ঢাকা ০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের ‘নয়নভাগা’ রাষ্ট্রকেই না নি:শেষ করে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৫৩:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ মে ২০১৬
  • ২৮০ বার

“নয়নভাগা” শব্দটি কৃষকের জীবন আর প্রকৃতির অনুভূতির সাথেই সম্পর্কিত! এই শব্দটি শুনতে যেমন মাধুর্যে ভরা, ঠিক ততখানি নিষ্ঠুর কার্যক্ষেত্রে! জানি না এই শব্দটি কোন রসবোধসম্পন্ন কৃষকের মন থেকে জন্ম নিয়েছিল! তবে সময়ের সাথে সাথে কৃষক ছাড়াও নয়নভাগাদের সংখ্যা সমাজেও বেড়ে চলেছে।
হাওর অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবিকার প্রধান উৎস কৃষি। ধান একটি বড় উৎপাদিত পণ্য সেই সকল মানুষদের। ছয় মাস পানির নীচে থাকা জমিগুলোই শুকনা ঋতুতে হয়ে উঠে চাষযোগ্য জমি। কৃষক তার সর্বস্ব দিয়ে সেই ফসল ফলায়। হাওর এলাকায় একটি মাত্র ফসল তাই নিজেদের অর্থনৈতিক দুর্দশা আর প্রকৃতির হাসি- কান্নার সাথেই ভাগ্য জড়িয়ে থাকে কৃষকের। আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় সেই সকল কৃষকদের কৃষির প্রস্তুতি।
Haorপৌষ মাসে জমিতে ধানের চাড়া রোপন করে শুরু হয় পরিচর্যা। প্রতিবছর কৃষক আশা আর ভালবাসায় মাটিকে আঁকড়ে থাকে। প্রতি কৃষি কাজের সময় কৃষক ঋণ করে গ্রামের দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে। ফসল ঘরে উঠলে সুদে-আসলে সেই টাকা ফেরৎ দিবে সেই আশায়।
ফাল্গুনের বৃষ্টির দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে কৃষক। কখনও মিলে, কখনও মিলে না সেই বৃষ্টির পানি।
ডিপওয়েল দিয়ে পানি দিতে হয় সেই জমিতে। চৈত্র মাসে শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়। কৃষক প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকে করুণ দৃষ্টিতে! শিলা-বৃষ্টিতে শেষ হয়ে যায় কখনও, কখনো বা খরায় পুড়ে নষ্ট হয় ধান। আবার বাঁধের অভাবে প্রায়শই আগাম পানি ঢুকে ডুবিয়ে দেয় সোনা রঙের ধান।
মনে পড়ে ২০০৫/০৬ সালে আমাদের ছোট্ট নৌকাটি যখন পানির উপর দিয়ে যাচ্ছিল, পানির নীচে সোনা রঙের ধান গুলো হাসছিল আর আমার চোখে কেবল ভাসছিল গ্রামের মানুষগুলোর মুখ। পৌষ- মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে কৃষক এই ধানের চারাগুলো রোপন করেছিল। দাদনের টাকা সময় মতো ফিরিয়ে না দিলে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিতে পরের বছর।
টাঙ্গাইল থেকে আসা বেপারীরাও ফিরে যায় হাওরে পানি দেখে। গ্রামের যে সকল মানুষ খেটে খাওয়া, তারা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ডুব দিয়ে দিয়ে কেটে আনে সেই ধান। কার ধান কে কেটে নেয় তখন আর কোন হিসেব থাকে না।
Haor 2হাজার হাজার মন ধান চোখের সামনে ডুবে যায়, সেই সাথে ডুবে যায় কৃষকের স্বপ্ন! কৃষক বসে বসে সেই দৃশ্যটা দেখে, এর নামই “নয়নভাগা”।
