ঢাকা ০৮:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য-বাঁশ ও বেত শিল্প

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৪৫:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অগাস্ট ২০২৩
  • ১৫৫ বার

আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ জনপদ থেকে শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্পগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় প্লাষ্টিক পন্য বাজার দখল করায় বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের কদর কমে গেছে। ফলে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে গ্রামীণ এই কুটির শিল্পটি।

পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সঠিক পৃষ্টপোষকতার অভাবে অনেকেই এখন কুটির শিল্পের এ পেশা পরিবর্তন করেছেন। বংশ পরস্পরায় যারা এ পেশার সাথে এখনও জড়িয়ে রয়েছেন তাদের দিন কাটছে অর্ধহারে অনাহারে। বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে একসময় চাষ হতো বেত গাছ। বাড়ির পাশে কিংবা পরিত্যক্ত ভিটায় দেখা যেতো সাড়ি সাড়ি বাঁশ বাগান। এছাড়াও যত্রতত্রভাবে বাড়ির পাশে কিংবা ডোবারধারে হরহামেশাই চোখে পড়তো বেত গাছ। আর সে সময়গুলোতে গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থালি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতেন। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত প্রায় সবখানেই চোখে পড়তো বেতের তৈরী আসবাবপত্র। কালের বির্বতনে এখন বদলে গেছে সেইসব চিরচেনা দৃশ্য। বর্তমান সময়ে বাঁশ ও বেত শিল্প প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সবখানে বাজার দখল করে রেখেছে প্লাষ্টিকের তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির স্বরূপ।

একসময় বাকেরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের শত শত পরিবার বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন পন্য সামগ্রী তৈরির পর হাট ও বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন তাদের অধিকাংশরাই অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে উপজেলার পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নের কানকি বাজার সংলগ্ন শ্রীমন্ত নদীর পাশে এখনও দেখা যায় ১০টি পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কুটিরশিল্পে কাজ করছেন। তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পন্য সামগ্রী তৈরি করছেন।

পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রীর কদর বেড়ে যাওয়ার এসব কুটির শিল্পের চাহিদা এখন আর নেই বলে জানিয়েছেন প্রেম শ্রীকান্ত নামের এক কারিগর। তিনি আরও জানিয়েছেন, পর্যাপ্তহারে বাঁশ ও বেতের চাষ না হওয়ায় কাঁচামালের ঘাটতির কারণে বাঁশ ও বেতের পন্য তৈরিতে খরচ বাড়লেও বাড়েনি এসব পন্য সামগ্রীর দাম। তারপরেও বংশপরস্পরায় এখনও তারা ১০টি পরিবার এ কুটিশিল্পের সাথে জড়িত রয়েছেন। তারা এখন গ্রামীণ সাপ্তাহিক হাট ও বাজারগুলোতে বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি করা খোল, চাটাই, খলুই, ধামা, টোনা, পাল্লা, মোড়া, ঝুড়ি, ঝাড়নি, চালনসহ বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তারা শত শত বছরের প্রাচীণ এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারিভাবে পৃষ্টপোষকতার দাবি করেছেন।

বিলুপ্তির পথে বেত বাগান ॥ বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় একসময়ে বেত ঝাড় (বাগান) ছিলো অনেক। বেত দিয়ে বিভিন্ন সৌখিন সামগ্রী তৈরী করা হতো। সেই বেতের চাহিদা মেটাতে বেত ব্যবসায়ীদের পদচারণা ছিলো গ্রামগঞ্জে। নৌকাই ছিলো এদের বাহন। নৌকায় করে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেত সংগ্রহ করাই ছিলো তাদের কাজ। বেত কিনে বাগানেই বেতের উপরের কাটা যুক্ত খোসা ছাড়িয়ে নৈৗকায় নিয়ে জমা করতেন। সুযোগ বুঝে ফাঁকা মাঠে রোদে শুকিয়ে বেতের শৌখিন ফার্নিচার তৈরী ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরীর কারখানায় মণ হিসেবে বিক্রি করতেন ওইসব বেত ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেইধরনের বেত না থাকায় গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেত ক্রয় করা ব্যবসায়ীরা এখন অন্য পেশায় গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

