ঢাকা ০৭:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ২৩ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃষির পাশাপাশি কৃষকের জীবনেরও উন্নতি হোক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৭:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ২৪৭ বার

ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম: একদা যুদাস নামে এক লোক যিশুখ্রিষ্টের সঙ্গে ডিনারে অংশ নিয়েছিল। একই টেবিলে ১৩ নম্বর চেয়ারে বসা ওই লোকটিই যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আর তখন থেকেই ১৩ সংখ্যাটিকে পশ্চিমা দেশগুলোর যিশুপ্রেমীরা দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করে। মনোবিজ্ঞানীরা এ সংখ্যাটিকে ‘থার্টিন ডিজিট ফোবিয়া’ হিসাবে অভিহিত করেন। তবে বিষয়টির পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি না থাকায় নেটিজেনরা এটিকে কুসংস্কার বলেই মনে করেন। সত্যিই তাই, এটি একটি কুসংস্কারই। কারণ এ সংখ্যার সঙ্গে অনেক সৌভাগ্যের বিষয়ও জড়িত রয়েছে। যেমন-‘কৃষিবিদ দিবস’। দিবসটির সঙ্গে ১৩ সংখ্যার সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এতে নেই কোনো দুর্ভাগ্যের ছোঁয়া, বরং রয়েছে সৌভাগ্যের পরশ।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। ৫০ বছর আগে স্বাধীনতার মহান স্থপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের মর্যাদাকে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ মো. নজিবুর রহমান (সাবেক সহ-সভাপতি, বাকসু ও সাবেক রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ও খ্যাতনামা কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের (সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাকসু) নেতৃত্বাধীন বাকসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর পদচারণায় ধন্য হয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের কূলঘেঁষা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সবুজ চত্বর। বাকৃবির শিক্ষক, বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত কৃষিবিদ, কৃষি শিক্ষার্থীসহ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সরকারি চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের মর্যাদাকে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন, যা পরে তিনি ঢাকায় ফিরে কার্যকর করেন। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের উদ্যোগে ১৩ ফেব্রুয়ারিকে প্রতিবছর ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। সোমবারও দিবসটি পালিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

ছাত্রাবস্থায় বাকৃবি চত্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বন্ধুদের কণ্ঠ থেকে যে স্লোগানগুলো আমার কানে ভেসে আসত, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল-‘বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’, যা আজও বাকৃবি ও অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরকে মুখরিত করে তোলে। জয় বাংলা যেমন এদেশের জাতীয় স্লোগান, ঠিক তেমনই ওই স্লোগানটিও এদেশের কৃষিবিদদের জাতীয় স্লোগান। ১৩ ফেব্রুয়ারি কেবল কৃষিবিদদের মর্যাদার দিবসই নয়, বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার প্রাথমিক পদক্ষেপ, যার সুফল ৫০ বছর পর আজ এদেশের জনগণ ভোগ করছে।

কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ কৃষিবিদ এবং তাদের পেশাগত উন্নয়ন। যদি একই মানের পড়াশোনা করে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়াররা প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায়, তাহলে কৃষিবিদরাও প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার যৌক্তিক দাবিদার। কৃষিবিদদের এ দাবির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সহমত পোষণ করেছিলেন এবং দিয়েছিলেন তাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা। কৃষিবিদদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণি থাকার কারণে ১৯৭৩ সালের আগে বাকৃবিতে মেধাবীরা ভর্তির জন্য খুব বেশি আগ্রহ দেখাত না। এমনও সময় ছিল, বাকৃবির শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয় শিক্ষার্থী খুঁজতে বের হতেন। শিক্ষকদের বাড়িতে প্রবেশের খবর পেয়ে ভালো ফলাফলধারী শিক্ষার্থীরা বাড়ির পেছন গেট দিয়ে পালিয়ে যেত। ওই সময় বাকৃবি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে যে পরিমাণ শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করত, তা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা বাড়িতেও পাঠানো যেত। এরপরও শুধু মর্যাদা সংকটের কারণে বাকৃবিতে ভালো ফলাফলধারী শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া ছিল কষ্টকর।

