ঢাকা ১২:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বদেশ ভাবনা পরিবেশ সুরক্ষায় অবহেলার সুযোগ নেই

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:২২:২৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ জুন ২০২২
  • ১৬৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই)-২০২২ বা পরিবেশ সুরক্ষা সূচক-২০২২।

 কানাডার এমসিকল ম্যাকবেইন ফাউন্ডেশনের সহায়তায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তৈরি করেছেন সূচকটি।

বিশ্বের ১৮০টি দেশের পরিবেশগত কার্যক্রমের তুলনা ও বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এটি। সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। বৈশ্বিক পরিবেশ সূচকে অনেকটা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের তলানিতে অবস্থানের কারণ নির্ণয় এবং এ অবস্থার উন্নতিতে কী করণীয়, তা আলোচনা করাই মূলত এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংক্ষেপে যার অর্থ দাঁড়ায়, ইপিআই-২০২২ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী টেকসইতার তথ্যভিত্তিক সারসংক্ষেপ। ১১ শ্রেণিতে ৪০টি কার্যসম্পাদন নির্দেশনাকে মানদণ্ড ঠিক করে ইপিআই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়ুর মান, জ্বালানি ও জলবায়ু, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ, ভারী ধাতু বা হেভি মেটাল, জীববৈচিত্র্য ও তাদের বসতি এলাকা, বনভূমি, মৎস্যসম্পদ এবং কৃষি খাত। এসব বিষয়ের প্রতিটিতে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে বিভিন্ন দেশের অবস্থানের ক্রমতালিকা বা ইপিআই র‌্যাংকিং তৈরি করা হয়েছে।

এবারের তালিকায় র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক, ১০০ নম্বরের মধ্যে দেশটির স্কোর ৭৭.৯০। এ তালিকার শীর্ষ দশে অন্তর্ভুক্ত অন্য দেশগুলো এবং তাদের স্কোর (বন্ধনীতে) হচ্ছে-যুক্তরাজ্য (৭৭.৭০), ফিনল্যান্ড (৭৬.৫০), মাল্টা (৭৫.২০), সুইডেন (৭২.৭০), লুক্সেমবার্গ (৭২.৩০), স্লোভেনিয়া (৬৭.৩০), অস্ট্রিয়া (৬৬.৫০) ও সুইজারল্যান্ড (৬৫.৯০)।

তালিকার সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা পাঁচটি দেশ হচ্ছে যথাক্রমে পাকিস্তান (২৪.৬০), বাংলাদেশ (২৩.১০), ভিয়েতনাম (২০.১০) মিয়ানমার (১৯.৪০) ও ভারত (১৮.৯০)। ১৮০টি দেশের মধ্যে এদের অবস্থান যথাক্রমে ১৭৬, ১৭৭, ১৭৮, ১৭৯ ও ১৮০।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। ইপিআই-২০২২ সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭। ২০১৮ সালের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৯। তবে ২০২০ সালে অবস্থানের উন্নতি ঘটে। ওই বছর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২তম। ইপিআই-২০২২ সূচকে বাংলাদেশ ১৫ ধাপ পিছিয়ে গেছে।

এমন নয় যে, পরিবেশ সংরক্ষণে দেশে আইনের অভাব রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণে আইন ও নীতিমালাগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ নীতি ১৯৯২, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বন আইন ১৯২৭, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ নিরাপত্তা) আইন ২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, ইট পোড়া আইন ১৯৮৯, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন ২০১৭, মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০, গবাদি পশু জবাই (বিধিনিষেধ) এবং মাংস নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৫৭, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর অধীনে প্রণীত শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬ ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রটোকল, যেগুলোয় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জলাভূমি রক্ষাসংক্রান্ত ‘রামসার কনভেনশন ১৯৭১’, জীববৈচিত্র্য রক্ষাবিষয়ক ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি ১৯৯২’, ওজোন স্তর রক্ষার্থে প্রণীত ‘মন্ট্রিয়েল প্রটোকল ১৯৮৭’, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসে স্বাক্ষরিত ‘কিয়োটো প্রটোকল ১৯৯৭’, জলবায়ু পরিবর্তনের রূপরেখাবিষয়ক ‘ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ১৯৯২’ প্রভৃতি। পরিবেশ সংরক্ষণে বাংলাদেশ তার প্রণীত নীতিমালা, আইন ও বিধি এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রটোকল বাস্তবায়নে এ যাবৎ তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

দেশে পরিবেশের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষিত কয়েকটি দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার প্রকাশিত ‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ৭৬.৯; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০-এর কম। বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।

