চার দশক ধরে আটকে থাকা সীমান্ত সমস্যার সমাধান করতে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পুরনো জঞ্জাল সরিয়ে ফেলল প্রতিবেশী দুই দেশ- বাংলাদেশ ও ভারত। চুক্তির অনুসমর্থনের ফাইলপত্রও হস্তান্তর হলো। সেই সঙ্গে নতুন করে খুলে গেল কানেকটিভিটি বা আঞ্চলিক যোগাযোগের দুয়ারও। নতুন করে ২২টি বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হলো ঢাকা ও দিল্লি। ভারতীয় বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশে স্থাপন হতে যাচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ভারত দিচ্ছে নতুন করে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০২১ ও ২০৪১ সাল পর্যন্ত নেওয়া রূপকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতার ঘোষণাও এসেছে প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানের কাছ থেকে। সবই হয়েছে ভারতের ক্যারিশমেটিক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গতকাল থেকে শুরু হওয়া দুই দিনের ঢাকা সফরে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সব সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একমাত্র কাঁটা তিস্তা চুক্তিও শিগগিরই স্বাক্ষর সম্ভব হবে বলে প্রকাশ্যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নরেন্দ্র মোদি। এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের এক নতুন বন্ধন সৃষ্টি হলো। এই বন্ধন নিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নতুন মাইলফলক গড়তে যাচ্ছে প্রতিবেশী দুই দেশ।
দিল্লির ক্ষমতায় আসার এক বছর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল সকালে প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে আসেন। ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভারতের জনগণের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিয়ে সফরে এসেছেন তিনি। সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে ঢাকায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকায় নেমেই সাভারে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। সাভার থেকে সরাসরি যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন পরিদর্শনে। গতকাল কয়েক দফায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন নরেন্দ্র মোদি। ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরও বার বার ফিরে তাকান। বঙ্গবন্ধুকে গণতন্ত্রের মূর্তপ্রতীক হিসেবে অভিহিত করে টুইট করেন। আবার ভাষণেও বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন গভীর শ্রদ্ধায়। ৩২ নম্বর থেকে ফিরে মোদি হোটেল সোনারগাঁওয়ে অবস্থান নেন। তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আগের রাতে ঢাকায় আসা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। পরে মমতাকে সঙ্গে নিয়ে মোদি যান তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রথমেই দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস চলাচল উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি ও মমতা ব্যানার্জি। ঐতিহাসিকভাবে চালু হয় ঢাকা-শিলং এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা সরাসরি বাস সার্ভিস। এরপরই শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি ও মমতা ব্যানার্জি নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও চা চক্রে মিলিত হন। আলোচনা হয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ইস্যুতে। চা চক্র শেষেই ঐতিহাসিক সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা ও কার্যপদ্ধতি বিনিময় করে বাংলাদেশ ও ভারত। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির স্বাক্ষর করা এই স্থলসীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল বিনিময় করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর। এর মাধ্যমে অবরুদ্ধ জীবন কাটানো হাজারো মানুষের মুক্তির পথ আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে যায়। দুই প্রধানমন্ত্রী পরে নিজেদের মধ্যে একান্তে কথা বলেন প্রায় ৩০ মিনিট। একান্ত বৈঠক শেষেই শুরু হয় দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার। বিপরীতে ভারতের পক্ষে মোদির নেতৃত্বে ছিলেন সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রায় সব ইস্যু নিয়েই আলোচনা হয়। ৫১ এজেন্ডার এ বৈঠকে উঠে আসে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণার সহযোগিতার প্রসঙ্গও। বৈঠকের পরই স্বাক্ষর হয় দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি, প্রটোকল, সমঝোতা স্মারক ও বিনিময়পত্র। দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুই দেশের প্রতিনিধিরা এসব চুক্তি-সমঝোতা কপি হস্তান্তর করেন। পরে দুই প্রধানমন্ত্রী চারটি স্মারকও বিনিময় করেন নিজেদের মাঝে। রাতে হোটেল সোনারগাঁওয়ে মোদির সম্মানে প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই ছিল গতকালের শেষ কর্মর্সূচি।
যেসব চুক্তি স্বাক্ষর হলো : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করতে গতকাল ২২টি চুক্তি, প্রটোকল, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে আছে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির ও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর, সীমান্ত চুক্তি ও প্রটোকল বাস্তবায়নের কার্যপদ্ধতির চিঠি হস্তান্তর, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির নবায়ন, বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের প্রটোকল নবায়ন, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বিএসটিআই-বিআইএসের সহযোগিতা বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চুক্তি ও প্রটোকল, কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চুক্তি ও প্রটোকল, দুই দেশের কোস্টগার্ডের সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক, মানব পাচার প্রতিরোধে সমঝোতা স্মারক, চোরাচালান ও জাল মুদ্রা প্রতিরোধে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকারের নতুন দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার এলওসি ঋণ দিতে সমঝোতা স্মারক, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক অর্থনীতি ও মেরিটাইম সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে সমঝোতা স্মারক, সার্কের অধীনে থাকা আইইসিসির অধীনে জলবায়ু বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশে ভারতের বিশেষ অর্থনৈতিক জোন স্থাপনে সমঝোতা স্মারক, ২০১৫-২০১৭ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিনিময়ে সম্মতিপত্র, শিক্ষা বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতার বিবৃতি গ্রহণ, আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ লিজিংয়ে বাংলাদেশের বিএসসিসিএল ও বিএসএনএলের মধ্যে চুক্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের কাউন্সিল অব সায়েন্টেফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের অধীনে সামুদ্রিক গবেষণায় সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সমঝোতা স্মারক এবং বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা চালু করতে বাংলাদেশের আইডিআরএ ও ভারতের এলআইসির মধ্যে বিনিময়পত্র হস্তান্তর।
মানচিত্র পেল স্থায়ী রূপ, মুক্তি মিলল ছিটমহলের : প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ‘শাপলা’ কক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুসমর্থনের দলিল এবং সীমান্ত চুক্তি ও প্রটোকল বাস্তবায়নের কার্যপদ্ধতির চিঠি হস্তান্তর করেন দুই পররাষ্ট্র সচিব। উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। এর মাধ্যমেই মুক্তির পথ খুলল ছিটমহলের মানুষের। চিহ্নিত হচ্ছে অচিহ্নিত সীমান্ত। ফিরে আসছে অপদখলীয় জমি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র পেল স্থায়ী রূপ। উত্তরাধিকারসূত্রে ভারতের স্থলসীমান্ত নিয়ে এ সমস্যাটি পেয়েছিল বাংলাদেশ। অবিভক্ত ভারতের অংশ থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ সমস্যার অবসানে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়। এর আওতায় ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশের দিক থেকে সব প্রক্রিয়া সারা হলেও তা আটকে ছিল ভারতের দিকে। কারণ, ভূমি ছাড়তে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে ২০১১ সালে ভারতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধানে দুই দেশের মধ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। কংগ্রেস সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও তার মধ্যেই নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে ক্ষমতায় আসেন বিজেপির মোদি। সীমান্ত সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন তিনি। ছিটমহল বিনিময়ে আপত্তি জানানো ভারতের আঞ্চলিক দলগুলোকেও রাজি করান। গত মে মাসে ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত বিল নামে পরিচিতি পাওয়া সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়ার পর তাতে অনুসমর্থন জানায় সে দেশের মন্ত্রিসভা। পরে সেখানে স্বাক্ষর করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। এরপর গতকালের আনুষ্ঠানিকতা।
তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে আত্মবিশ্বাসী মোদি : অভিন্ন তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে নিজের আত্মবিশ্বাসের কথা জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। গতকাল আনুষ্ঠানিক ভাষণে বলেন, ‘ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর সমর্থন নিয়ে তিস্তা ও ফেনী নদীর বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরে একটি স্বচ্ছ সমাধানে পৌঁছতে পারব বলে আমি আত্মবিশাসী। সেই সঙ্গে আমাদের নদীগুলো পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়েও কাজ করা প্রয়োজন।’
২০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ : বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার লাইন অব ক্রেডিট ঋণ দিয়েছে ভারত। দুই দেশের সরকারের মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে। গতকাল তার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে দেওয়া হতে পারে। এ অর্থ বাংলাদেশের সড়ক, নৌ ও রেল পথের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে। অনুদানের অর্থ ব্যয় হতে পারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। এর আগে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। তার অধীনে ১৫ প্রকল্পের সাতটিই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন। সেখানেও ২০ কোটি মার্কিন ডলার রাখা হয়েছিল অনুদান হিসেবে।
আজকের কর্মসূচি : আজ সফরের দ্বিতীয় ও শেষ দিনে সকাল ৮টা ৪০ থেকে ৯টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ঢাকেশ্বরী মন্দিরে থাকবেন মোদি। এরপর যাবেন রামকৃষ্ণ মিশনে। ১০টা ১০ মিনিট থেকে ১০টা ৩৫ পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যানসারি ভবনের উদ্বোধন করবেন। বেলা ১টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন মোদি। সেখানেই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে দেওয়া সম্মাননাপত্র গ্রহণ করবেন তিনি। তারপর পর্যায়ক্রমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সোনারগাঁও হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ওয়ার্কার্স পার্টি, শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন এফবিসিসিআই। সন্ধ্যায় ভারতীয় হাইকমিশনের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জনসমক্ষে ভাষণ দেবেন মোদি। রাত ৮টার দিকে দুই দিনের সফর শেষে তিনি ঢাকা ছাড়বেন।