হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনা অতিমারি ও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বই এখন খাদ্যনিরাপত্তা ও জ্বালানি সংকটে ভুগছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে পরিবহণ খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি। ফলে প্রতিটি দেশের আমদানি ব্যয় অপ্রত্যাশিত হারে বেড়ে গেছে। দেশীয়ভাবে মূল্যস্ফীতি তো আছেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতি। এ কারণে বিশ্ববাজারে দেখা দিয়েছে ডলার সংকট। আমাদের দেশও এ সংকট থেকে মুক্ত নয়। তাই সরকার বিলাসদ্রব্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করছে। এরই মধ্যে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমেছেও। তারপরও আগামী অল্পদিনের মধ্যে ডলার সংকট মিটে যাবে বলে মনে হয় না। তাই প্রতিটি দেশই নিজ নিজ অবস্থান থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রতি নজর রাখছে, বিদেশ থেকে ডলার নিজ দেশে প্রবেশের জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। সে প্রচেষ্টার নমুনা বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক ২০২২-২৩ সালে প্রস্তাবিত বাজেটেও দেখা গেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, মাত্র ৭ শতাংশ কর দিয়ে যে কোনো ব্যক্তি, যে কোনো পরিমাণ পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনলে তাকে কোনো ধরনের শাস্তি প্রদান বা জরিমানা করা হবে না। এমনকি অর্থের উৎস সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হবে না। অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের সুযোগ রাখা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তবে যেসব শাসকগোষ্ঠীর আইন প্রয়োগের সামর্থ্য ও সদিচ্ছা নেই, তাদের কাছে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার এটাই পথ।
আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি রপ্তানি ও প্রবাসী রেমিট্যান্স থেকে। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে পোশাক খাত শীর্ষে আর প্রবাসী রেমিট্যান্সের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০২১ সালে দেশে প্রবাসী রেমিট্যান্স এসেছে ২২ বিলিয়ন ডলার। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ লোক বিদেশে কর্মরত। প্রতিবছর দেশের শ্রমবাজারে প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ কাজের জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। তাদের পরিশ্রমের অর্থ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায়।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আমাদের প্রবাসী আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৭৮ সাল থেকে আমাদের শ্রমশক্তি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশ করে আসছে। শুরু থেকেই বেশ কয়েকবার সিন্ডিকেটের অভিযোগে মালয়েশিয়া শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। মালয়েশিয়া পৃথিবীর ১৩টি দেশ থেকে শ্রমিক নিলেও সিন্ডিকেটের অভিযোগ ওঠে কেবল বাংলাদেশের বেলায়। তারপরও অভিযোগের মীমাংসা করেই সময় কাটছিল। ২০১৬ সালে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল নাগাদ মালয়েশিয়া কর্তৃক তাদের সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি খাতে বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার কথা। এই পাঁচ বছরের আওতায় দেশটিতে লোক পাঠানোর অনুমতি পায় বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি। অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে এই ১০টি এজেন্সিকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে শ্রমিকদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০০ কোটি মালয়েশীয় রিঙ্গিত হাতিয়ে নেয় (১ রিঙ্গিত সমান ২১ টাকা ধরা হলে হাতিয়ে নেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। তখন শ্রমিকপ্রতি সরকার নির্ধারিত ব্যয় ছিল ৩৩ হাজার ৩৭৫ টাকা। কিন্তু সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রতি শ্রমিকের কাছ থেকে আদায় করেছে দুই লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। অভিবাসনের ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত ব্যয় ছিল আইএলও কনভেনশনের পরিপন্থি।
রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) জুনের প্রথম সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিক রপ্তানির কারণে দেশের বিপুল পরমাণ ক্ষতি হয়েছে। এই তিন বছরে শ্রমিক রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল ১৫ লাখ। কিন্তু হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ জন। এতে করে নিশ্চিত চাকরির সুযোগ হারিয়েছে প্রায় ১২ লাখ ২৫ হাজার কর্মী। অথচ ১২ লাখ শ্রমিকের মেডিকেল করানো হয়েছিল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার মাহাথির মুহাম্মদ সরকার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। তবে এর আগে যারা ভিসা পেয়েছিলেন, তারা পরেও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পান। সে সময়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি বৈধ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ লাখ।