আর রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবার নিচে দিল্লির পরই ঢাকার অবস্থান। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বসবাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে তৈরি প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে নিচের দিকে ছিল। ২০২১ সালে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান ছিল ১৩৭তম।

পরিবেশ দূষণের অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল-কলকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী ও প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার।

উপর্যুক্ত কারণগুলোর সঙ্গে আর যে কারণটি যুক্ত তা হলো, পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতার অভাব। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকাকালে আমি লক্ষ করেছি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক শিক্ষিত ও দায়িত্ববান ব্যক্তি পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে মোটেই সচেতন নন।

তাদের অনেকের বক্তব্য-আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ সংরক্ষণ। আরও যে বিষয়টি লক্ষ করেছি তা হলো, অনুল্লেখিত কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। এসব প্রকল্প একদিকে যেমন টেকসই হয় না, তেমনি অন্যদিকে পরিবেশকে দূষিত করে।

পরিবেশের এ করুণ অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় প্রণীত নীতিমালা, আইন, বিধি বাস্তবায়নে সরকারকে কঠোর হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পরিবেশকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন নয়। তার এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারকে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২০২৫) টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা অন্তর্ভুক্ত করে অর্থনৈতিক ও পরিবেশসংক্রান্ত পরিকল্পনার মধ্যে সংগতি বিধানের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-২০৪১) পরিবেশ খাতের উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে রয়েছে-ক. বিদ্যমান জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশগত বিষয়াবলির মধ্যে উপযুক্ত ভারসাম্য আনয়নে উদ্যোগ গ্রহণ; খ. যথোপযুক্ত নালা ও আধুনিক নর্দমা নির্মাণ ও যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শহরগুলোকে বন্যামুক্ত রাখার পাশাপাশি বিশুদ্ধ বায়ুর নিশ্চয়তা বিধান; গ. যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে দ্রুততম সময়ে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিশ্চিতকরণ; ঘ. পরিবেশসংক্রান্ত গভর্ন্যান্স নিশ্চিত করতে আইনগত নিয়মনীতি ও প্রণোদনার বিষয়গুলোর মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয় ঘটানো।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যাবলি এবং পরিবেশসংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ইত্যাদি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের পরিবেশ সুরক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। এ ব্যাপারে আর অবহেলার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে-এটাই দেশের জনগণের প্রত্যাশা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

স্বদেশ ভাবনা পরিবেশ সুরক্ষায় অবহেলার সুযোগ নেই

আপডেট টাইম : ১০:২২:২৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ জুন ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই)-২০২২ বা পরিবেশ সুরক্ষা সূচক-২০২২।

 কানাডার এমসিকল ম্যাকবেইন ফাউন্ডেশনের সহায়তায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তৈরি করেছেন সূচকটি।

বিশ্বের ১৮০টি দেশের পরিবেশগত কার্যক্রমের তুলনা ও বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এটি। সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। বৈশ্বিক পরিবেশ সূচকে অনেকটা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের তলানিতে অবস্থানের কারণ নির্ণয় এবং এ অবস্থার উন্নতিতে কী করণীয়, তা আলোচনা করাই মূলত এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংক্ষেপে যার অর্থ দাঁড়ায়, ইপিআই-২০২২ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী টেকসইতার তথ্যভিত্তিক সারসংক্ষেপ। ১১ শ্রেণিতে ৪০টি কার্যসম্পাদন নির্দেশনাকে মানদণ্ড ঠিক করে ইপিআই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়ুর মান, জ্বালানি ও জলবায়ু, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ, ভারী ধাতু বা হেভি মেটাল, জীববৈচিত্র্য ও তাদের বসতি এলাকা, বনভূমি, মৎস্যসম্পদ এবং কৃষি খাত। এসব বিষয়ের প্রতিটিতে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে বিভিন্ন দেশের অবস্থানের ক্রমতালিকা বা ইপিআই র‌্যাংকিং তৈরি করা হয়েছে।

এবারের তালিকায় র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক, ১০০ নম্বরের মধ্যে দেশটির স্কোর ৭৭.৯০। এ তালিকার শীর্ষ দশে অন্তর্ভুক্ত অন্য দেশগুলো এবং তাদের স্কোর (বন্ধনীতে) হচ্ছে-যুক্তরাজ্য (৭৭.৭০), ফিনল্যান্ড (৭৬.৫০), মাল্টা (৭৫.২০), সুইডেন (৭২.৭০), লুক্সেমবার্গ (৭২.৩০), স্লোভেনিয়া (৬৭.৩০), অস্ট্রিয়া (৬৬.৫০) ও সুইজারল্যান্ড (৬৫.৯০)।