১৯৭৩ সালে যখন কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করা হলো, ঠিক সেবছর থেকেই বাকৃবিতে শুরু হয় তীব্র ভর্তি প্রতিযোগিতা। একই মানের শিক্ষার্থী, যারা মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অতি সামান্য ব্যবধানে ভর্তির সুযোগ পেত না, তাদের কাছে বাকৃবি ছিল ভর্তির জন্য প্রথম পছন্দের কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়। আর বর্তমানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি প্রতিযোগিতার সংবাদ শিক্ষিত পরিবারে সম্ভবত কারও অজানা নয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন কেবলই মেধাবী শিক্ষার্থীদের মিলন মেলা। নিঃসন্দেহে এটি কৃষিবিদ দিবসের অনেক বড় প্রাপ্তি।

কৃষিবিদরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন : শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত থেকে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রমাণ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন। সাম্প্রতিক সময়ের অত্যন্ত মেধাবী কৃষিবিদরা বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি যেমন : জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, টিস্যু কালচার, জিএমও ফুড, জিনোম এডিটিং, আইপিএম ইত্যাদি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নিত্যনতুন কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন, যা ফসলের উৎপাদন ও সংরক্ষণে ব্যবহার হচ্ছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে বাংলাদেশের যত অর্জন, সেগুলোর মধ্যে কৃষিজ উৎপাদন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ এবং জিডিপিতে এর অবদান ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।

১৯৭৩ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ২০২৩ সালের অর্ধেকেরও কম। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ অনেক বেশি থাকার পরও মেধাবীদের কৃষি খাতে অনাগ্রহের কারণে খাদ্য উৎপাদন ছিল কম এবং খাদ্য সংকট ছিল অনেক বেশি। ‘সমৃদ্ধির জন্য ধান’-এ স্লোগানকে ধারণ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিবিদ-বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে চলেছেন নিত্যনতুন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত, যার সুবাদে দেশ এখন দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং ফল উৎপাদনে দশম স্থানে রয়েছে। এছাড়া পোলট্রি ও ডেইরি সেক্টরের অভূতপূর্ব উন্নয়ন এবং এর সুফল সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। এ পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট যে, কৃষিবিদদের মর্যাদা প্রদানে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত ছিল যুক্তিযুক্ত। আর কৃষিবিদরাও ওই সম্মান-মর্যাদা রক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’ তথা ‘সোনার বাংলা’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

কৃষিবিদদের উদ্ভাবিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এদেশে কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে এখনো বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো। প্রচলিত যে বাজারব্যবস্থা রয়েছে, তাতে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য আড়তদার এবং খুচরা বিক্রেতা হয়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। এতে কৃষক যে মূল্য পায়, তা অনেক ফসলের ক্ষেত্রেই উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। কৃষিজীবী পরিবারগুলো বংশপরম্পরায় কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় তারা লাভ-ক্ষতির কথা বিবেচনা না করেই সর্বদা কৃষিকাজে সম্পৃক্ত রয়েছে, আর লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বগুড়ায় কৃষকের কাছ থেকে ক্রয়কৃত পাঁচ টাকা মূল্যের ফুলকপি ঢাকায় ভোক্তা ক্রয় করে ত্রিশ টাকায়; মাঝে পঁচিশ টাকাই কোনো না কোনোভাবে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নেয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা আশু প্রয়োজন। এবার কৃষিবিদ দিবসের স্লোগান ছিল ‘যারা জোগায় ক্ষুধার অন্ন-আমরা আছি তাদের জন্য’। ভোক্তার ক্রয় খরচ না বাড়িয়ে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক বা যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করাই হোক সবার অঙ্গীকার।

