ঢাকা ১২:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা কেন জঙ্গি হচ্ছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩০:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০১৬
  • ৬২৮ বার

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের পেছনে মাদ্রাসা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করা হলেও সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর জঙ্গীবাদের নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে। এই হামলাকারীরা উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারের সন্তান।
বাংলাদেশের এই তরুণরা উন্নত জীবন এবং উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলে জঙ্গীবাদের পথে পা বাড়াচ্ছে।
গুলশান এবং শোলাকিয়া হামলায় জড়িত অন্তত দুজন বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। আগে কয়েকটি জঙ্গী হামলায়ও একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নাম এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে এখানকার শিক্ষার্থীদের দেখে অবশ্য বিশ্বাস করা কঠিন যে এরকম পরিবেশে তারা জঙ্গীবাদি হতে পারে। এখানকার শিক্ষার্থীরা মনে করেন ব্যক্তিগত জীবনে যে কেউ উগ্রবাদে জড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থী শাহেদা বলেন, “নিব্রাস কিন্তু ড্রপআউট ছিল নর্থসাউথ থেকে। মালয়েশিয়া গিয়ে তার ব্রেইনওয়াশটা হয়েছে।”
নর্থ সাউথের নাম বার বার আসায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ফাহিম বলেন, “একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এইটিন প্লাস। সে নিজেই জাজ করতে পারে কোনটা রাইট কোনটা রং। মোটিভেশনটা সম্পূর্ণ ওই ছাত্রের ওপরই নির্ভর করে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট একটা বড় যোগাযোগ মাধ্যম।”
আরেক ছাত্র বলেন, “এমনভাবে ব্রেইনওয়াশটা করা হয়, কেউ ওখান থেকে সরে আসতে পারে না। যার কারণে ওরা আত্মঘাতী হয়ে যায়”।
এসব জঙ্গী কার্যক্রমের সাথে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে ইসলাম এবং রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন ড. মোবাশ্বার হাসান। তিনি বলেন, “ইসলামে একটা কনসেপ্ট আছে মুসলিম উম্মাহ। এই উম্মাহ ধারণাটা হলো মুসলিমরা ভাই ভাই। এরকম ধারণা ওরা ব্যবহার করছে। তারা বলে যে ফিলিস্তিনে দেখ, ইরাক বা সিরিয়াতে দেখ তোমার ভাই-বোনেরা কিভাবে নিগৃহিত হচ্ছে পশ্চিমাদের দ্বারা”।
মিস্টার হাসানের পর্যবেক্ষণে ইঞ্জিয়ারিং এবং ব্যবসায় প্রশাসনের মতো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেয়া তরুণদের জঙ্গী তৎপরতায় সংশ্লিষ্ঠতা বেশি দেখা যাচ্ছে।
“উগ্রবাদী বহু ধরনের ব্যাখ্যা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ওয়াহাবি সালাফি… এদের কথাবার্তাতো খুবই সোজাসাপ্টা। একটা কারণ হতে পারে যেহেতু তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক বেশি সায়েন্স অরিয়েন্টেড অনেক বেশি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, যে দুই যোগ দুই চারই হবে বা কোনো সূত্র দিলে ওই ধরনের কাজই হবে। এই কারণেও হতে পারে যে তারা ধর্মের যে সহজ ব্যাখ্যা তারা সেটাই নিচ্ছে।”
বেসরকারি নামি দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের কেন জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ প্রশ্নে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “দুটো জিনিস হচ্ছে এখানে। একটা হচ্ছে শূণ্যতা। এই শূণ্যতাটা হলো জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই শূন্যতা হলো সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে। জ্ঞান এখানে গভীর ভাবে চর্চা হয়না। এখানে জ্ঞান একমুখী হয়, পেশাদারী হয়। দ্বিতীয় হলো এখানে সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে না, অনুশীলন হচ্ছে না। তার একটা প্রমাণ হচ্ছে এরা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা নিচ্ছেনা সেটা একটা কৃত্রিমতা। সেটা এদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে ইতিহাস থেকে আমাদের সংস্কৃতি থেকে। আরেকটা জিনিস হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ছাত্র সংসদ নেই”।