তালিকার সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা পাঁচটি দেশ হচ্ছে যথাক্রমে পাকিস্তান (২৪.৬০), বাংলাদেশ (২৩.১০), ভিয়েতনাম (২০.১০) মিয়ানমার (১৯.৪০) ও ভারত (১৮.৯০)। ১৮০টি দেশের মধ্যে এদের অবস্থান যথাক্রমে ১৭৬, ১৭৭, ১৭৮, ১৭৯ ও ১৮০।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। ইপিআই-২০২২ সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭। ২০১৮ সালের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৯। তবে ২০২০ সালে অবস্থানের উন্নতি ঘটে। ওই বছর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২তম। ইপিআই-২০২২ সূচকে বাংলাদেশ ১৫ ধাপ পিছিয়ে গেছে।

এমন নয় যে, পরিবেশ সংরক্ষণে দেশে আইনের অভাব রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণে আইন ও নীতিমালাগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ নীতি ১৯৯২, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বন আইন ১৯২৭, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ নিরাপত্তা) আইন ২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, ইট পোড়া আইন ১৯৮৯, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন ২০১৭, মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০, গবাদি পশু জবাই (বিধিনিষেধ) এবং মাংস নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৫৭, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর অধীনে প্রণীত শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬ ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রটোকল, যেগুলোয় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জলাভূমি রক্ষাসংক্রান্ত ‘রামসার কনভেনশন ১৯৭১’, জীববৈচিত্র্য রক্ষাবিষয়ক ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি ১৯৯২’, ওজোন স্তর রক্ষার্থে প্রণীত ‘মন্ট্রিয়েল প্রটোকল ১৯৮৭’, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসে স্বাক্ষরিত ‘কিয়োটো প্রটোকল ১৯৯৭’, জলবায়ু পরিবর্তনের রূপরেখাবিষয়ক ‘ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ১৯৯২’ প্রভৃতি। পরিবেশ সংরক্ষণে বাংলাদেশ তার প্রণীত নীতিমালা, আইন ও বিধি এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রটোকল বাস্তবায়নে এ যাবৎ তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

দেশে পরিবেশের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষিত কয়েকটি দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার প্রকাশিত ‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ৭৬.৯; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০-এর কম। বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।

আর রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবার নিচে দিল্লির পরই ঢাকার অবস্থান। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বসবাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে তৈরি প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে নিচের দিকে ছিল। ২০২১ সালে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান ছিল ১৩৭তম।

পরিবেশ দূষণের অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল-কলকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী ও প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার।

উপর্যুক্ত কারণগুলোর সঙ্গে আর যে কারণটি যুক্ত তা হলো, পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতার অভাব। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকাকালে আমি লক্ষ করেছি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক শিক্ষিত ও দায়িত্ববান ব্যক্তি পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে মোটেই সচেতন নন।

তাদের অনেকের বক্তব্য-আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ সংরক্ষণ। আরও যে বিষয়টি লক্ষ করেছি তা হলো, অনুল্লেখিত কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। এসব প্রকল্প একদিকে যেমন টেকসই হয় না, তেমনি অন্যদিকে পরিবেশকে দূষিত করে।

পরিবেশের এ করুণ অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় প্রণীত নীতিমালা, আইন, বিধি বাস্তবায়নে সরকারকে কঠোর হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পরিবেশকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন নয়। তার এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারকে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২০২৫) টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা অন্তর্ভুক্ত করে অর্থনৈতিক ও পরিবেশসংক্রান্ত পরিকল্পনার মধ্যে সংগতি বিধানের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-২০৪১) পরিবেশ খাতের উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে রয়েছে-ক. বিদ্যমান জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশগত বিষয়াবলির মধ্যে উপযুক্ত ভারসাম্য আনয়নে উদ্যোগ গ্রহণ; খ. যথোপযুক্ত নালা ও আধুনিক নর্দমা নির্মাণ ও যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শহরগুলোকে বন্যামুক্ত রাখার পাশাপাশি বিশুদ্ধ বায়ুর নিশ্চয়তা বিধান; গ. যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে দ্রুততম সময়ে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিশ্চিতকরণ; ঘ. পরিবেশসংক্রান্ত গভর্ন্যান্স নিশ্চিত করতে আইনগত নিয়মনীতি ও প্রণোদনার বিষয়গুলোর মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয় ঘটানো।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যাবলি এবং পরিবেশসংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ইত্যাদি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের পরিবেশ সুরক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। এ ব্যাপারে আর অবহেলার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে-এটাই দেশের জনগণের প্রত্যাশা।