কৃষিবিদ ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন স্কুল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

islamtuhin@yahoo.com

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কৃষির পাশাপাশি কৃষকের জীবনেরও উন্নতি হোক

আপডেট টাইম : ১২:৪৭:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম: একদা যুদাস নামে এক লোক যিশুখ্রিষ্টের সঙ্গে ডিনারে অংশ নিয়েছিল। একই টেবিলে ১৩ নম্বর চেয়ারে বসা ওই লোকটিই যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আর তখন থেকেই ১৩ সংখ্যাটিকে পশ্চিমা দেশগুলোর যিশুপ্রেমীরা দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করে। মনোবিজ্ঞানীরা এ সংখ্যাটিকে ‘থার্টিন ডিজিট ফোবিয়া’ হিসাবে অভিহিত করেন। তবে বিষয়টির পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি না থাকায় নেটিজেনরা এটিকে কুসংস্কার বলেই মনে করেন। সত্যিই তাই, এটি একটি কুসংস্কারই। কারণ এ সংখ্যার সঙ্গে অনেক সৌভাগ্যের বিষয়ও জড়িত রয়েছে। যেমন-‘কৃষিবিদ দিবস’। দিবসটির সঙ্গে ১৩ সংখ্যার সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এতে নেই কোনো দুর্ভাগ্যের ছোঁয়া, বরং রয়েছে সৌভাগ্যের পরশ।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। ৫০ বছর আগে স্বাধীনতার মহান স্থপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের মর্যাদাকে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ মো. নজিবুর রহমান (সাবেক সহ-সভাপতি, বাকসু ও সাবেক রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ও খ্যাতনামা কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের (সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাকসু) নেতৃত্বাধীন বাকসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর পদচারণায় ধন্য হয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের কূলঘেঁষা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সবুজ চত্বর। বাকৃবির শিক্ষক, বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত কৃষিবিদ, কৃষি শিক্ষার্থীসহ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সরকারি চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের মর্যাদাকে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন, যা পরে তিনি ঢাকায় ফিরে কার্যকর করেন। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের উদ্যোগে ১৩ ফেব্রুয়ারিকে প্রতিবছর ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। সোমবারও দিবসটি পালিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

ছাত্রাবস্থায় বাকৃবি চত্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বন্ধুদের কণ্ঠ থেকে যে স্লোগানগুলো আমার কানে ভেসে আসত, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল-‘বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’, যা আজও বাকৃবি ও অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরকে মুখরিত করে তোলে। জয় বাংলা যেমন এদেশের জাতীয় স্লোগান, ঠিক তেমনই ওই স্লোগানটিও এদেশের কৃষিবিদদের জাতীয় স্লোগান। ১৩ ফেব্রুয়ারি কেবল কৃষিবিদদের মর্যাদার দিবসই নয়, বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার প্রাথমিক পদক্ষেপ, যার সুফল ৫০ বছর পর আজ এদেশের জনগণ ভোগ করছে।

কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ কৃষিবিদ এবং তাদের পেশাগত উন্নয়ন। যদি একই মানের পড়াশোনা করে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়াররা প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায়, তাহলে কৃষিবিদরাও প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার যৌক্তিক দাবিদার। কৃষিবিদদের এ দাবির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সহমত পোষণ করেছিলেন এবং দিয়েছিলেন তাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা। কৃষিবিদদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণি থাকার কারণে ১৯৭৩ সালের আগে বাকৃবিতে মেধাবীরা ভর্তির জন্য খুব বেশি আগ্রহ দেখাত না। এমনও সময় ছিল, বাকৃবির শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয় শিক্ষার্থী খুঁজতে বের হতেন। শিক্ষকদের বাড়িতে প্রবেশের খবর পেয়ে ভালো ফলাফলধারী শিক্ষার্থীরা বাড়ির পেছন গেট দিয়ে পালিয়ে যেত। ওই সময় বাকৃবি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে যে পরিমাণ শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করত, তা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা বাড়িতেও পাঠানো যেত। এরপরও শুধু মর্যাদা সংকটের কারণে বাকৃবিতে ভালো ফলাফলধারী শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া ছিল কষ্টকর।