গত তিন বছর ধরে সরকারের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করার পর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তিও সম্পাদিত হয়। শ্রমিক সংকটের কারণে মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীদেরও সেদেশের সরকারের ওপর চাপ ছিল। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে শ্রমিক নেওয়া হবে তা নির্ধারণে বিলম্ব হতে থাকে। তারপর আরও ৬ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এ মাসের শুরুতেই বাংলাদেশে আসেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি। তিনি গত ২ জুন আমাদের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, চলতি জুন মাস থেকেই মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু হবে। বাংলাদেশ থেকে আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ শ্রমিক নেবে বলে জানিয়েছে মালয়েশীয় সরকার। এর মধ্যে প্রথম বছরেই যাবে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। শ্রমিকদের বেতন ধার্য করা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩২ হাজার টাকা। জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় যাওয়ার অভিবাসন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার কিছু কম।
সুতরাং, উল্লিখিত বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি পুরোনো পথ নতুনভাবে উন্মোচিত হলো। কিন্তু খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আমাদের জন্য বন্ধ হয়েছিল, সে সমস্যা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। ফলে মালয়েশিয়ার সরকার পরিবর্তন হলে আমাদের শ্রমশক্তি আবারও সংকটের মুখে পড়তে পারে। তাই বাংলাদেশকে অধিকতর কৌশলী ও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে হবে।
২০১৮ সালে সমস্যা তৈরি হয়েছিল ১০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের কারণে। এবারে মালয়েশিয়া সরকার বলছে, তাদের পছন্দের ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হবে। আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের ১ হাজার ৫২০টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়ার কাছে দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনক্রমে বাছাই করে ২৫টি এজেন্সিকে অনুমোদন দেওয়া হবে, যাদের মাধ্যমে শ্রমিকরা বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যেতে পারবে। এর মানে হলো, ১০ জনের সিন্ডিকেটের পরিবর্তে ২৫ জনের সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা বলছে, এমন সিন্ডিকেট হলে দেশ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হতে পারে, অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যাবে, সরকার ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত। তাহলে সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ হবে।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সরকারকে প্রতিবছর ১৮ লাখ টাকা অনুমোদন ফি দেয়। অথচ কাজের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে মাত্র ২৫টির। এটি বিবেক-বিবেচনা বহির্ভূত সিদ্ধান্ত। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠায় এমন ১৩টি সোর্স কান্ট্রির মধ্যে কেবল বাংলাদেশের বেলায় এর ব্যত্যয় কেন? এর জবাবে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর বক্তব্য হলো, আমাদের সমঝোতা স্মারকে এমন শর্ত সংযুক্ত আছে। অথচ নেপালের ৮৫৮টি রিক্রুটিং এজেন্সির সবকটির শ্রমিক পাঠানোর সমান সুযোগ রয়েছে।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা বারবার বলে এসেছে, যদি সিন্ডিকেট তৈরি হয় তাহলে অর্থ পাচার বেড়ে যাবে। বর্তমান সরকার চাচ্ছে, অনেক ছাড় দিয়ে হলেও পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আসুক। সুতরাং অর্থ পাচারের নতুন সুযোগ তৈরি না করাই কাম্য। তাই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে ১ হাজার ৫০০ এজেন্সির সবকটির সমান সুযোগ রাখার প্রচেষ্টার বিকল্প নেই, অন্তত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে।
আশার প্রদীপ নিভে যায়নি। শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে পদ্ধতিগত দিকটি সেদেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবর্তন আনা সম্ভব। সরকারের প্রতি এ বিষয়ে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান রইল।