ঢাকা ০১:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্ব ইজতেমা শুরু হতে যাচ্ছে শুক্রবার, দ্বিতীয় পর্ব শুরু ২০ জানুয়ারি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:০২:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১১৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মহামারি করোনা ও দুই পক্ষের বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে দুই বছর পর এবার ১৩ জানুয়ারি শুরু হবে মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। কনকনে শীত ও ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে ইতিমধ্যেই ইজতেমা ময়দানের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করছেন মুসল্লিরা। এ উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরইমধ্যে দ্রুতগতিতে কাজ সম্পনের জন্য মুসল্লিসহ বিভিন্ন দফতরের লোকজন। তবে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ। তবে দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে এবারের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

শনিবার ইজতেমা মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, মুসল্লিরা ময়দানের বিভিন্ন স্থানে চটের তাঁবু টানাতে ব্যস্ত। মুসল্লিদের ভোরে কনকনে শীত আর ঘন কুয়াশায় পুরো ময়দানে অন্তত পাঁচ শতাধিক মুসল্লিকে কাজ করতে দেখা যায়।

ইজতেমা ঘিরে এবার কোনো শঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে মুসল্লিদের একজন বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর বিশ্ব ইজতেমা হয়নি। এবার ইজতেমায় আসব। তাই অনেক আনন্দ লাগছে। কারণ আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে হলে তাবলিগের বিকল্প নেই। আমাদের নবীজিও দাওয়াতের কাজে সর্বক্ষণ সময় দিয়েছেন।

তিনি বলেন, পবিত্র হজে¦র পর দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত এটি। বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এখানে আসেন। আল্লাহর দরবারে বৃহত্তম মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। আল্লাহ আমাদের এবং আমাদের মা-বাবাসহ সবার গুনাহ মাফ করে দেবেন-এ প্রত্যাশা নিয়ে আমরা তাবলিগ জামাত এবং ইজতেমায় আসি। তবে আমরা তাবলিগের দুই গ্রুপ চাই না। এবারও দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। প্রথম গ্রুপ মাওলানা জুবায়ের সাহেবের দ্বিতীয়টি সাদ সাহেবের।

শুক্রবার বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা জানতে ফলো-আপ সভা টঙ্গীর ইজতেমা মাঠসংলগ্ন বাটা রোডে অনুষ্ঠিত হয়।

এসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নানা কারণে দুইভাগে বিশ্ব ইজতেমা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় দুই গ্রুপের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে গেছে। ইজতেমা আয়োজক কমিটির দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। নতুন করে আর ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই।মিলেমিশে সুন্দরভাবে ইজতেমা শেষ করবে।

তিনি বলেন, ইজতেমার নিরাপত্তায় পুলিশ, র‌্যাব, আনসার প্রয়োজনে বিজিবিও প্রস্তুত থাকবে। সামরিক বাহিনীও সহযোগিতা করছে। বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আসা মুসল্লিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বিশেষ করে এবার বিদেশি মেহমানদের জন্য নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথমপর্বে আসা বিদেশি মুসল্লিরা আখেরি মোনাজাতের পর বিমানবন্দর হজ¦ ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। সেখান থেকে তারা তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরবেন।

সভায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানসহ বিভিন্ন দফতরের প্রধানগন এসময় উপস্থিত ছিলেন।

সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসল্লিদের আগমনে পুলিশ, র‌্যাবসহ ১০ হাজারের অধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা নিরাপত্তা চাদরে মোড়ানো থাকবে।

তিনি বলেন, জঙ্গিদের কোনো হুমকি নেই। সিসি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার ও রুফটপ থেকে পুরো ইজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া স্পেশালাইজড টিমসহ প্রতিটি ‘খিত্তা’য় সাদা  পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন।

তিনি জানান, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রতি খিত্তায় এবার দুটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা হবে। তুরাগে নৌ টহলও থাকবে। স্পেশাল ফোর্স হিসেবে থাকবে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। আকাশে থাকবে হেলিকপ্টার টহল। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তুরাগ নদে তৈরি করেছেন ছয়টি পন্টুন। এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে মুসল্লিরা এপার থেকে ওপারে যাতায়াত করতে পারবেন। এছাড়াও নদী পারাপারের জন্য আরো দুইটি সংযোগস্থল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ১২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে।

প্রতিবছরের মতো এবারও উর্দু ভাষায় বয়ান করা হবে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে বয়ানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও আরবি ভাষায় তর্জমা করা হবে।