১৯৭৩ সালে যখন কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করা হলো, ঠিক সেবছর থেকেই বাকৃবিতে শুরু হয় তীব্র ভর্তি প্রতিযোগিতা। একই মানের শিক্ষার্থী, যারা মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অতি সামান্য ব্যবধানে ভর্তির সুযোগ পেত না, তাদের কাছে বাকৃবি ছিল ভর্তির জন্য প্রথম পছন্দের কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়। আর বর্তমানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি প্রতিযোগিতার সংবাদ শিক্ষিত পরিবারে সম্ভবত কারও অজানা নয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন কেবলই মেধাবী শিক্ষার্থীদের মিলন মেলা। নিঃসন্দেহে এটি কৃষিবিদ দিবসের অনেক বড় প্রাপ্তি।

কৃষিবিদরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন : শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত থেকে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রমাণ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন। সাম্প্রতিক সময়ের অত্যন্ত মেধাবী কৃষিবিদরা বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি যেমন : জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, টিস্যু কালচার, জিএমও ফুড, জিনোম এডিটিং, আইপিএম ইত্যাদি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নিত্যনতুন কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন, যা ফসলের উৎপাদন ও সংরক্ষণে ব্যবহার হচ্ছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে বাংলাদেশের যত অর্জন, সেগুলোর মধ্যে কৃষিজ উৎপাদন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ এবং জিডিপিতে এর অবদান ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।

১৯৭৩ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ২০২৩ সালের অর্ধেকেরও কম। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ অনেক বেশি থাকার পরও মেধাবীদের কৃষি খাতে অনাগ্রহের কারণে খাদ্য উৎপাদন ছিল কম এবং খাদ্য সংকট ছিল অনেক বেশি। ‘সমৃদ্ধির জন্য ধান’-এ স্লোগানকে ধারণ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিবিদ-বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে চলেছেন নিত্যনতুন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত, যার সুবাদে দেশ এখন দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং ফল উৎপাদনে দশম স্থানে রয়েছে। এছাড়া পোলট্রি ও ডেইরি সেক্টরের অভূতপূর্ব উন্নয়ন এবং এর সুফল সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। এ পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট যে, কৃষিবিদদের মর্যাদা প্রদানে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত ছিল যুক্তিযুক্ত। আর কৃষিবিদরাও ওই সম্মান-মর্যাদা রক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’ তথা ‘সোনার বাংলা’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

কৃষিবিদদের উদ্ভাবিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এদেশে কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে এখনো বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো। প্রচলিত যে বাজারব্যবস্থা রয়েছে, তাতে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য আড়তদার এবং খুচরা বিক্রেতা হয়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। এতে কৃষক যে মূল্য পায়, তা অনেক ফসলের ক্ষেত্রেই উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। কৃষিজীবী পরিবারগুলো বংশপরম্পরায় কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় তারা লাভ-ক্ষতির কথা বিবেচনা না করেই সর্বদা কৃষিকাজে সম্পৃক্ত রয়েছে, আর লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বগুড়ায় কৃষকের কাছ থেকে ক্রয়কৃত পাঁচ টাকা মূল্যের ফুলকপি ঢাকায় ভোক্তা ক্রয় করে ত্রিশ টাকায়; মাঝে পঁচিশ টাকাই কোনো না কোনোভাবে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নেয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা আশু প্রয়োজন। এবার কৃষিবিদ দিবসের স্লোগান ছিল ‘যারা জোগায় ক্ষুধার অন্ন-আমরা আছি তাদের জন্য’। ভোক্তার ক্রয় খরচ না বাড়িয়ে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক বা যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করাই হোক সবার অঙ্গীকার।

কৃষিবিদ ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন স্কুল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

islamtuhin@yahoo.com