হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিদেশি ফল রামবুটান চাষ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার কৃষক জামাল উদ্দিন।
তিনি দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবন শেষে মাত্র ছয় ডলারের রামবুটান দেশে নিয়ে এসেছিলেন।
সেই রামবুটানের বীজ থেকে চারা করে গাছ লাগানোর পর তা থেকে এখন প্রতি বছর আয় করছেন ১০ লাখেরও বেশি টাকা। নিজের দারিদ্র্য দূর করে এখন অন্যদের ও স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রামবুটানের ফল ও চারা নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় করছেন তার বাড়িতে।
জানা যায়, জামাল উদ্দিন শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের অষ্টানী গ্রামের বাসিন্দা। দীর্ঘ ১৫ বছর কাটান প্রবাসে। সব শেষে ২০০৬ সালে ব্রুনাই থেকে বাড়ি ফেরেন। ফেরার সময় স্বজনদের খাওয়ার জন্য নিয়ে আসেন দুই কেজি রামবুটান ফল। আর এ ফলের বীজ থেকেই চারা তৈরি করে শুরু করেন রামবুটানের মতো বিদেশি ফলের চাষ। চারা রোপণের চার বছর কোনো ফলের দেখা না পেলে প্রতিবেশীরা এটাকে জংলি গাছ ভেবে কেটে ফেলার পরামর্শ দেন। কিন্তু জামাল উদ্দিন কারো কথায় কান দেননি। এরপরের বছর অর্থাৎ রোপণের পাঁচ বছর পর অল্প কিছু ফল ধরে গাছে। পরের বছর থেকে ফলন বাড়তে থাকে।
আজ তার প্রায় ১০টি গাছ রয়েছে। যার মধ্যে তিনটি গাছে প্রায় প্রতি বছরই ফল ধরে। যা থেকে এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছেন। এছাড়া বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেছেন প্রায় ১৫শ’ চারা। একেকটি চারা তিনশ’ থেকে পাঁচ হাজার টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সরাসরি বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনেও চারা বিক্রি করছেন তিনি। কুরিয়ারের মাধ্যমে ফল ও চারা পাঠিয়ে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। কম খরচ, উপযুক্ত আবহাওয়া আর লাভজনক হওয়ায় তিনি বাগান বাড়াচ্ছেন। জামাল উদ্দিনের সফলতায় আনন্দিত এলাকার অন্যান্য চাষি। তারাও আগ্রহ প্রকাশ করছেন রামবুটান চাষেন। এলাকা ও এলাকার বাইরের চাষিরা চারা সংগ্রহ করে গড়ে তুলছেন নতুন নতুন বাগান। এতে করে এ ফলের আবাদি জমি বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রামবুটান বিদেশি একটি ফলের নাম। দেখতে অনেকটা লিচুর মতো, তবে লিচুর চেয়ে আকারে বড়, ডিম্বাকৃতি, কিছুটা চ্যাপ্টা ধরনের। পাকা ফলের খোসা উজ্জ্বল লাল, কমলা বা হলুদ রঙের হয়ে থাকে। ফলের খোসার উপরি ভাগ কদম ফুলের মতো নরম কাঁটা দিয়ে আবৃত। রামবুটান লিচুর মতোই চিরহরিত, মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট লম্বা গাছ। জুলাই-আগস্ট মাসে ফল পাকে। অপুষ্ট ফলের রঙ সবুজ থাকে। ফল পুষ্ট হলে উজ্জ্বল লাল ও মেরুন রঙে পরিণত হতে থাকে এবং এক মাসের মধ্যে পাকা ফল সংগ্রহ করার উপযোগী হয়। ফলটির ভেতরে লিচুর মতো সাদা শাঁস থাকে। খেতে খুব সুস্বাদু ও মুখরোচক। এর রয়েছে ওষুধি ও পুষ্টিগুণ।
অষ্টানী গ্রামের রামবুটান চাষি জামাল উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশেই রামবুটান বাগান। বাঁশের বেড়া দিয়ে বাগানটি ঘিরে রাখা হয়েছে। পাখি যাতে ফল খেতে না পারে, সেজন্য গাছ জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। প্রতিটি গাছই পাকা রামবুটান ফলে ভরপুর। এ বিদেশি ফলের স্বাদ ও চারা নিতে ভিড় জমিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার লোকজন। জামাল উদ্দিন তাদের চাহিদা অনুসারে গাছ থেকে রামবুটান পাড়ছেন। আর তার স্ত্রী তা মেপে ক্রেতাদের কাছে তুলে দিচ্ছেন। তারা প্রতি কেজি রামবুটান বিক্রি করছেন এক হাজার দুইশত টাকায়।
