ভাগ্য বলে এটাকেই। ব্রেক্সিট বিরোধী হয়েও এর শতভাগ ফায়দা তুললেন তিনি। কথায় বলে না, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। তেরেসা মে’র জন্য এটা পৌষ মাসই বলতে হবে। তার কাছেই যাচ্ছে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের চাবি। আজ সন্ধ্যায় নতুন এক ইতিহাস তৈরি হবে। তিনি হবেন মার্গারেট থ্যাচারের পর বৃটেনের ইতিহাসে দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী। ডেভিড ক্যামেরন ১০ ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সঙ্গে তার তিন সন্তান। ধারণা করা গিয়েছিল, আরো দুই মাস হয়তো ডাউনিং স্ট্রিটে থাকতে পারবেন। কিন্তু অ্যান্দ্রিয়া লিডসমের নাটকীয় ঘোষণায় সব তছনছ হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন তেরেসা মে’র অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও ফারাক ছিল অনেক বেশি। কিন্তু সোমবার আকস্মিকভাবে ঘোষণা দেন, তিনি আর প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে নেই। তখনই নিশ্চিত হয়ে যায়, তেরেসার ভাগ্য। তেরেসা মে ছয় বছর ধরে ক্যামেরন মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। ধীর-স্থির, নীতির প্রশ্নে আপসহীন তেরেসা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবেন সেটা কি তিনি ভেবেছিলেন? অবশ্য তার বান্ধবী বেনজির ভুট্টো ২৮ বছর আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০০৭ সালের ২৭শে ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় বৃটিশ কনজারভেটিভ এসোসিয়েশনের এক ডিস্কো পার্টিতে বেনজির ভুট্টো ফিলিপ মে’র সঙ্গে তেরেসার পরিচয় করে দিয়েছিলেন। সে থেকে প্রেম, তারপর পরিণয়। ব্যাংকার ফিলিপ মে রসিকতায় টইটম্বুর। তেরেসাই বা কম কিসে।
ব্রেক্সিটের ফল যদি উল্টো হতো তখন ক্যামেরনই থাকতেন ডাউনিং স্ট্রিটে। কিন্তু ৩ বছর বাকি থাকতেই ক্যামেরনকে পর্দার আড়ালে চলে যেতে হলো। নিজের অনেক পয়সা খরচ করে সামান্থা ক্যামেরন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের ফ্ল্যাটকে সাজিয়েছিলেন। তার হয়তো ধারণা ছিল, পুরো সময়টাই তিনি সেখানে থাকবেন। কিন্তু রাজনীতির খেলা। কখন যে ভূমিকম্প আসে, কখন যে আসে সাইক্লোন। ব্রেক্সিট ভূমিকম্প বৃটিশ রাজনীতিকে শুধু ওলটপালটই করেনি, অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। বরিস জনসন নায়ক থেকে খলনায়ক হয়েছেন, যুদ্ধে জয়ী হয়েও। মাইকেল গোভ নিজের হিসাবেই ভুল করেছিলেন। জর্জ অসবর্ন রাজনীতির দাবার খেলায় কখন যে হারিয়ে গেছেন। এটার খোঁজ কেউ রাখে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন অ্যান্দ্রিয়া লিডসম। সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেন। তেরেসা মে নিঃসন্তান, তাই তিনি যোগ্য নন। এটা বলে নিজেকে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। কিন্তু এটা তো বৃটিশ সভ্যতা, সমাজব্যবস্থা। কেউই এটাকে পছন্দ করেননি। প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে এ মন্তব্য তিনি প্রত্যাহার করেন। এবং এরপর তিনি পর্দার আড়ালে চলে যেতে বাধ্য হন। তেরেসা মে বলেছেন, তিনি এক চমৎকার বৃটেন গড়ে তুলবেন।
৫৯ বছর বয়স্ক তেরেসা প্রথম এমপি হন ১৯৯৭ সনে। ২০১০-এর মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্যামেরন। তিন বছর হাতে রেখে মে’র কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে যাচ্ছেন। তবে এ মে সে মে নয়। তিনি হচ্ছেন তেরেসা মে। টুইটার আর ফেসবুকের কারণে দুনিয়াতে কত কিছুই না ঘটে। তেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন শুনে টুইটারে অনেকেই বার্তা পাঠিয়েছেন মডেল কন্যা মে’কে। এটাও এক ধরনের আনন্দ। গত এক শতাব্দীতে বৃটেনে ২৪ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এরমধ্যে অর্ধেক বিনা নির্বাচনে। এ প্রশ্ন সামনে রেখে, লিবারেল ডেমোক্রেট ও লেবার পার্টির কোনো কোনো এমপি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ২০০৭ এর ঘটনা। তারা বলছেন, নতুন নির্বাচন দিতে হবে। গর্ডন ব্রাউন যখন টনি ব্লেয়ারের উত্তরসূরি হন, তখন ডেভিড ক্যামেরন এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু তেরেসা মে এ দাবি নাকচ করেছেন। ব্রেক্সিট নিয়েও তার অবস্থান আরো খোলাসা করেছেন। বলেছেন, জনরায় বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। সেটা এখন অতীত। আমাদেরকে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসতে হবেই। দ্বিতীয় গণভোটের দাবি তুলে কোনো লাভ নেই।
এক অস্থির সময়ে তেরেসা মে বৃটেনের হাল ধরতে যাচ্ছেন। তার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথম কাজ হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতি, অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনা। ইউউ থেকে বেরিয়ে আসার ছক তৈরি করা। দলের ভেতরেও নানামুখী তৎপরতা রয়েছে, এগুলো সামাল দেয়া। লাখ লাখ ইউরোপীয় অভিবাসীর মনে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনরায় গড়ে তোলা। তেরেসা মে’র প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘোষণায় কিছুটা চাঞ্চল্য এসেছে। পাউন্ডের দামেও তেজি ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এখানে স্মরণ করতেই হয়, ডেভিড ক্যামেরন তার ছয় বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক স্থিতি আর অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনেছিলেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অযথা বৃটেনকে জড়াননি। যেমনটা করেছিলেন, টনি ব্লেয়ার।