বাংলার কৃষকের ভাগ্যটা যেন নয়নেই। ১ মন ধান উৎপাদন হবে ৯০০/১০০০ টাকায় আর ধানের দাম শুরু হবে ৪০০/৪৫০ টাকায়! প্রকৃতির হাসি-কান্না আর নিজের ঘাম দিয়ে যদিও বা কখনও ফসল কিছুটা মিলে, ধানের দাম মিলে না। ধান বিক্রি করার ক্রেতা মিলে না।
পরের বছর ঋণের বোঝা বাড়ে কৃষকের।কৃষি ব্যাংক প্রান্তিক চাষীদের কিছু ঋণ দেয় যদিও, স্থানীয় নেতাদের ঘুষ দিয়ে কিছুটা টাকা কৃষক হাতে পায় যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য।
যে কৃষক একসময় ধান, পাট, সরিষা, আলু, তিল-তিসি দিয়ে ঘর ভরতো, সেই কৃষক টিকে আছে কোনরকমে।
মাটির প্রতি যে কৃষকের ভালবাসা তা না থাকলে ফসলের জন্ম হবে না। অজ্ঞতার কারণে কৃষিতে তৈরি হচ্ছে বন্ধ্যাত্ব। আগে কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করতো, জৈবিক সার তৈরি করে জমিতে দিতো। পোকা- মাকড় নিধনে প্রাকৃতিক প্রতিরোধক তৈরি করতো। বাম্পার ফলনের লোভে বিভিন্ন কাক বন্ধ্যা কোম্পানি কৃষকের চিন্তায় যেমন বন্ধ্যাত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছে, তেমনি আমাদের মাটি, বীজ, প্রকৃতিকে করে তুলেছে স্থায়ী বন্ধ্যা। আগাছা বা পোকা মাকড় নিধনে যে বিষ ব্যবহার হচ্ছে মাটিতে, তার ফলস্বরূপ প্রকৃতি তার স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা হারিয়েছে। পরাগায়নের জন্য কীট-পতঙ্গ, সাপ, ইঁদুর, পেঁচা, ব্যাঙ, মাছ সব বিলুপ্তির পথে। এক কথায় ইকো সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে আমাদের অবৈজ্ঞানিক অজ্ঞতার কারণে। কৃষক সহ সাধারণ মানুষের এই সকল অজ্ঞতাকে পুঁজি করছে সেই মুনাফা লোভী হাইব্রিড কোম্পনিগুলো।
সরকারিভাবে কৃষকের উৎপাদনকে উৎসাহিত না করে আমদানী করা হয় চালসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য। খুবই ভয়ানক বিষয় দেশীয় বাজারে যখন দেশী পণ্যের সাথে বিদেশী পণ্য প্রতিযোগিতায় ফেলা হচ্ছে, ক্রেতা কম দামে বিদেশী পণ্য টাই ক্রয় করছে! ফলে দেশের কৃষকের পণ্যটি অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে।
দেশে কৃষি খাতকে আধুনিক করে, উৎপাদন বৃদ্ধি করে সরকারের পক্ষেই সম্ভব ছিল দেশের চাহিদা মিটানো। কৃষককে উৎসাহিত করে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানির জন্য ও দেশকে প্রস্তুত করতে পারতো সরকার।
চাল বিদেশ থেকে আমদানী করার আগে দেশের সকল কৃষকের ধান ন্যায্য মূল্যে সরকার কিনে নিলে কৃষক তার ঘামের মূল্যটুকু অন্তত ফেরত পায়। সেইসাথে কৃষি কাজে ব্যবহৃত পণ্যের বিষ ঢুকে যাচ্ছে আমাদের শরীরে, অসুস্থ মা জন্ম দিচ্ছে অসুস্থ শিশু কিংবা মেয়েরা হারাচ্ছে তাদের প্রজনন ক্ষমতা। আমরা অসুস্থ হচ্ছি প্রতিদিন নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে!