মাধবদী থেকে রামবুটান কিনতে এসেছেন হ্নদয় হাসান। তিনি বলেন, রামবুটান সুস্বাদু হওয়ায় বাড়ির সবাই খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাজারে ভালো রামবুটান পাওয়া যায় না। তাই সরাসরি বাগান থেকে রামবুটান নিতে চলে এসেছি।
শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় রামবুটান নিতে এসেছেন গৃহবধূ রত্না আক্তার। তিনি বলেন, আমাদের এলাকার রামবুটানের খ্যাতি সারাদেশ জুড়ে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন ফেরার সময় রামবুটান নিয়ে যেতে বলেছেন। তাই চাচার কাছ থেকে রামবুটান নিতে এসেছি।
জামাল উদ্দিনের রামবুটানের খ্যাতি জেলা ছাড়িয়ে এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকে রামবুটান ও চারা নিতে তার বাড়িতে আসছেন। তেমনি নওগাঁ থেকে এসেছেন শাহআলম। তিনি বলেন, আমার বাড়িতে বিভিন্ন ফলের একটি ছোট বাগান রয়েছে। ইউটিউবে জামাল উদ্দিনের বাগানের খবর পেয়ে এখান থেকে চারা নিতে এসেছি। এখন অল্প কিছু চারা নিয়ে যাব, যদি চারাগুলোতে ফল ধরে, তাহলে বড় পরিসরে বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ছোট ছেলেসহ নাটোর থেকে রামবুটান নিতে এসেছেন মজিবুর রহমান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শিবপুরের রামবুটানের খ্যাতি শুনেছি। বড় ভাই রামবুটানের বাগান করবে। তাই চারা নিতে সরাসরি জামাল উদ্দিনের কাছে চলে এসেছি। এখানে এসে যা দেখলাম, ভালোভাবে রামবুটান চাষ করতে পারলে ভবিষ্যতে এর ভালো মূল্য পাওয়া যাবে।
ঘরের কাজের পাশাপাশি স্বামী জামাল উদ্দিনকে রামবুটান চাষে সহযোগিতা করছেন রাশেদা বেগম। তিনি বলেন, সবাই রামবুটানের যত্ন নিতে পারে না। এর জন্য কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। উনি (স্বামী) আমাকে সব শিখিয়ে দেওয়ায় আমি ঘরের কাজের পাশাপাশি রামবুটান গাছগুলোর যত্ন নিয়ে থাকি।
কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, আমাদের এলাকার মাটি কৃষি কাজের উপযোগী। এখানে সবজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফল প্রচুর পরিমাণে হয়। যার ফলে রামবুটান চাষ করে আমি সফলতা পেয়েছি। আমি বারোমাসি রামবুটান চাষ করি। বছরের বারো মাসই গাছে ফল থাকে। রামবুটান সুস্বাদু হওয়ায় ফোনে ফোনে ঠিকানা নিয়ে বাড়ি থেকেই মানুষ ফল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আলাদাভাবে আমাকে বাজারজাত করতে হয় না। এ রামবুটান বিক্রি করে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পেরেছি। এখন এটাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছি। অনলাইন ও অফলাইনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমার চারা যাচ্ছে। আশা করি, কয়েক বছরের মধ্যে রামবুটান চাষের পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা শিবপুর কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সৈয়দ মো. মিজানুর রহমান বলেন, জামাল উদ্দিনের রামবুটানের বাগানটি পরিদর্শন করেছি। তিনি একজন সফল চাষি। রামবুটান ফলটি লিচু পরিবারের। এর আদি নিবাস মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এ ফল চাষের জন্য শিবপুরের মাটি ও আবহাওয়া উপযুক্ত।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. ছাইদুর রহমান বলেন, রামবুটান ফলের ব্যপক চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণও। নরসিংদীর মাটি অধিক উপযোগী হওয়ায় এ ফল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ গাছে আলাদা কোনো যত্ন নিতে হয় না। শুধু পানি ও জৈব সার ব্যবহার করলেই হয়। ভবিষ্যতে বীজ থেকে চারা করার পাশাপাশি কলম করে চারা উৎপাদন করার পরিকল্পনা রয়েছে। যার ফলে কম সময়ের মধ্যে গাছে ফল ধরবে। এ ফল চষে কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও টেকনিক্যাল সার্পোট দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, আগামীতে এ ফল নরসিংদীর কৃষিতে বিপ্লব ঘটাবে।