বেতগাছ সাধারণত গ্রামের রাস্তার পাশে, বসতবাড়ির পেছনে, পতিত জমিতে ও বনে কিছুটা আর্দ্র জায়গায় জন্মে। কিছুদিনের মধ্যেই বেত ঘণ হয়ে ঝাড়ে পরিণত হয়। বেতগাছ জঙ্গলাকীর্ন কাঁটাঝোপ আকারে দেখা যায়। বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়াও হাওরের কান্দাতে বেতগাছ জন্মে। চিরসবুজ এই উদ্ভিদটি পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট এবং কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। শুকনো বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প জাতীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। যেমন-চেয়ার, টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গারী, মুড়া, ঢুষি, হাতপাখা, চালোন, টোকা, গোলা, ডোল, ডুলা, আউডি, চাঁচ, ধামা, পাতি, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা, খাট, ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি। বেত গৃহনির্মাণ কাজেও ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে রেস্তোরাঁ, ঘর বা অফিসের শৌখিন পার্টিশন হিসেবে একসময় বেতের ব্যাপক ব্যবহার হতো। কালের বির্বতনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গৃহস্থলি কাজের নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য সামগ্রীর বাজার দখল করেছে বিভিন্ন কোম্পানীর প্লাষ্টিক সামগ্রী। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। আর এ কারণেই বরিশাল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বেতঝাড়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশালের এক বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বেত চাষের জন্য বন বিভাগ থেকে বরাদ্দ থাকলেও বরিশালের জন্য কোন বরাদ্দ আসেনা। বেত চাষের জন্য বরাদ্দ আসলে বরিশালে বেতকে আরো সম্প্রসারিত করা সম্ভব হতো।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য-বাঁশ ও বেত শিল্প

আপডেট টাইম : ০৫:৪৫:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অগাস্ট ২০২৩

আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ জনপদ থেকে শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্পগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় প্লাষ্টিক পন্য বাজার দখল করায় বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের কদর কমে গেছে। ফলে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে গ্রামীণ এই কুটির শিল্পটি।

পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সঠিক পৃষ্টপোষকতার অভাবে অনেকেই এখন কুটির শিল্পের এ পেশা পরিবর্তন করেছেন। বংশ পরস্পরায় যারা এ পেশার সাথে এখনও জড়িয়ে রয়েছেন তাদের দিন কাটছে অর্ধহারে অনাহারে। বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে একসময় চাষ হতো বেত গাছ। বাড়ির পাশে কিংবা পরিত্যক্ত ভিটায় দেখা যেতো সাড়ি সাড়ি বাঁশ বাগান। এছাড়াও যত্রতত্রভাবে বাড়ির পাশে কিংবা ডোবারধারে হরহামেশাই চোখে পড়তো বেত গাছ। আর সে সময়গুলোতে গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থালি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতেন। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত প্রায় সবখানেই চোখে পড়তো বেতের তৈরী আসবাবপত্র। কালের বির্বতনে এখন বদলে গেছে সেইসব চিরচেনা দৃশ্য। বর্তমান সময়ে বাঁশ ও বেত শিল্প প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সবখানে বাজার দখল করে রেখেছে প্লাষ্টিকের তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির স্বরূপ।

একসময় বাকেরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের শত শত পরিবার বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন পন্য সামগ্রী তৈরির পর হাট ও বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন তাদের অধিকাংশরাই অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে উপজেলার পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নের কানকি বাজার সংলগ্ন শ্রীমন্ত নদীর পাশে এখনও দেখা যায় ১০টি পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কুটিরশিল্পে কাজ করছেন। তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পন্য সামগ্রী তৈরি করছেন।

পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রীর কদর বেড়ে যাওয়ার এসব কুটির শিল্পের চাহিদা এখন আর নেই বলে জানিয়েছেন প্রেম শ্রীকান্ত নামের এক কারিগর। তিনি আরও জানিয়েছেন, পর্যাপ্তহারে বাঁশ ও বেতের চাষ না হওয়ায় কাঁচামালের ঘাটতির কারণে বাঁশ ও বেতের পন্য তৈরিতে খরচ বাড়লেও বাড়েনি এসব পন্য সামগ্রীর দাম। তারপরেও বংশপরস্পরায় এখনও তারা ১০টি পরিবার এ কুটিশিল্পের সাথে জড়িত রয়েছেন। তারা এখন গ্রামীণ সাপ্তাহিক হাট ও বাজারগুলোতে বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি করা খোল, চাটাই, খলুই, ধামা, টোনা, পাল্লা, মোড়া, ঝুড়ি, ঝাড়নি, চালনসহ বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তারা শত শত বছরের প্রাচীণ এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারিভাবে পৃষ্টপোষকতার দাবি করেছেন।

বিলুপ্তির পথে বেত বাগান ॥ বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় একসময়ে বেত ঝাড় (বাগান) ছিলো অনেক। বেত দিয়ে বিভিন্ন সৌখিন সামগ্রী তৈরী করা হতো। সেই বেতের চাহিদা মেটাতে বেত ব্যবসায়ীদের পদচারণা ছিলো গ্রামগঞ্জে। নৌকাই ছিলো এদের বাহন। নৌকায় করে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেত সংগ্রহ করাই ছিলো তাদের কাজ। বেত কিনে বাগানেই বেতের উপরের কাটা যুক্ত খোসা ছাড়িয়ে নৈৗকায় নিয়ে জমা করতেন। সুযোগ বুঝে ফাঁকা মাঠে রোদে শুকিয়ে বেতের শৌখিন ফার্নিচার তৈরী ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরীর কারখানায় মণ হিসেবে বিক্রি করতেন ওইসব বেত ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেইধরনের বেত না থাকায় গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেত ক্রয় করা ব্যবসায়ীরা এখন অন্য পেশায় গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

বেতগাছ সাধারণত গ্রামের রাস্তার পাশে, বসতবাড়ির পেছনে, পতিত জমিতে ও বনে কিছুটা আর্দ্র জায়গায় জন্মে। কিছুদিনের মধ্যেই বেত ঘণ হয়ে ঝাড়ে পরিণত হয়। বেতগাছ জঙ্গলাকীর্ন কাঁটাঝোপ আকারে দেখা যায়। বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়াও হাওরের কান্দাতে বেতগাছ জন্মে। চিরসবুজ এই উদ্ভিদটি পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট এবং কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। শুকনো বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প জাতীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। যেমন-চেয়ার, টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গারী, মুড়া, ঢুষি, হাতপাখা, চালোন, টোকা, গোলা, ডোল, ডুলা, আউডি, চাঁচ, ধামা, পাতি, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা, খাট, ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি। বেত গৃহনির্মাণ কাজেও ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে রেস্তোরাঁ, ঘর বা অফিসের শৌখিন পার্টিশন হিসেবে একসময় বেতের ব্যাপক ব্যবহার হতো। কালের বির্বতনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গৃহস্থলি কাজের নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য সামগ্রীর বাজার দখল করেছে বিভিন্ন কোম্পানীর প্লাষ্টিক সামগ্রী। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। আর এ কারণেই বরিশাল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বেতঝাড়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশালের এক বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বেত চাষের জন্য বন বিভাগ থেকে বরাদ্দ থাকলেও বরিশালের জন্য কোন বরাদ্দ আসেনা। বেত চাষের জন্য বরাদ্দ আসলে বরিশালে বেতকে আরো সম্প্রসারিত করা সম্ভব হতো।