কৃষকের “নয়নভাগা” আজ আমাদের রাষ্ট্র জীবনেও ঢুকে গেছে আমাদের নিজেদেরই বিরূপ আচরণে।
সেই দায় প্রকৃতিকে যদি দিতে হয়, সবার আগে নিতে হবে আমাদের নিজেদের দায়। নয়তো পণ্য থেকে নাগরিক জীবন নয়ন দিয়েই ভাগ করে নিতে হবে, করার কিছুই থাকবে না বাকী দিন গুলোতে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরের ‘নয়নভাগা’ রাষ্ট্রকেই না নি:শেষ করে

আপডেট টাইম : ১২:৫৩:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ মে ২০১৬

“নয়নভাগা” শব্দটি কৃষকের জীবন আর প্রকৃতির অনুভূতির সাথেই সম্পর্কিত! এই শব্দটি শুনতে যেমন মাধুর্যে ভরা, ঠিক ততখানি নিষ্ঠুর কার্যক্ষেত্রে! জানি না এই শব্দটি কোন রসবোধসম্পন্ন কৃষকের মন থেকে জন্ম নিয়েছিল! তবে সময়ের সাথে সাথে কৃষক ছাড়াও নয়নভাগাদের সংখ্যা সমাজেও বেড়ে চলেছে।
হাওর অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবিকার প্রধান উৎস কৃষি। ধান একটি বড় উৎপাদিত পণ্য সেই সকল মানুষদের। ছয় মাস পানির নীচে থাকা জমিগুলোই শুকনা ঋতুতে হয়ে উঠে চাষযোগ্য জমি। কৃষক তার সর্বস্ব দিয়ে সেই ফসল ফলায়। হাওর এলাকায় একটি মাত্র ফসল তাই নিজেদের অর্থনৈতিক দুর্দশা আর প্রকৃতির হাসি- কান্নার সাথেই ভাগ্য জড়িয়ে থাকে কৃষকের। আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় সেই সকল কৃষকদের কৃষির প্রস্তুতি।
Haorপৌষ মাসে জমিতে ধানের চাড়া রোপন করে শুরু হয় পরিচর্যা। প্রতিবছর কৃষক আশা আর ভালবাসায় মাটিকে আঁকড়ে থাকে। প্রতি কৃষি কাজের সময় কৃষক ঋণ করে গ্রামের দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে। ফসল ঘরে উঠলে সুদে-আসলে সেই টাকা ফেরৎ দিবে সেই আশায়।
ফাল্গুনের বৃষ্টির দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে কৃষক। কখনও মিলে, কখনও মিলে না সেই বৃষ্টির পানি।
ডিপওয়েল দিয়ে পানি দিতে হয় সেই জমিতে। চৈত্র মাসে শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়। কৃষক প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকে করুণ দৃষ্টিতে! শিলা-বৃষ্টিতে শেষ হয়ে যায় কখনও, কখনো বা খরায় পুড়ে নষ্ট হয় ধান। আবার বাঁধের অভাবে প্রায়শই আগাম পানি ঢুকে ডুবিয়ে দেয় সোনা রঙের ধান।
মনে পড়ে ২০০৫/০৬ সালে আমাদের ছোট্ট নৌকাটি যখন পানির উপর দিয়ে যাচ্ছিল, পানির নীচে সোনা রঙের ধান গুলো হাসছিল আর আমার চোখে কেবল ভাসছিল গ্রামের মানুষগুলোর মুখ। পৌষ- মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে কৃষক এই ধানের চারাগুলো রোপন করেছিল। দাদনের টাকা সময় মতো ফিরিয়ে না দিলে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিতে পরের বছর।
টাঙ্গাইল থেকে আসা বেপারীরাও ফিরে যায় হাওরে পানি দেখে। গ্রামের যে সকল মানুষ খেটে খাওয়া, তারা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ডুব দিয়ে দিয়ে কেটে আনে সেই ধান। কার ধান কে কেটে নেয় তখন আর কোন হিসেব থাকে না।
Haor 2হাজার হাজার মন ধান চোখের সামনে ডুবে যায়, সেই সাথে ডুবে যায় কৃষকের স্বপ্ন! কৃষক বসে বসে সেই দৃশ্যটা দেখে, এর নামই “নয়নভাগা”।
বাংলার কৃষকের ভাগ্যটা যেন নয়নেই। ১ মন ধান উৎপাদন হবে ৯০০/১০০০ টাকায় আর ধানের দাম শুরু হবে ৪০০/৪৫০ টাকায়! প্রকৃতির হাসি-কান্না আর নিজের ঘাম দিয়ে যদিও বা কখনও ফসল কিছুটা মিলে, ধানের দাম মিলে না। ধান বিক্রি করার ক্রেতা মিলে না।
পরের বছর ঋণের বোঝা বাড়ে কৃষকের।কৃষি ব্যাংক প্রান্তিক চাষীদের কিছু ঋণ দেয় যদিও, স্থানীয় নেতাদের ঘুষ দিয়ে কিছুটা টাকা কৃষক হাতে পায় যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য।
যে কৃষক একসময় ধান, পাট, সরিষা, আলু, তিল-তিসি দিয়ে ঘর ভরতো, সেই কৃষক টিকে আছে কোনরকমে।
মাটির প্রতি যে কৃষকের ভালবাসা তা না থাকলে ফসলের জন্ম হবে না। অজ্ঞতার কারণে কৃষিতে তৈরি হচ্ছে বন্ধ্যাত্ব। আগে কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করতো, জৈবিক সার তৈরি করে জমিতে দিতো। পোকা- মাকড় নিধনে প্রাকৃতিক প্রতিরোধক তৈরি করতো। বাম্পার ফলনের লোভে বিভিন্ন কাক বন্ধ্যা কোম্পানি কৃষকের চিন্তায় যেমন বন্ধ্যাত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছে, তেমনি আমাদের মাটি, বীজ, প্রকৃতিকে করে তুলেছে স্থায়ী বন্ধ্যা। আগাছা বা পোকা মাকড় নিধনে যে বিষ ব্যবহার হচ্ছে মাটিতে, তার ফলস্বরূপ প্রকৃতি তার স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা হারিয়েছে। পরাগায়নের জন্য কীট-পতঙ্গ, সাপ, ইঁদুর, পেঁচা, ব্যাঙ, মাছ সব বিলুপ্তির পথে। এক কথায় ইকো সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে আমাদের অবৈজ্ঞানিক অজ্ঞতার কারণে। কৃষক সহ সাধারণ মানুষের এই সকল অজ্ঞতাকে পুঁজি করছে সেই মুনাফা লোভী হাইব্রিড কোম্পনিগুলো।
সরকারিভাবে কৃষকের উৎপাদনকে উৎসাহিত না করে আমদানী করা হয় চালসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য। খুবই ভয়ানক বিষয় দেশীয় বাজারে যখন দেশী পণ্যের সাথে বিদেশী পণ্য প্রতিযোগিতায় ফেলা হচ্ছে, ক্রেতা কম দামে বিদেশী পণ্য টাই ক্রয় করছে! ফলে দেশের কৃষকের পণ্যটি অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে।
দেশে কৃষি খাতকে আধুনিক করে, উৎপাদন বৃদ্ধি করে সরকারের পক্ষেই সম্ভব ছিল দেশের চাহিদা মিটানো। কৃষককে উৎসাহিত করে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানির জন্য ও দেশকে প্রস্তুত করতে পারতো সরকার।
চাল বিদেশ থেকে আমদানী করার আগে দেশের সকল কৃষকের ধান ন্যায্য মূল্যে সরকার কিনে নিলে কৃষক তার ঘামের মূল্যটুকু অন্তত ফেরত পায়। সেইসাথে কৃষি কাজে ব্যবহৃত পণ্যের বিষ ঢুকে যাচ্ছে আমাদের শরীরে, অসুস্থ মা জন্ম দিচ্ছে অসুস্থ শিশু কিংবা মেয়েরা হারাচ্ছে তাদের প্রজনন ক্ষমতা। আমরা অসুস্থ হচ্ছি প্রতিদিন নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে!
কৃষকের “নয়নভাগা” আজ আমাদের রাষ্ট্র জীবনেও ঢুকে গেছে আমাদের নিজেদেরই বিরূপ আচরণে।
সেই দায় প্রকৃতিকে যদি দিতে হয়, সবার আগে নিতে হবে আমাদের নিজেদের দায়। নয়তো পণ্য থেকে নাগরিক জীবন নয়ন দিয়েই ভাগ করে নিতে হবে, করার কিছুই থাকবে না বাকী দিন গুলোতে।