ড. গোলসান আরা বেগমঃ আনুমানিক রাত দশটায় গ্রামের বাড়ি ফিরছিলাম। একটা ভয় মনের ভেতরে কাজ করছিলো। কে কি বলে – এই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু শহরে অন্য কোথাও রাত যাপন করবো, তা সম্ভব ছিলো না। কি আর করা শহরের কাজ শেষ করে রওনা হলাম। আমি রহিম ছাত্তার আইডিয়াল কলেজের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। বর্তমানে অত্র কলেজের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। আওয়ামী ঘরানার রাজনীতি করি জীবনের আগা গোড়া থেকেই। তা ছাড়াও প্রগতিশীল নানা সংগঠনের সাথে কাজ করে পজেটিব অর্থে সমাজ পল্টানোর গুরু দায়িত্ব বহন করে যাচ্ছি। অতীতে বহু দিনেই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছি গভীর রাতে, নজির আছে ভুরি ভুরি।ভয় পাইনি বা অসহায়ত্ব বোধ করিনি। কিন্তু আজ কেন এমন মনে হচ্ছে।
সৃষ্টি রহস্যের বহু অন্ধকার দুর হলেও, আজো মেয়ে মানুষের পায়ে পায়ে ঘুরে নানা বিধি নিষেধের ষন্ত্রণা।তাকে হাঁটতে হবে নরম পায়ে, নরম স্বরে কথা বলতে হবে । নারী জাতির আবার কিসের স্বাধীনতা।ঘনিষ্ট একজন তার বাসায় খাইতে, ও রাখতে চাইলো বেশ আন্তরিকতার সাথে।আমি নাকচ করে দিলাম। মনে একটা লোভ কাজ করছিলো — আধাঁর কালো অন্ধকারে গাঁয়ের প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্র দেখার।
মনে পড়ে জাতীর নির্বাচনের প্রচারে মিটিং করতে গিয়েছিলাম কিশোগঞ্জের হাওর অঞ্চল ইটনা মিটামইনে। আওয়ামী আর্দশের প্রার্থী ছিলেন ঐ এলাকার বর্তমান সাংসদ রেজওয়ান আহমদ তৌফিক। আমরা সফর সঙ্গী হয়েছিলাম দৈনিক শতাব্দির কনষ্ঠ এর সম্পাদক জনাব আহমদ উল্লাহ, সাবেক পৌর মেয়র মোঃ নুরুল ইসলাম, সদর থানার আওয়ামীলীগের সভাপতি জনাব আতাউর রহমান ও আমি। সকাল সাতটায় রওনা দিয়ে বেশ কয়েকটা জনসভায় অংশ গ্রহন করি। সে এলাকার রাস্তা ঘাট যে কতো দূর্গম, তা না দেখলে বুঝা যাবে না।আমাদের সফর সঙ্গী একজন তো পা পিচলে চিত হয়ে পরে গেলেন।ভাগ্যিস হাত পা ভাঙ্গেনি। এমন একটা দুর্গম এলাকা থেকে কি ভাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রের সর্ব উচ্চ আসনে ওঠ এসেছেন, তা সত্যিই আমাদেরকে বিস্মিত করে।
ইটনা থেকে চামড়া ঘাটে ফিরার পথে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিলো। মাছ বহনকারী একটি ট্রলারে রওনা দিয়েছিলাম।রাতের আঁধারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিলো না।আমি এই ধরনের যাতায়তে অভ্যস্থ্য ছিলাম না। ভয়ে হাত পা কুকড়ে আসছিলো। মাঝ নদীতে আসার পর বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যায়।ট্রলারও চলতে পারছিলো না। আল্লাহ আল্লাহ জপছিলাম। মাছ বোঝাই বাক্সের চিপায় বসে গাঢ় অন্ধকারে কারো মুখ দেখা যাচ্ছিলো না।সবাই ছিলাম চুপচাপ নীরব। রক্তের চাপমাত্রা নিশ্চিত ছিলো সবার উর্ধ্বগামী।যাক ভয় ভীতি উপেক্ষা করে রাত প্রায় একটার সময় চামড়া ঘাটে আমাদের ট্রলার ভীড়ে। কিশোরগঞ্জ নগুয়ার বাসায় ফিরে আসি রাত দেড়টায়।বাড়ী ওয়ালা কালাম ভাইয়ের সহযোগিতায় বাসায় ঢুকি।আমি একাই একটি ফ্লট বাড়িতে বসবাস করতাম।রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
আমাদের বাড়ী কিশোরগঞ্জ শিক্ষকপল্লি থেকে বিন্নাটি পাটাবুকা সড়ল বাড়ি আট কিলোমিটার দুরে হবে। সঙ্গে রয়েছে একটি এলিওন গড়ী।দুই নাতির দাদু,৬৩ তে দাঁড়িয়ে ভয় কিসের? বুন্নাটি চৌরাস্ত একটু চা খেতে দাঁড়াই।চেনা জানা অনেকের সাথে দেখা হয়।কেউ কেউ জানতে চায় ২০২০ সালে অবসর গ্রহনের পর কি করি।
উত্তরে আমি বলি — আমার কোন অবসর নেই বাবা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই।এ জন্য স্বামী সন্তানের অনেক জারি জুরি সহ্য করতে হয়। সময় পেলেই টুক টুক করে কবিতা লিখি, ফেইজ বুকে পোষ্ট দেই। গুগলে বা,অন্যান্য গ্রোপ্র ঢুকে দেখি কে কেমন লিখছে। কমেন্ট করি ও অন্যদের কমেন্ট পড়ি। এসব করতে করতে চোখ দুটো প্রায় অন্ধ হয়ে আসছে।এই তো সেদিন ২০২২ এর জেলা পরিষদ নির্বাচনে অধ্যক্ষ সাজেদার জন্য সদস্য পদে ভোট চাইতে গিয়েছিলাম।দেখে এসেছি কিশোরগঞ্জ ও পাকুন্দিয়া উপজেলার ধূলা বালি শস্যদানা। দেশের রাজনীতি নিয়ে কি ভাবছে, কি বলছে শুনে এসেছি।
বাংলাদেশ কৃশকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে, বিভিন্ন কর্মসূচিতে আংশ গ্রহন করতে ২৩, নং গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু এভ্যিনিউ এ ছুটে যাই। কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে কর্মিদের সাথে মত বিনিময় করি, আড্ডা দেই। রাজনীতির উষ্ণতা নিতে ঘুরাঘুরি করি জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে, ধানমন্ডি ৩ নাম্বারে। বাংলাদেশ আওয়মীলীগের মূখপত্র উত্তরণে আমার কোন লেখা প্রকাশ হলো কি না খোজঁ নিয়ে আসি। বাংলা একাডেমিতে যাই, কে কেমন লিখছে তা জানতে। এর পর কি আর সময় হাতে থাকে।নামাজ,কালাম, পারিবারিক কাজ তো আছেই।
বেশী সময় হাতে পেলে আমার প্রিয় নেত্রী উন্মে কুলসুম স্মৃতি, যিনি বাংলাদেশ কৃষকলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পদকের দায়িত পালন করছেন। তার সফর সঙ্গী হয়ে জায়ীতা রেস্টুরেন্টে লাল চা খাই, বসুন্ধার সিনেপ্লেস্কে ছবি দেখি, মার্কেটিং করি, প্দ্মা সেতু দেখতে চলে যাই লংড্রাইভে, যা ইচ্ছা গল্প করি,চোখে রেখে চোখ স্বপ্ন আকিঁ। টি ২০ ক্রিকেট খেলা চলছে, মজার মজার নাটক হয় — তা দেখতে টিভির পর্দায় রাখি চোখ।রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে করছে মাজাদার গালাগালি , তা দেখে খুব মজা পাই। আগামীতে কি হবে এই দুশ্চিন্তায় মাথায় রাখি হাত।
চারটা গরম পোরুটি, দুইটা ডিম বাজি নিয়ে আড্ডা ছাড়ি। একটা ছেলে দৌড়ে এসে বললো– মেডাম আমাদের নিয়ে কিছু লিখবেন। আমরা পড়াশোনা শেষ করে বেগাবনের মতো ঘুরে বেডাচ্ছি।চাকুরি নেই, কি করে চলবো। ছেলেটির মাথায় রেখে বলি – আল্লাহই একটা রাস্তা বের করে দিবে।
গাড়ীটি গাঁয়ের মাথায় ঢুকতেই দেখি গাঢ় অন্ধকার ডেকে রেখেছে চার পাশের পৃথিবী। দুরে দুরে জ্বলছে হাঁস মুরগীর খামারে বিদ্যুতের আলো। বউ কথা কও পাখি করছে ডাকাডাকি। হুক্কা হুয়া শিয়ালের ডাক শুনতে না শুনতেই কুয়াশায় ভেজা একটি শিয়াল গাড়ীর সামনে দিয়ে পালিয়ে যায়।অ্ল্পের জন্য দুর্গটনা ঘটেনি।
ড্রাইভার তামিমকে বলি গাড়ি সাবধানে চালাও।এই রাতে গাড়ী জঙ্গলে একসিডেন্ড করলে আমার মান সন্মান থাকবে না। যাক, তির তির করতে করতে পোঁছে যাই শ্বশুর বাড়ি। বিদূৎ নেই,গাঢ় অন্ধকারে মোবাইলের লাইট টিপে টিপে ঘরে ঢুকি। আগের দিন সকালে বিদায় নিয়ে এসেছিলাম,ঢাকায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিলো। তাই মশার কয়েল চাড়াই নিয়েছিলাম ঘুমের প্রস্তুতি। এতো রাতে তো কয়েল পাওয়া যাবে না। মশা আমাকে ক্ষমা করেনি।
বাড়ীতে পা রেখেই শুনি তাহেরীর মা মারা গিয়েছে সকালে।আহারে আর আসবেনা প্রতি ঈদে কাঁপতে কাঁপতে কৌশল বিনিময় করতে ।ঘরে লাইট জ্বেলে দেখি একজন মহিলা ঘুমিয়ে আছে মাথার নীচে শক্ত কাঠের পিঁড়ি দিয়ে। তার গায়ে জড়িয়ে আছে ছ্যাঁড়া কাঁথার টুকরা। একটা বালিশ তার মাথায় দিতে দিতে বললাম – হায়রে ধনীর বিলাসিতা। অথচ এই মহিলা বক্তের সম্পর্কে আত্মীয়। গরিব হলে কেই চোখ তুলে তাকায় না।
লেখকঃ সভপতি মন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষক লীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি।