নাটোর এখন ফুলের শহর। রাস্তার দু’ধারে শত শত কৃষ্ণচূড়ার গাছে ফুলের সমারোহ রঙ ছড়িয়ে হয়েছে নানা বর্ণময়। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের পাশাপাশি এসব গাছ দিচ্ছে ক্লান্ত দেহে ছায়া আর মনে প্রশান্তির পরশ।
চলনবিলের শস্যরাজি, রাণী ভবানীর রাজত্ব, বনলতা সেনের কবিতার শব্দমালা, কাঁচাগোল্লার স্বাদেই শুধু নাটোরের পরিচিতি নয়। এক সময় নাটোরের পরিচিতি ছিলো দুষ্প্রাপ্য ফুলের শহর হিসেবেও। নাটোরের সৌখিন রাজন্যবর্গ তাদের রাজবাড়ী চত্বরকে সাজাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসেন অসংখ্য ফুল গাছ। গড়ে তোলেন পুষ্প রাজত্ব। নাটোরের রাণী ভবানী রাজবাড়ী আর উত্তরা গণভবনে এখনো শোভা বর্ধন করছে নাগালিঙ্গম, ম্যাগনোলিয়া, হৈমন্তি সুরভিকা, এগপ্লান্ট, কর্পূর, পারিজাতের মত বিলুপ্ত প্রায় ফুলের গাছ। রাজাদের দেখাদেখি প্রজারাও ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। দু’দশক আগেও নাটোর শহরের অসংখ্য বাড়ীকে শোভাবর্ধন করতো ফুলের বাগান। জীবনের জটিলতা আর দ্রুত নগরায়নে শহরে ফুলের বাগান কমতে শুরু করেছে।
অতীত ঐতিহ্যকে বহমান রাখতে ২০০২ সালে স্বজন সমাবেশ নামে স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠন ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ গ্রহণ করে। নাটোর পৌরসভার সহযোগীতায় সারা শহরে রাস্তার দু’ধারে রোপন করা হয় দু’হাজার স্থায়ী ফুলের গাছ। এর বেশীরভাগ ছিলো কৃষ্ণচূড়া, পাশাপাশি কাঞ্চন, সোনালু, কদম ইত্যাদি।
নাটোর স্বজন সমাবেশের তৎকালীন সভাপতি ডাঃ আব্দুল হামিদ বলেন, পুষ্পিত নাটোর কর্মসূচির আওতায় রোপিত ও সংরক্ষিত গাছগুলোর শতভাগ আমরা বাঁচাতে পারিনি। শতভাগ গাছ রক্ষা করতে পারলে যথার্থই নাটোর হয়ে উঠতো পুষ্পিত নাটোর। সংগঠনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বাবন বলেন, কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিলো বসন্তে কাঞ্চন, গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু আর বর্ষায় কদম শহরে রং ছড়াবে। তবে শহরে কৃষ্ণচূড়া গাছ ব্যাপকভাবে টিকে থাকলেও অন্য গাছগুলো অনুরূপ বাঁচেনি। তবে গ্রীষ্মের নাটোর শহর কৃষ্ণচূড়ার রঙে সুশোভিত।
শহরের জিরো পয়েন্টে ইউনাইটেড মেডিক্যাল হল ও টাউন মেডিক্যাল হলের সামনে রোপিত তিনটি কৃষ্ণচূড়া গাছের পাড় বাঁধাই করে দিয়েছেন স্থানীয়রা। ইউনাইটেড মেডিক্যাল হলের সত্ত্বাধিকারী আলহাজ্ব ফজলুল হক বলেন, গাছের ছায়ায় আমাদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে গরমের দিনে অনেক স্বস্তি পাই। আর এর ছায়ায় বসেছে চায়ের দোকান, পিয়াজু-বেগুনীর দোকান এবং কাপড়ের দোকান। উন্মুক্ত চায়ের দোকানে সব সময় ভিড় লেগে থাকে।
দোকানদার নবাব বলেন, বন্ধ স্টলের চেয়ে গাছের ছায়ায় খোলামেলা স্থানে অনেকেই চা খেতে পছন্দ করেন। খরচ শেষে প্রতিদিন তাঁর গড় মুনাফা ৬০০ টাকা।
শহরের কানাইখালী এলাকার ওয়ার্কশপের সামনে গাছগুলোর ছায়া শ্রমজীবীদের জন্য স্বস্তির উৎস। কবির এন্টারপ্রাইজে কর্মরত আফছার আলী বলেন, প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর এই গাছগুলোর ছায়া ও বাতাস খুবই স্বস্তির। পুষ্পিত নাটোরের সবচে সার্থক এলাকা শহরের হাফরাস্তা। এখানে কৃষ্ণচূড়ার গাছে গাছে যেন আগুন লেগেছে।
গাছের ছায়ায় জিড়িয়ে নেয়া ভ্যান চালক বাচ্চু মিয়া বলেন, ভ্যান চালিয়ে ক্লান্ত হলে গাছের ছায়ায় একটু জিড়িয়ে শরীর ঠাণ্ডা করি।
শহরের হাফরাস্তা মহল্লার বাসিন্দা নাটোর সিটি কলেজের প্রভাষক নাজমুন নাহার সাথী বলেন, গ্রীষ্মের এ খরতাপে দু’দণ্ড শান্তির পরশ শহরের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো। এতো রঙের বর্ণচ্ছটা অন্য শহরে আর আছে বলে আমার জানা নেই।
নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি বলেন, শহরের যেসব স্থানে ফুলের গাছ নেই সেসব স্থান পূরণ করে ভবিষ্যতে আমরা নাটোরকে প্রকৃতই পুষ্পিত নাটোর করে তুলতে চাই।
নাটোরের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার মুখার্জী পুষ্পিত নাটোরের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সবাই তাদের বাড়ির সামনে ফুলের গাছ রোপণ করে শহরকে ফুলের শহরে পরিণত করার অনুরোধ জানান।
সূত্র : বাসস