গুলশান হামলার পর ভিডিও বার্তা দিয়ে বিদেশ থেকে আরো হামলার হুমকি এসেছে যেখানে বাংলাদেশের তরুণদের দেখা গেছে। অনেকে তরুণ দেশ থেকে সিরিয়া চলে গেছে বলেও জানা যায়। মিস্টার চৌধুরীর বিশ্লেষণ হলো, “আমাদের স্থানীয় বড় দুই দলের রাজনীতির ধারা কিন্তু এই তরুণদের আকর্ষণ করেনা। কেননা এদের মধ্যে কোনো আদর্শবাদ নাই। এদের যে রাজনীতি সেটা হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদল ক্ষমতায় আছে আরেকদল ক্ষমতায় যেতে চায়। এদের প্রতিদ্বন্দ্বীতা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীতা। এখন এই তরুণরা যে দুঃসাহসিক কাজ চায়, স্বপ্নের বাস্তবায়ন চায় এই জায়গাটাতেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে হোক বা গোপন পরামর্শের মাধ্যমে হোক তরুণরা ঐদিকে চলে যাচ্ছে। একটা অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে”।
এক্ষেত্রে পুলিশের কাছে কী তথ্য আছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “জঙ্গী চক্র তারা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, স্কুলে মেধাবী উচ্চবিত্তের ছেলেদেরকে বিভিন্ন ভাবে প্রলুব্ধ করে। প্রথমে কিছুদিন ইসলামের আল্লাহর কথা বলে, কোরান হাদিসের কথা বলে তাদের নামাজে অভ্যস্ত করে। এরপর ধীরে ধীরে তারা মাত্রা এবং সুযোগ বুঝে এ ধরনের উগ্র প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
পুলিশ কমিশনার বলেন, “বিভিন্ন নামে এই উগ্রবাদীরা তাদের কর্মকাণ্ড চালায়। কিন্তু এদের মূল সূত্র কিন্তু এক জায়গায়। সালাফিবাদ, ওয়াহিবিজম, উগ্রবাদ মওদুদীবাদ।”
গুলশান এবং শোলাকিয়া হামলাকারিরা ৩ থেকে ৭ মাস পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল। বাংলাদেশে ওই দুটি হামলার পর এখন অনেক তরুণের পরিবার তাদের সন্তান হারিয়ে যাওয়ার খবর দিচ্ছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা কেন জঙ্গি হচ্ছে

আপডেট টাইম : ১২:৩০:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০১৬

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের পেছনে মাদ্রাসা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করা হলেও সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর জঙ্গীবাদের নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে। এই হামলাকারীরা উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারের সন্তান।
বাংলাদেশের এই তরুণরা উন্নত জীবন এবং উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলে জঙ্গীবাদের পথে পা বাড়াচ্ছে।
গুলশান এবং শোলাকিয়া হামলায় জড়িত অন্তত দুজন বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। আগে কয়েকটি জঙ্গী হামলায়ও একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নাম এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে এখানকার শিক্ষার্থীদের দেখে অবশ্য বিশ্বাস করা কঠিন যে এরকম পরিবেশে তারা জঙ্গীবাদি হতে পারে। এখানকার শিক্ষার্থীরা মনে করেন ব্যক্তিগত জীবনে যে কেউ উগ্রবাদে জড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থী শাহেদা বলেন, “নিব্রাস কিন্তু ড্রপআউট ছিল নর্থসাউথ থেকে। মালয়েশিয়া গিয়ে তার ব্রেইনওয়াশটা হয়েছে।”
নর্থ সাউথের নাম বার বার আসায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ফাহিম বলেন, “একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এইটিন প্লাস। সে নিজেই জাজ করতে পারে কোনটা রাইট কোনটা রং। মোটিভেশনটা সম্পূর্ণ ওই ছাত্রের ওপরই নির্ভর করে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট একটা বড় যোগাযোগ মাধ্যম।”
আরেক ছাত্র বলেন, “এমনভাবে ব্রেইনওয়াশটা করা হয়, কেউ ওখান থেকে সরে আসতে পারে না। যার কারণে ওরা আত্মঘাতী হয়ে যায়”।
