হাওর বার্তা ডেস্কঃ যুদ্ধাপরাধী ও তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বানে আর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার ১০ বছর আজ (৫ ফেব্রুয়ারি)। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জোরদার ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে গণমানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে দারুণ অবদান ছিল ওই মঞ্চের।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর একদল প্রতিবাদী তরুণ শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে তার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাতে শুরু করে, যা পরে স্বতঃস্ফূর্ত একটি আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর একের পর এক শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়।
২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রথমে শাহবাগে দাঁড়িয়ে যারা এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তাদেরই একজন ব্লগার আরিফ জেবতিক। এক দশক পর এসে তিনি মনে করেন শাহবাগ আন্দোলন শতভাগ ও পূর্ণাঙ্গ সফল একটি আন্দোলন।
আরিফ জেবতিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: গণ জাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শতভাগ ও পূর্ণাঙ্গ সফল একটি আন্দোলন। আমাদের মূল দাবি ছিলো একটিই – যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং সেটি কার্যকর হয়েছে। আমরা দাঁড়িয়েছিলাম একটি মাত্র দাবিতে তা হলো কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং তাদের বিচার সংক্রান্ত আইনের সংশোধন। তা আমরা অর্জন করেছি। এখানে ব্যর্থতার সুযোগই নেই।
৯০ দশকে যুদ্ধাপরাধীরে বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনটি ছিল আরও বড়, আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক, আরও বেশি কার্যকর। এই আন্দোলনের পরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসি থেকে বেঁচে যাওয়া জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে কুখ্যাত আরও বেশ কয়েকজন মানবতাবিরোধীর।
সারা ঢাকা শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসতে থাকে শাহবাগে, একটাই দাবি, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই।’ যে তরুণ-তরুণীরা কখনও রাজপথে এসে দাবি জানায়নি, তাদের মুখে দাবির স্লোগান শুনে এগিয়ে আসে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলো।
ধীরে ধীরে শাহবাগ হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার শক্তি হিসেবে। এর আগ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ করার দাবিতে জামায়াত-শিবির চক্র দেশজুড়ে নাশতকা-সহিংসতার ঝড় বইয়ে দিচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও হচ্ছিল ব্যাপক হামলা। কয়েকজনকে হত্যাও করে তারা। কিন্তু শাহবাগে জনতার প্রতিরোধে থমকে যায় তারাও। আর এই আন্দোলন কেবল ঢাকায় থেমে থাকেনি। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ছড়িয়ে যায় দেশের প্রতিটি শহরে। সব জায়গা থেকে একসঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই।’
গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম আগের মতো নেই কেন এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ জেবতিক বলেন: গণজাগরণ মঞ্চের কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম যতো দ্রুত ত্বরাণিত হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম ততো সীমিত হয়েছে।
আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ব্যবস্থা করে জাতীয় সংসদ। আর আপিলের রায়ে সর্বোচ্চ আদালত ফাঁসির দণ্ড দেয় কাদের মোল্লাকে।
এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় একে একে ফাঁসিতে ঝুলেছে জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী। আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। আর আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করার সময় মারা গেছেন গোলাম আযম, আবদুল আলীম।
তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এটা ধারাবাহিক সংগ্রামের বিষয়। আমাদের যে আকাঙ্খা ছিল সেটা পূর্ণ হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের এই আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে। যদি বড় অর্জনের কথা বলি আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম তার চূড়ান্ত ফসল ছিল গণজাগরণ মঞ্চ।
তিনি বলেন: গণজাগরণ মঞ্চ গণমানুষের জয় বাংলা স্লোগান ফিরিয়ে এনেছিল। তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।