলেও ভরা মৌসুমে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। রমজানের বাকি আর মাত্র দুই মাস। প্রতি বছরই এ সময় সরকারি সহায়তার আওতা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু খাদ্যশস্যের মজুদ কমে আসায় এবং চাল আমদানি না করার কারণে ব্যবসায়ীরা বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন। আমদানির যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা বাস্তবায়নেও সময় লাগবে। এ ছাড়া উৎপাদন, চাহিদা ও ঘাটতির প্রকৃত তথ্য বের করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চালের বাজার

আপডেট টাইম : ১১:১৪:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৪

মাত্রই শেষ হলো আমন মৌসুম। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সাধারণত ডিসেম্বরের শুরু থেকে বাজারে আমন ধানের চাল আসতে শুরু করে। এরপর জানুয়ারিতে পুরোদমে বাজারে আমন চালের সরবরাহ দেখা যায়। তবে গত সপ্তাহ থেকে মিল, পাইকারি ও খুচরা-প্রায় সব পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৬ টাকা।  প্রচুর মজুদ থাকার পরেও ধানের দাম বেড়েছে। বাজারের কারসাজির জন্য কর্পোরেট কোম্পানি এবং মিলারদের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ধান কাঁটার মৌসুমে মিল মালিক ও বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো কৃষকদের কাছ থেকে আমন ধান খুব কম দামে কিনলেও এখন পিক মৌসুমে তারা অনেক বেশি দামে ধান বিক্রি করছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি কৃষকের কাছে আমন ধান বিক্রি হয় ৯০০-৯৮০ টাকা মণ (৪০ কেজি)। বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, “অনেক কর্পোরেট কোম্পানি ও মিলাররা ধান কাঁটার মৌসুমে কম দামে প্রচুর পরিমাণে ধান কিনেছে এবং তারা এখন চালের দাম বাড়াচ্ছে। “কর্পোরেট কোম্পানি এবং বড় অটো মিলাররা চাল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা চালের ব্যবসা থেকে সাধারণ ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং এখন সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে এর দাম বাড়াচ্ছে,” বলেন তিনি। কৃষি-অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জাহাঙ্গির আলম খান বলেন, পিক সিজনে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের বাজার কারসাজি দায়ী। “কর্পোরেট কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণে ধান কিনলেও তারা বাজারে চাল সরবরাহ করে না। সাধারণ নির্বাচনের পরপরই চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির জন্য সরকারের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা দায়ী,” বলেন তিনি। রাজধানীসহ সারাদেশে গত ৭-৮ দিনে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।  রাজধানীর কারওয়ানবাজার, বাবুবাজার, মিরপুর-৬ ও মোহাম্মদপুর পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় উন্নত মানের মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬৪-৬৫ টাকা থেকে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, মাঝারি মানের ২৮ চাল আগের ৫০ টাকা থেকে ৫৪ টাকা কেজি, পাইজাম ৫০ টাকা থেকে ৫২ টাকা কেজি এবং মোটা চাল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। মুক্ত রাইস এজেন্সি কারওয়ানবাজারের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান তালুকদার বলেন, করপোরেট কোম্পানি ও মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছে। “তারা গত ৭-৮ দিনে সব ধরনের চালের দাম প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ২০০-২৫০ টাকা বাড়িয়েছে। গত ৫-৬ মাস ধরে দাম স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পরপরই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়,” বলেন তিনি। নওগাঁ ধান ও চাল পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, প্রতি মণ ধানের দাম বেড়েছে ১ হাজার ২৫০ টাকা, এতে চালের দাম বেড়েছে। সাধারণত, ধান কাটা শুরু হওয়ার ২-৩ মাস পরে সরবরাহ হ্রাসের সাথে ধানের দাম বেড়ে যায়, তিনি দাবি করেন। “মিলার ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী অবৈধভাবে ধান মজুত করছেন। সরকার যদি অবৈধ মজুদদারদের উচ্ছেদ করে বাজারে ধানের সরবরাহ বাড়াতে পারে তবে চালের দাম কমতে পারে,” বলেন তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) চলতি মৌসুমে ৫৯.৩৩৫ লাখ হেক্টর জমি থেকে ১৭১.৭৮৮ লাখ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে চাল আমদানি করেনি সরকার। আবার বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে গম আমদানিও কমেছে। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ফলে এর বড় একটি চাপ পড়েছে খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারি গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। ছয় মাসের ব্যবধানে এটি কমেছে সাড়ে তিন লাখ টনের বেশি। এ পরিস্থিতিতে চাল আমদানি না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে কিছু পরিমাণ হলেও আমদানি করা দরকার ছিল। তাদের ভাষ্য, সরকারিভাবে দেশে ধানের রেকর্ড উৎপাদনের কথা বলা হলেও ভরা মৌসুমে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। রমজানের বাকি আর মাত্র দুই মাস। প্রতি বছরই এ সময় সরকারি সহায়তার আওতা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু খাদ্যশস্যের মজুদ কমে আসায় এবং চাল আমদানি না করার কারণে ব্যবসায়ীরা বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন। আমদানির যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা বাস্তবায়নেও সময় লাগবে। এ ছাড়া উৎপাদন, চাহিদা ও ঘাটতির প্রকৃত তথ্য বের করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।