এসব জঙ্গী কার্যক্রমের সাথে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে ইসলাম এবং রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন ড. মোবাশ্বার হাসান। তিনি বলেন, “ইসলামে একটা কনসেপ্ট আছে মুসলিম উম্মাহ। এই উম্মাহ ধারণাটা হলো মুসলিমরা ভাই ভাই। এরকম ধারণা ওরা ব্যবহার করছে। তারা বলে যে ফিলিস্তিনে দেখ, ইরাক বা সিরিয়াতে দেখ তোমার ভাই-বোনেরা কিভাবে নিগৃহিত হচ্ছে পশ্চিমাদের দ্বারা”।
মিস্টার হাসানের পর্যবেক্ষণে ইঞ্জিয়ারিং এবং ব্যবসায় প্রশাসনের মতো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেয়া তরুণদের জঙ্গী তৎপরতায় সংশ্লিষ্ঠতা বেশি দেখা যাচ্ছে।
“উগ্রবাদী বহু ধরনের ব্যাখ্যা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ওয়াহাবি সালাফি… এদের কথাবার্তাতো খুবই সোজাসাপ্টা। একটা কারণ হতে পারে যেহেতু তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক বেশি সায়েন্স অরিয়েন্টেড অনেক বেশি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, যে দুই যোগ দুই চারই হবে বা কোনো সূত্র দিলে ওই ধরনের কাজই হবে। এই কারণেও হতে পারে যে তারা ধর্মের যে সহজ ব্যাখ্যা তারা সেটাই নিচ্ছে।”
বেসরকারি নামি দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের কেন জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ প্রশ্নে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “দুটো জিনিস হচ্ছে এখানে। একটা হচ্ছে শূণ্যতা। এই শূণ্যতাটা হলো জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই শূন্যতা হলো সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে। জ্ঞান এখানে গভীর ভাবে চর্চা হয়না। এখানে জ্ঞান একমুখী হয়, পেশাদারী হয়। দ্বিতীয় হলো এখানে সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে না, অনুশীলন হচ্ছে না। তার একটা প্রমাণ হচ্ছে এরা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা নিচ্ছেনা সেটা একটা কৃত্রিমতা। সেটা এদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে ইতিহাস থেকে আমাদের সংস্কৃতি থেকে। আরেকটা জিনিস হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ছাত্র সংসদ নেই”।
গুলশান হামলার পর ভিডিও বার্তা দিয়ে বিদেশ থেকে আরো হামলার হুমকি এসেছে যেখানে বাংলাদেশের তরুণদের দেখা গেছে। অনেকে তরুণ দেশ থেকে সিরিয়া চলে গেছে বলেও জানা যায়। মিস্টার চৌধুরীর বিশ্লেষণ হলো, “আমাদের স্থানীয় বড় দুই দলের রাজনীতির ধারা কিন্তু এই তরুণদের আকর্ষণ করেনা। কেননা এদের মধ্যে কোনো আদর্শবাদ নাই। এদের যে রাজনীতি সেটা হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদল ক্ষমতায় আছে আরেকদল ক্ষমতায় যেতে চায়। এদের প্রতিদ্বন্দ্বীতা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীতা। এখন এই তরুণরা যে দুঃসাহসিক কাজ চায়, স্বপ্নের বাস্তবায়ন চায় এই জায়গাটাতেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে হোক বা গোপন পরামর্শের মাধ্যমে হোক তরুণরা ঐদিকে চলে যাচ্ছে। একটা অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে”।
এক্ষেত্রে পুলিশের কাছে কী তথ্য আছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “জঙ্গী চক্র তারা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, স্কুলে মেধাবী উচ্চবিত্তের ছেলেদেরকে বিভিন্ন ভাবে প্রলুব্ধ করে। প্রথমে কিছুদিন ইসলামের আল্লাহর কথা বলে, কোরান হাদিসের কথা বলে তাদের নামাজে অভ্যস্ত করে। এরপর ধীরে ধীরে তারা মাত্রা এবং সুযোগ বুঝে এ ধরনের উগ্র প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
পুলিশ কমিশনার বলেন, “বিভিন্ন নামে এই উগ্রবাদীরা তাদের কর্মকাণ্ড চালায়। কিন্তু এদের মূল সূত্র কিন্তু এক জায়গায়। সালাফিবাদ, ওয়াহিবিজম, উগ্রবাদ মওদুদীবাদ।”
গুলশান এবং শোলাকিয়া হামলাকারিরা ৩ থেকে ৭ মাস পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল। বাংলাদেশে ওই দুটি হামলার পর এখন অনেক তরুণের পরিবার তাদের সন্তান হারিয়ে যাওয়ার খবর দিচ্ছে।