এদিকে  জনস্বাস্থ্য প্রকৌকল,সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি,সিটি কর্পোরেশন ও বিদ্যু বিভাগসহ অনেক দফতর মাঠে অবস্থান নিয়ে কাজ সম্পন্ন করছেন।

ইতোমধ্যে ময়দানের ৫০ ভাগের বেশি কাজ হয়ে গেছে বলে ইজতেমা আয়োজক কমিটির দাবি। জেলাভিত্তিক খিত্তার তালিকাও সম্পন্ন হয়েছে বলে তারা জানান। ইজতেমা ময়দানে বাশের খুটি গাড়া শেষ করে পশ্চিম প্রান্ত থেকে চট দিয়ে উপরে প্যান্ডেল তৈরি বরা হচ্ছে। প্রতিদিনই শত শত তাবলীগ জামাতের অনুসারীরা কাজ করছেন। মহান আল্লাহকে রাজি-খুশি করাতে ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীত উপেক্ষা করে মুসল্লিরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা আশা করছেন আগামি ১২ জানুয়ারির আগেই ময়দানের প্যান্ডেলের কাজ সমাপ্ত হবে। এছাড়া ইজতেমা মাঠে সরকারি বিভিন্ন দফতরের লোকজন কাজ করছেন। ২০২০ সালে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর করোনা-১৯ মহামারির কারণে গত দুই বছর ২০২১ ও ২০২২ সালে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। জুবায়েরপন্থিদের তিন দিনের ইজতেমাকে ঘিরে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় ধর্মীয় উৎসব আমেজ বিরাজ করছে। প্রতি বছর ইজতেমায় আগত ঢাকা জেলার সাথীরা সবার শেষে তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তার কাজ করে থাকেন। এবারো ঢাকা জেলার মুসল্লিদের জন্য নির্ধারিত খিত্তার স্থান বাদে অন্য সব কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদের পূর্বপাড়ে নামাজের মিম্বর ও উত্তর-পশ্চিম কোণে বিদেশি মেহমানদের জন্য নির্ধারিত কামরার পাশে বয়ান মঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও ছামিয়ানা টানানো, বিদ্যুৎ ও মাইক সংযোগের জন্য তার টানানোসহ তাশকিল কামরা, জুড়নেওয়ালি জামাতের কামরা, বধিরদের বয়ান শোনার জন্য পৃথক কামরা তৈরি করা হচ্ছে। আগামী ১২ জানুয়ারি মধ্যেই দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি ময়দানে এসে তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নেবেন।

ইজতেমায় আগত প্রথম পর্বে ৯০খিত্তাভিত্তিক মুসল্লিদের অবস্থান:
৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জন্য ৯১টি খিত্তায় বিভক্ত করা হলেও ৯০টি খিত্তায় মুসল্লিদেও অবস্থান থাকবে এবং এটি খিত্তা রির্জাভ রাখা হয়েছে। কে কোন খিত্তায় অবস্থান করবেন তা হলো- গাজীপুর (খিত্তা-১), টঙ্গী (খিত্তা-২, ৩ ও ৪), ঢাকা (খিত্তা-৫ থেকে ১৮ ও ২১, ২২, ২৫, ২৭, ২৮, ৩০),  রাজশাহী (খিত্তা-১৯), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (খিত্তা-২০), নাটোর (খিত্তা-২৩), নওগাঁ (খিত্তা-২৪), নড়াইল (খিত্তা-২৬), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-২৯), টাঙ্গাইল (খিত্তা-৩১), রংপুর (খিত্তা-৩২), গাইবান্ধা (খিত্তা-৩৩), লালমনিরহাট (খিত্তা-৩৪), মুন্সীগঞ্জ (খিত্তা-৩৫), যশোর (খিত্তা-৩৬), নীলফামারী (খিত্তা-৩৭), বগুড়া (খিত্তা-৩৮), জয়পুরহাট (খিত্তা-৩৯), নারায়ণগঞ্জ (খিত্তা-৪০), ফরিদপুর (খিত্তা-৪১), ভোলা (খিত্তা-৪২), নরসিংদী (খিত্তা-৪৩), সাতক্ষীরা (খিত্তা-৪৪), বাগেরহাট (খিত্তা-৪৫), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৪৬), মেহেরপুর (খিত্তা-৪৭), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৪৮), ময়মনসিংহ (খিত্তা-৪৯, ৫১), শেরপুর (খিত্তা-৫০), জামালপুর (খিত্তা-৫২), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৫৩), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-৫৪), নেত্রকোনা (খিত্তা-৫৫), ঝালকাঠি (খিত্তা-৫৬), বান্দরবান (খিত্তা-৫৭), বরিশাল (খিত্তা-৫৮), পিরোজপুর (খিত্তা-৫৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৬০), কক্সবাজার (খিত্তা-৬১), সিলেট (খিত্তা-৬২), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৬৩), ফেনী (খিত্তা-৬৪), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৫), লক্ষ্ীপুর (খিত্তা-৬৬), চাঁদপুর (খিত্তা-৬৭), ব্রাহ্মণবাড়িয়া (খিত্তা-৬৮), খুলনা (খিত্তা-৬৯), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭০), বরগুনা (খিত্তা-৭১), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৭৪), কুমিল্লা (খিত্তা-৭৫), তুরাগ নদের পশ্চিমপাড় কাঁচাবাজাওে মৌলভীবাজার (খিত্তা-৭৬), রাজবাড়ী (খিত্তা-৭৭), মাদারীপুর (খিত্তা-৭৮), শরীয়তপুর (খিত্তা-৭৯), মানিকগঞ্জ (খিত্তা-৮০, সাফা টাওয়ার), রাঙ্গামাটি (খিত্তা-৮১), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৮২), দিনাজপুর (খিত্তা-৮৩), পাবনা (খিত্তা-৮৪), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৮৫), ঝিনাইদহ (খিত্তা-৮৭, যমুনা প্লট), মাগুরা (খিত্তা-৮৮, যমুনা প্লট), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৮৯, কামারপাড়া বেড়িবাঁধ বঙ্গবন্ধু  মাঠ), পঞ্চগড় (খিত্তা-৯০) কামারপাড়া হাইস্কুল মাঠ-বধির স্কুল ভবন) জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন।

বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বি ডা. খান মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জানান, ময়দানের চারপাশে ১১ ও ১২নং খিত্তার কিয়দংশ, ৩২ ও ৩৭নং খিত্তার মাঝামাঝি ১২নং, ৭২, ৭৩, ৮৬ ও ৯১নং খিত্তাগুলো সংরক্ষিত হিসেবে রাখা হয়েছে।

আগামী ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে এবারের প্রথম পর্বের (জুবায়েরপন্থি) বিশ্ব ইজতেমার। মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের অনুসারী (মাওলানা সাদপন্থি) মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবেন এবং ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বিশ্ব ইজতেমা শুরু হতে যাচ্ছে শুক্রবার, দ্বিতীয় পর্ব শুরু ২০ জানুয়ারি

আপডেট টাইম : ১১:০২:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৩

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মহামারি করোনা ও দুই পক্ষের বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে দুই বছর পর এবার ১৩ জানুয়ারি শুরু হবে মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। কনকনে শীত ও ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে ইতিমধ্যেই ইজতেমা ময়দানের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করছেন মুসল্লিরা। এ উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরইমধ্যে দ্রুতগতিতে কাজ সম্পনের জন্য মুসল্লিসহ বিভিন্ন দফতরের লোকজন। তবে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ। তবে দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে এবারের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

শনিবার ইজতেমা মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, মুসল্লিরা ময়দানের বিভিন্ন স্থানে চটের তাঁবু টানাতে ব্যস্ত। মুসল্লিদের ভোরে কনকনে শীত আর ঘন কুয়াশায় পুরো ময়দানে অন্তত পাঁচ শতাধিক মুসল্লিকে কাজ করতে দেখা যায়।

ইজতেমা ঘিরে এবার কোনো শঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে মুসল্লিদের একজন বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর বিশ্ব ইজতেমা হয়নি। এবার ইজতেমায় আসব। তাই অনেক আনন্দ লাগছে। কারণ আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে হলে তাবলিগের বিকল্প নেই। আমাদের নবীজিও দাওয়াতের কাজে সর্বক্ষণ সময় দিয়েছেন।

তিনি বলেন, পবিত্র হজে¦র পর দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত এটি। বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এখানে আসেন। আল্লাহর দরবারে বৃহত্তম মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। আল্লাহ আমাদের এবং আমাদের মা-বাবাসহ সবার গুনাহ মাফ করে দেবেন-এ প্রত্যাশা নিয়ে আমরা তাবলিগ জামাত এবং ইজতেমায় আসি। তবে আমরা তাবলিগের দুই গ্রুপ চাই না। এবারও দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। প্রথম গ্রুপ মাওলানা জুবায়ের সাহেবের দ্বিতীয়টি সাদ সাহেবের।

শুক্রবার বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা জানতে ফলো-আপ সভা টঙ্গীর ইজতেমা মাঠসংলগ্ন বাটা রোডে অনুষ্ঠিত হয়।

এসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নানা কারণে দুইভাগে বিশ্ব ইজতেমা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় দুই গ্রুপের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে গেছে। ইজতেমা আয়োজক কমিটির দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। নতুন করে আর ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই।মিলেমিশে সুন্দরভাবে ইজতেমা শেষ করবে।

তিনি বলেন, ইজতেমার নিরাপত্তায় পুলিশ, র‌্যাব, আনসার প্রয়োজনে বিজিবিও প্রস্তুত থাকবে। সামরিক বাহিনীও সহযোগিতা করছে। বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আসা মুসল্লিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বিশেষ করে এবার বিদেশি মেহমানদের জন্য নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথমপর্বে আসা বিদেশি মুসল্লিরা আখেরি মোনাজাতের পর বিমানবন্দর হজ¦ ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। সেখান থেকে তারা তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরবেন।

সভায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানসহ বিভিন্ন দফতরের প্রধানগন এসময় উপস্থিত ছিলেন।

সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসল্লিদের আগমনে পুলিশ, র‌্যাবসহ ১০ হাজারের অধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা নিরাপত্তা চাদরে মোড়ানো থাকবে।

তিনি বলেন, জঙ্গিদের কোনো হুমকি নেই। সিসি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার ও রুফটপ থেকে পুরো ইজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া স্পেশালাইজড টিমসহ প্রতিটি ‘খিত্তা’য় সাদা  পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন।

তিনি জানান, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রতি খিত্তায় এবার দুটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা হবে। তুরাগে নৌ টহলও থাকবে। স্পেশাল ফোর্স হিসেবে থাকবে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। আকাশে থাকবে হেলিকপ্টার টহল। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তুরাগ নদে তৈরি করেছেন ছয়টি পন্টুন। এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে মুসল্লিরা এপার থেকে ওপারে যাতায়াত করতে পারবেন। এছাড়াও নদী পারাপারের জন্য আরো দুইটি সংযোগস্থল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ১২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে।

প্রতিবছরের মতো এবারও উর্দু ভাষায় বয়ান করা হবে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে বয়ানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও আরবি ভাষায় তর্জমা করা হবে।

এদিকে  জনস্বাস্থ্য প্রকৌকল,সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি,সিটি কর্পোরেশন ও বিদ্যু বিভাগসহ অনেক দফতর মাঠে অবস্থান নিয়ে কাজ সম্পন্ন করছেন।

ইতোমধ্যে ময়দানের ৫০ ভাগের বেশি কাজ হয়ে গেছে বলে ইজতেমা আয়োজক কমিটির দাবি। জেলাভিত্তিক খিত্তার তালিকাও সম্পন্ন হয়েছে বলে তারা জানান। ইজতেমা ময়দানে বাশের খুটি গাড়া শেষ করে পশ্চিম প্রান্ত থেকে চট দিয়ে উপরে প্যান্ডেল তৈরি বরা হচ্ছে। প্রতিদিনই শত শত তাবলীগ জামাতের অনুসারীরা কাজ করছেন। মহান আল্লাহকে রাজি-খুশি করাতে ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীত উপেক্ষা করে মুসল্লিরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা আশা করছেন আগামি ১২ জানুয়ারির আগেই ময়দানের প্যান্ডেলের কাজ সমাপ্ত হবে। এছাড়া ইজতেমা মাঠে সরকারি বিভিন্ন দফতরের লোকজন কাজ করছেন। ২০২০ সালে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর করোনা-১৯ মহামারির কারণে গত দুই বছর ২০২১ ও ২০২২ সালে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। জুবায়েরপন্থিদের তিন দিনের ইজতেমাকে ঘিরে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় ধর্মীয় উৎসব আমেজ বিরাজ করছে। প্রতি বছর ইজতেমায় আগত ঢাকা জেলার সাথীরা সবার শেষে তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তার কাজ করে থাকেন। এবারো ঢাকা জেলার মুসল্লিদের জন্য নির্ধারিত খিত্তার স্থান বাদে অন্য সব কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদের পূর্বপাড়ে নামাজের মিম্বর ও উত্তর-পশ্চিম কোণে বিদেশি মেহমানদের জন্য নির্ধারিত কামরার পাশে বয়ান মঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও ছামিয়ানা টানানো, বিদ্যুৎ ও মাইক সংযোগের জন্য তার টানানোসহ তাশকিল কামরা, জুড়নেওয়ালি জামাতের কামরা, বধিরদের বয়ান শোনার জন্য পৃথক কামরা তৈরি করা হচ্ছে। আগামী ১২ জানুয়ারি মধ্যেই দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি ময়দানে এসে তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নেবেন।

