কৃষকদের নগদ সহায়তার সহ ভর্তুকির পরামর্শ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মহামারি করোনা পরবর্তী সময়ে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির মধ্যে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা, গবেষণা ও পর্যালোচনা চলছে। খাদ্য সংকটে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করা হবে- তাও ভাবনায় নিয়েছে অনেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়েছেন। এদিকে খাদ্য উৎপাদনের সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা কৃষি কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

এদিকে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের ভর্তুকির পাশাপাশি তাদের নগদ অর্থ সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্রমতে, গত পাঁচ বছরে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে সেভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়েনি। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ কোটি ৯৭ লাখ। যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখের কিছু বেশি। অর্থাৎ পাঁচ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল ও গমের মোট উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৭৩ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার টন। পাঁচ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৭ লাখ ২০ হাজার ১২৭ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের আমন চাষ হয়েছে ৪৭ লাখ ৪৮ হাজার ৯৩৬ হেক্টর জমিতে। বোনা আমনের চাষ হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৫২৮ হেক্টর ও রোপা আমনের চাষ হয়েছে সাত লাখ ২২ হাজার ৬৬৩ হেক্টর জমিতে।

২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি হেক্টর জমিতে আমনের ফলন হয়েছে ২ দশমিক ৬১৫ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমনের মোট উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৩৯০ টন। আগের অর্থবছরে আমনের উৎপাদন ছিল এক কোটি ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৩ টন। আগের অর্থবছরের তুলনায় এটি ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।

উন্নত বাজার ব্যবস্থা, কৃষিসামগ্রী সহজলভ্যতার পাশাপাশি কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করে গড়ে তোলার প্রতি জোর দেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে কৃষি খাতের সংকট ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তা সমাধান এবং সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে কৃষকদেরকে ঋণ দেওয়ার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের গত অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশে তিন কোটি ৫৬ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে দুই লাখ টন কম। সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক আগামী তিন বছরের মধ্যে চালের উৎপাদন ৩২ লাখ টন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দীর্ঘ খরা ও উৎপাদন হ্রাসের ফলে বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেছে খাদ্যের দাম। বর্তমান বিশ্বে ৮০ থেকে ৮২ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে রয়েছে। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১০০ কোটিরও বেশি। তাই বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই।’

উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের ভর্তুকির পাশাপাশি নগদ সহায়তা প্রদানের পরামর্শ দিয়ে এই কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদনে বীজ, সার এবং তেলসহ যে কয়টি উপাদান রয়েছে তার দাম বেড়ে গেছে। শুধুমাত্র কৃষকের জন্য তো আর দাম কমানো যাবে না সেক্ষেত্রে তাদের নগদ সহায়তা দিতে হবে।’

ধানের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কৃষকের ধানের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ১০ থেকে ২০ ভাগ বাড়িয়ে দিতে হবে। এখন যা দেওয়া হচ্ছে তা শুধুমাত্র উৎপাদন খরচ।’

ধানের মূল্য এবং খাদ্য উৎপাদন সামগ্রীর বাজার মনিটরিং করার প্রতি জোর দিয়ে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ফসল আসলে যখন ধানের দাম নির্ধারণ করা হয় তখন তা খুবই কম হয়ে থাকে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে কৃষকের কাছ থেকে সব ধান কেনা হয়ে গেলে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এগুলোও মনিটরিং করতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা এমন সুযোগ না নিতে পারে।’

এদিকে আগের চুক্তি অনুযায়ী দ্রুত চাল পাওয়া নিশ্চিত করতে এবং আরও চাল আমদানির চুক্তি করার উদ্যোগ নিতে ২১ নভেম্বর একসঙ্গে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া সফরে যাচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। এর মধ্যে মন্ত্রী ও খাদ্যসচিব তিনটি দেশই সফর করবেন। আর মন্ত্রণালয়ের ও খাদ্য অধিদপ্তরের বাকি কর্মকর্তারা ভাগ হয়ে একটি করে নির্দিষ্ট দেশে যাবেন। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন চালের দাম কমছে। আর এই দেশগুলোতে ফসল ওঠায় এখন তাদের চাল রপ্তানির মূল সময়।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দুই কোটি এক লাখ ৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ নানা কারণে প্রতিবছর দেশের প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশে ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কমছে প্রায় ২১৯ হেক্টর আবাদি জমি।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৮২-৮৩ সালে বাংলাদেশে প্রকৃত ফসলি জমি ছিল ৯.১৫ মিলিয়ন হেক্টর, যা ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়ায় ৮.০২ মিলিয়ন হেক্টরে। ফলে দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য চলে যাচ্ছে। উচ্চহারে জনসংখ্যা ও তাদের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণ হ্রাসের জন্য কৃষি, বন ও জলাভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর