দেশের অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার শাইখুল হাদিস ও নায়েবে মুহতামিম হাফেজ মাওলানা মুফতি আব্দুর রউফ সাহেব (ঢাকার হুজুর) ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।
বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টায় ইন্তেকাল করেন তিনি। একইদিন দুপুর ২টা ৩০মিনিটে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ময়দানে জানাজার নামাজ আদায় শেষে তাকে মাকবারায় শামছিয়াতে দাফন করা হয়। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের খতিব ও গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মুহতামিম আল্লামা রুহুল আমিন।
শাইখুল হাদিস মুফতি আব্দুর রউফ মৃত্যুকালে স্ত্রী ৪ ছেলে ৪ মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত, গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মাওলানা আব্দুর রউফ মুন্সীগঞ্জের (বিক্রমপুর) সিরাজদিখান উপজেলার বাহেরকুচি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৩৬ সালের ৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুল আজিজ, মায়ের নাম জোবায়দা খাতুন। তার পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন মোজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী ছদর ছাহেবর (রহ.) ভক্ত।
হজরত ছদর ছাহেবের (রহ.) পরামর্শে আব্দুর রউফকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময় মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। মাত্র দুই বছরে পবিত্র কুরআন হেফজ সম্পন্ন করেন তিনি। সেখানে কাফিয়া জামাত পর্যন্ত পড়ালেখা করেন এরপর ছদর ছাহেব (রহ.) তাকে ঢাকার জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসায় নিজের কাছে ভর্তি করেন। ছদর ছাহেবের (রহ.) নিবিড় পরিচর্যায় তিনি লালবাগ মাদ্রাসা থেকে দাওরায় হাদিস শেষ করেন।
লালবাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে আব্দুর রউফ হযরত ছদর ছাহেবের (রহ.) প্রতিষ্ঠিত মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায় পড়ানো শুরু করেন। শুরুর কিছু দিন পর ছদর ছাহেব (রহ.) তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য হজরত বিননূরীর (রহ.) কাছে চিঠি লিখে উলূমুল হাদিস পড়ার জন্য পাকিস্তান পাঠিয়ে দেন।
তখন বাংলাদেশের কোথাও উলুমুল হাদিস (উচ্চতর হাদিসশাস্ত্র) বিষয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল না। সদর সাহেব হুজুরের চিঠি হজরত বিননূরীকে (রহ.) দিলে কোনো ধরনের ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই মুফতি আব্দুর রউফকে ভর্তি করে নেন।
উলুমুল হাদিস পড়া শেষ হলে হজরত বিননূরী (রহ.) ছদর সাহেবের কাছে চিঠি লিখে তাকে পাঠিয়ে দেন। চিঠির ভাষ্য ছিল অনেকটা এমন, ‘এই ছেলের হাদিস পড়ানোর মতো পরিপূর্ণ যোগ্যতা অর্জন হয়েছে, তাকে আপনি হাদিসের কাজে লাগাতে পারেন।’
বাংলাদেশে আসার পর ছদর সাহেব হুজুর রহ. তাকে গওহরডাঙ্গা মাদসার উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই সময় থেকে ই তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় হাদিসের খেদমতে নিয়জিত ছিলেন।
হাফেজ মাওলানা মুফতি আব্দুর রউফ শায়খুল হাদিস হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় খেদমত করেন। এছাড়ও তিনি পঞ্চাশটিরও বেশি মাদ্রাসায় বোখারির দরস দিয়েছেন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ঢালকানগর মাদ্রাসা, মিরপুর জামেউল উলুম মাদ্রাসা, ফয়জুল উলুম মাদ্রাসা, সাইনবোর্ড মাদ্রাসা ও মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসা, জামিয়াতুস সুন্নাহ, রায়েরমহল মাদ্রাসা, রাজৈর মাদ্রাসা, গোপালগঞ্জ কোর্ট মসজিদ মাদ্রাসা, মেরী গোপিনাথপুর মাদ্রাসাসহ দক্ষিণ অঞ্চলের প্রায় সব বড় মাদ্রাসায় তিনি বোখারি শরিফ পড়িয়েছেন।
তার হাদিসের দরস ছিল খুবই সুন্দর। একজন শিক্ষক হিসেবে কথাবার্তা, চাল-চলন, যুক্তিপূর্ণ বিচার-বিশ্লেষণ ও নৈতিক গুণাবলির দ্বারা একটি আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, যা শিক্ষার্থীসহ সবার সামনে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
তার মৃত্যুতে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ মাওলানা মুফতি রুহুল আমিন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, মুফতি আব্দুর রউফের ইন্তকালে একজন অভিভাবক সহকর্মী হারালাম। তিনি আমার বাবা হজরত ছদর ছাহেবের (রহ.) খুব কাছের শিষ্য। খুব বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। সাবলীলভাবে হাদিসের দরস দিতেন। হাদিসের কঠিন কঠিন বিষয়গুলো খুব সহজভাবে উপস্থাপন করতেন, যাতে তালিবুল ইলমরা সহজেই বুঝে নিতেন। তার মৃত্যুতে হাদিসের দরসে গভীর শুণ্যতা সৃষ্টি হলো।
আরো শোক প্রকাশ করেছেন, গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম মুফতি উসামা আমীন, নাজেমে তা’লীমাত মুফতি নুরুল ইসলাম, গওহরডাঙ্গা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা শামছুল হক, খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা ঝিনাত আলী, গওহরডাঙ্গা বিভাগীয় জিম্মাদার মাওলানা আব্দুস সালাম, ঢাকা মহানগর জিম্মাদার, মাওলানা আজিজুর রহমান, ঢাকা বিভাগীয় সহকারী জিম্মাদার মুফতি অহিদুল আলম, তানজিমুল মুদাররিসিন বাংলাদেশের মাওলানা আতাউর রহমান, মুফতি মোহাম্মদ তাসনীম, মুফতি মোস্তফা কাসেম প্রমুখ।