ইজতেমায় আগত প্রথম পর্বে ৯০খিত্তাভিত্তিক মুসল্লিদের অবস্থান:
৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জন্য ৯১টি খিত্তায় বিভক্ত করা হলেও ৯০টি খিত্তায় মুসল্লিদেও অবস্থান থাকবে এবং এটি খিত্তা রির্জাভ রাখা হয়েছে। কে কোন খিত্তায় অবস্থান করবেন তা হলো- গাজীপুর (খিত্তা-১), টঙ্গী (খিত্তা-২, ৩ ও ৪), ঢাকা (খিত্তা-৫ থেকে ১৮ ও ২১, ২২, ২৫, ২৭, ২৮, ৩০),  রাজশাহী (খিত্তা-১৯), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (খিত্তা-২০), নাটোর (খিত্তা-২৩), নওগাঁ (খিত্তা-২৪), নড়াইল (খিত্তা-২৬), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-২৯), টাঙ্গাইল (খিত্তা-৩১), রংপুর (খিত্তা-৩২), গাইবান্ধা (খিত্তা-৩৩), লালমনিরহাট (খিত্তা-৩৪), মুন্সীগঞ্জ (খিত্তা-৩৫), যশোর (খিত্তা-৩৬), নীলফামারী (খিত্তা-৩৭), বগুড়া (খিত্তা-৩৮), জয়পুরহাট (খিত্তা-৩৯), নারায়ণগঞ্জ (খিত্তা-৪০), ফরিদপুর (খিত্তা-৪১), ভোলা (খিত্তা-৪২), নরসিংদী (খিত্তা-৪৩), সাতক্ষীরা (খিত্তা-৪৪), বাগেরহাট (খিত্তা-৪৫), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৪৬), মেহেরপুর (খিত্তা-৪৭), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৪৮), ময়মনসিংহ (খিত্তা-৪৯, ৫১), শেরপুর (খিত্তা-৫০), জামালপুর (খিত্তা-৫২), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৫৩), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-৫৪), নেত্রকোনা (খিত্তা-৫৫), ঝালকাঠি (খিত্তা-৫৬), বান্দরবান (খিত্তা-৫৭), বরিশাল (খিত্তা-৫৮), পিরোজপুর (খিত্তা-৫৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৬০), কক্সবাজার (খিত্তা-৬১), সিলেট (খিত্তা-৬২), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৬৩), ফেনী (খিত্তা-৬৪), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৫), লক্ষ্ীপুর (খিত্তা-৬৬), চাঁদপুর (খিত্তা-৬৭), ব্রাহ্মণবাড়িয়া (খিত্তা-৬৮), খুলনা (খিত্তা-৬৯), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭০), বরগুনা (খিত্তা-৭১), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৭৪), কুমিল্লা (খিত্তা-৭৫), তুরাগ নদের পশ্চিমপাড় কাঁচাবাজাওে মৌলভীবাজার (খিত্তা-৭৬), রাজবাড়ী (খিত্তা-৭৭), মাদারীপুর (খিত্তা-৭৮), শরীয়তপুর (খিত্তা-৭৯), মানিকগঞ্জ (খিত্তা-৮০, সাফা টাওয়ার), রাঙ্গামাটি (খিত্তা-৮১), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৮২), দিনাজপুর (খিত্তা-৮৩), পাবনা (খিত্তা-৮৪), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৮৫), ঝিনাইদহ (খিত্তা-৮৭, যমুনা প্লট), মাগুরা (খিত্তা-৮৮, যমুনা প্লট), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৮৯, কামারপাড়া বেড়িবাঁধ বঙ্গবন্ধু  মাঠ), পঞ্চগড় (খিত্তা-৯০) কামারপাড়া হাইস্কুল মাঠ-বধির স্কুল ভবন) জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন।

বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বি ডা. খান মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জানান, ময়দানের চারপাশে ১১ ও ১২নং খিত্তার কিয়দংশ, ৩২ ও ৩৭নং খিত্তার মাঝামাঝি ১২নং, ৭২, ৭৩, ৮৬ ও ৯১নং খিত্তাগুলো সংরক্ষিত হিসেবে রাখা হয়েছে।

আগামী ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে এবারের প্রথম পর্বের (জুবায়েরপন্থি) বিশ্ব ইজতেমার। মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের অনুসারী (মাওলানা সাদপন্থি) মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবেন এবং ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটবে।