কতটুকু পেল কৃষি, কতটুকু কৃষক? শাইখ সিরাজ

এক সময় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ছিল অর্থ-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শহরের সচেতন নাগরিকদের জানা-বোঝার বিষয়। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়া-কমার হিসাবটি মাথায় নিয়েই লক্ষ্য রাখতেন বাজেট ঘোষণার দিকে। কিন্তু সময়ের পালাবদলে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সঙ্গে এখন সম্পর্কিত হয়ে গেছেন কম-বেশি সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিশেষ করে গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। মাঠ পর্যায়ে কৃষকের বাজেট অভিজ্ঞতাও পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি জাতীয় বাজেট এখনো তাদের থেকে কত দূরে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অনেক কিছুই চুলচেরা হিসাব কষতে শিখেছে। আমি ১১ বছরে ৪৩টি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাক-বাজেট আলোচনা করেছি কৃষকের সঙ্গে। এ অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, জাতীয় বাজেটের সঙ্গে দিনে দিনে যুক্ত হয়ে গেছে দেশের ৭০ ভাগেরও বেশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। অথচ ২০০৫ সালে যখন এ কার্যক্রম শুরু করি তখন এদেশের গ্রামবাংলার এক ভাগ মানুষও বাজেট কী জিনিস তা বুঝত না বা জানত না। কিন্তু এখন বাজেট সম্পর্কে যখন কিছুটা জানা-বোঝা হয়েছে তখন এর ভিতর ঢুকতে গিয়েই যেন হোঁচট খাচ্ছে তারা। এবারের কথাই ধরা যাক। বরাদ্দের বাস্তবতাই বলছে এবারের বাজেটও গতানুগতিক। তার মানে কৃষির ভাগ কমেছে। সামগ্রিকভাবে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে বরাদ্দ ১২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৩০। চলতি অর্থবছরের চেয়ে দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। গত পাঁচ বছরের বাজেট বিভাজন হিসাব করলে দেখা যায়, সামগ্রিক বাজেটের আকারের বিবেচনায় কৃষি খাতে বরাদ্দ কমছে। গত বাজেটে ১২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে যেখানে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৬৮ ভাগ। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকেই বরাদ্দ হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। ওই অর্থবছরে কৃষির ভাগে ছিল ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৪০, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল আশাব্যঞ্জক বৃদ্ধি অর্থাৎ ৮ দশমিক ৫২, তার পরের বছর গিয়ে অর্থাৎ গত অর্থবছরে আবার পৌঁছে যায় ৫ দশমিক ৬৮ ভাগ। কৃষি খাতে এই হচ্ছে বরাদ্দের বাস্তবতা। কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য বিবেচনা করেই কি বাজেটে কৃষির ভাগ কমে আসছে? অবশ্য উৎপাদন সাফল্যের তৃপ্তিকর তথ্যের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমতও রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। এবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ২৮৩ কোটি টাকা বেশি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন নতুন বাজেটের বরাদ্দ ও বাস্তবায়নের রূপরেখার তুলনায় বিগত সময়ের অর্জন, নেওয়া পদক্ষেপ ও উন্নয়নের কথা সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। যেগুলো ছয় বছর ধরেই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায় রয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় ২০১৩ সালে কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী প্রতিশ্রুত চরাঞ্চলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ছিল চলতি বাজেটে। এবারও তা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ খাতের জন্যও একই কথা। অর্থমন্ত্রী নতুন যে কথা বলেছেন তা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ ঋণ কার্যক্রম অতিসত্বর শুরু করবে যেখানে পাঁচ শতাংশ হারে গবাদি খরিদ ও লালনের জন্য অর্থ দেওয়া হবে। এ খাতে তিন বছর মেয়াদি একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

শাকসবজি ফলমূল সংরক্ষণে কোনো দিকনির্দেশনা না এলেও দানাদার খাদ্য সংরক্ষণের সাধ্য আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০ লাখ মেট্রিক টনের সঙ্গে আরও পাঁচ লাখ মেট্রিক টন বেশি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সাইলো নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। তবে পোলট্রি শিল্পের আয়করমুক্ত সুবিধার মেয়াদ আর বাড়ছে না। আমদানি পর্যায়ে অব্যাহত রাখা হয়েছে শুল্ক করমুক্ত সুবিধা। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে গুরুত্ব দেওয়ার কথা। তবে কৃষি উপকরণ, সার, বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্যে কর অব্যাহতি বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

জাতীয় বাজেট কৃষকের কাছে দুর্বোধ্য ও নীরস বিষয় হলেও এ নিয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করার মতো শক্তি ও সাহস অর্জন করেছে দেশের কৃষক। দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা একবাক্যে বলেছেন, কৃষকের ন্যায্যমূল্যে ফসল বিক্রি ও ফসল সংরক্ষণের কোনো হিসাব-নিকাশ বাজেটে নেই। এমনকি এ কথাও এক কৃষককে বলতে শুনেছি, হরতাল-অবরোধে যাদের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কিন্তু যেসব কৃষক দিনের পর দিন তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারেনি তারা কিছুই পায়নি। এরপরও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় সরকারের বিগত ছয় বছরের উন্নয়ন ফিরিস্তি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরলেও তার বিপরীতের সংকটের চিত্রগুলো উঠে আসেনি। তিনি উল্লেখ করেছেন উচ্চফলনশীল শস্যের জাত উদ্ভাবন, অভিযোজন কৌশল ও পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং লবণাক্ততা, জলমগ্নতা ও খরাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনসহ সার্বিক কৃষি গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কিন্তু কৃষি গবেষণায় কয়েক বছর আগে বরাদ্দকৃত এনডাউমেন্ট তহবিলের বাইরে নতুন কোনো বরাদ্দের উল্লেখ নেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে খাদ্য, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, যোগাযোগ, শিল্প, বাণিজ্য, পানিসম্পদ, পাট ও বস্ত্র থেকে শুরু করে বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের কম-বেশি যোগসূত্র রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বিবেচনায় কৃষির প্রতি মনোনিবেশ করা হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে তা রাখতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, কিন্তু এই বিবেচনাটি বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে এটি অত্যন্ত হতাশাজনক। কৃষির প্রতি গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে সামগ্রিক অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষির সঙ্গে সংযুক্ত খাতগুলোতেও কোনো না কোনোভাবে পড়ছে এর প্রভাব।

বাজেটে অর্থনৈতিক উন্নতির কথায় এবার বলেছেন প্রবৃদ্ধি ৬-এর উপরে আছে কিন্তু এবার স্বীকার করেছেন যে, ৬-এর উপরে উঠতে পারছেন না। যেটা পরিকল্পনায় আট শতাংশে আসার কথা ছিল। শিল্পখাতসহ সেবাখাতগুলো খারাপ করছে না। তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না কেন। এই উন্নতির ধারায় যে পরিবর্তন এবং অবনতি হচ্ছে তার মূল কারণ হলো কৃষি। এ সরকারের প্রথম দুই বছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশ হারে বেড়েছিল। তারপর হঠাৎ করে দুই শতাংশ নেমে আসে। পরে ২.৯ শতাংশ ছিল। গত বছর চার শতাংশ ছিল এ বছর আবার তিন শতাংশে নেমে এসেছে। এ বছর যদি তিন শতাংশে না নামত তাহলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অবশ্যই ৬.৫ শতাংশ থেকে হয়তো ৬.৮ শতাংশে পৌঁছত। কৃষি খাতের এই যে উত্থান-পতন সে ব্যাপারে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি। নির্দ্বিধায় বলা যায়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশ্নে কৃষির প্রতি যে গুরুত্ব প্রয়োজন তা দেওয়া হচ্ছে না।

২০১৮ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য নির্মূল করা ও মধ্যআয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন গ্রামীণ দরিদ্র ও কৃষক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। সেক্ষেত্রে ঘোষিত বাজেট কোনোই আশার আলো দেখাচ্ছে না বলে মন্তব্য শুনেছি দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও বাজেট বিশ্লেষকদের।

দেশে সরকারি পর্যায়ে সরাসরি কৃষিক্ষেত্রের বিরাজমান সংকটের সঠিক তথ্য অনুসন্ধানের কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি পর্যায়েও নেই। বরাবরই বাজেট প্রণয়ন করা হয় অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের চিন্তার আলোকে। গত ১১ বছরে রাষ্ট্রের সহায়ক একটি কার্যক্রম হিসেবে আমরা কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি বাজেট পরিকল্পনাটি হওয়া উচিত নিচ থেকে। অর্থাৎ তৃণমূলের সমস্যাগুলোকে বিবেচনায় এনে, কিন্তু সে বিবেচনা বরাবরই উপেক্ষিতই হচ্ছে। কিছু বিষয় সরকার বিবেচনায় আনছে না তা নয়। কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় সরকারের সাফল্য আছে সন্দেহ নেই। ফসল উৎপাদন বাড়ছে কিন্তু ফসল উৎপাদনের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান যে কৃষকের, সেই কৃষক বাজারমূল্য পাচ্ছে না। দিনে দিনে কৃষকের আবাদি এলাকার আয়তন ছোট হচ্ছে। এক চিলতে জমিতে ফসল উৎপাদন করে তারা দিন চালায়। কিন্তু পণ্যের মূল্যটি না পেলে সে যে কোনো বিভীষিকায় পড়ে সেই বিবেচনাটি আজকের সময়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পর বছর এই বঞ্চনা চলে এলেও এক্ষেত্রে জাতীয় বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা বা চিন্তাকাঠামো নেই। এমনকি কৃষিপণ্যের একটি মূল্য কমিশন গঠনও আজ পর্যন্ত করা হয়নি। যে কারণে কৃষক যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেছে। তার ভালো থাকা বা জীবনমান উন্নয়নের কথা সেভাবে ভাবা হচ্ছে না। এটি আমাদের জাতীয় নীতি পরিকল্পনার জন্য একটি পশ্চাৎপদ দিক। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, কৃষি উৎপাদনে সাফল্যের বিবেচনার আগে ব্যক্তি কৃষকের জীবন বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি দেবে সরকার। তা না হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জন, মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছানো কিংবা চরম দারিদ্র্য সম্পূর্ণ নির্মূলের সমীকরণ মোটেও মিলবে না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর