শবেবরাত : প্রামাণ্য দলিল? মুফতি মুহাম্মদ আবদুল লতিফ শেখ

হিজরি বছরের অষ্টম মাস শাবানের মধ্যবর্তী রজনী তথা ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবেবরাত বলা হয়। হাদিসের ভাষায় ‘লায়লাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবানের মধ্যবর্তী রাত বলা হয়। পবিত্র এ রজনীতে বিশ্ব মুসলিম গোনাহ মাফের আশায় নামাজ, জিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে।
শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনীর নাম যাই হোক না কেন, এ রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত ইসলামী শরিয়তে প্রমাণিত। যদিও এ রাতে করণীয় সুনির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের বর্ণনা বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত নেই। কিন্তু সাধারণভাবে যে কোনো ইবাদতের মাধ্যমেই এ রাতটি উদযাপন করা যায়। উম্মতের বড় বড় ফুকাহায়ে কেরাম এ রাতে জেগে ইবাদত করাকে মোস্তাহাব বলে অভিহিত করেছেন।
বর্তমানে ওলামায়ে কেরাম শবেবরাতে ইবাদত করা নিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম কুসংস্কার বাদ দিয়ে সাধারণভাবে এ রাতে ইবাদত করার পক্ষপাতী হলেও কিছু আলেম এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। বস্তুত শবেবরাতে প্রচলিত কিছু কুসংস্কারই তাদের এ ব্যাপারে কঠোর বক্তব্য দিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ইনসাফ হলো সত্যকে সত্য বলা এবং মিথ্যাকে সমর্থন না করা। তাই উচিত হলো_ কোনো ধরনের কুসংস্কারে লিপ্ত না হয়ে ইবাদত, দোয়া ও এস্তেগফারের মাধ্যমে এ রাত কাটানো। আর এটাই সর্বোত্তম মত। এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে প্রমাণ বিদ্যমান। যেমন_
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হা-মিম, স্পষ্ট কিতাবের শপথ, নিশ্চয় আমি উহা লায়লাতুম মুবারাকা বা বরকতময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বণ্টন করা হয়। (সূরা দোখান : ১-৪)। এ আয়াতে ‘বরকতময় রজনী’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা নিয়ে মোফাসসিরদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.)সহ অধিকাংশের মতে, বরকতময় রজনী বলতে শবেকদরকে বোঝানো হয়েছে, যা রমজান মাসে অবস্থিত। তবে ইবনে আব্বাস (রা.) এর শিষ্য হজরত ইকরামা (রহ.) এর মতে, এর দ্বারা ‘শাবানের মধ্যবর্তী রাত’কে বোঝানো হয়েছে। যদিও ওলামায়ে কেরাম প্রথম মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু শবেবরাতের ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় এ রাতের বরকতকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে কথা হলো, কোরআনের এ আয়াত দ্বারা শবেবরাত প্রমাণিত না হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, এর কোনো অস্তিত্ব ইসলামে নেই। যেমনটা কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন।
সত্যি কথা হলো, শবেবরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যদিও এ বিষয়ে কিছু বানোয়াট কথাও বর্ণিত আছে, কিন্তু এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি সহিহ হাদিসও রয়েছে, যা এ রাতের ফজিলতময়তার প্রমাণে যথেষ্ট।
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহ তায়ালা মাখলুকাতের প্রতি বিশেষ নজর দেন। অতঃপর মোশরেক (আল্লাহর সঙ্গে শিরক স্থাপনকারী) এবং মুশাহিন (মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে হিংসাবশত সম্পর্কছেদকারী) ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ ইবনু হিব্বান : ৫৬৬৫)। মুহাক্কিক আল্লামা শুয়াইব আরনাউত বলেন, হাদিসটি সহিহ। সুনানে ইবনে মাজাহতে এ হাদিসটি অপর সাহাবি হজরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। (হাদিস : ১৩৯০)। নাসিরুদ্দীন আলবানি বলেন, হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনীতে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে অবস্থান করেন। অতঃপর মোশরেক এবং হিংসুক ব্যতীত তার সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ১২৯৫৭) হায়ছামি (রহ.) বলেন, হাদিসটির বর্ণনাকারীরা বিশ্বস্ত)।
হজরত আবু সালাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদের দিকে এক বিশেষ নজর দেন। অতঃপর মোমিনদের ক্ষমা করেন, কাফেরদের অবকাশ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা ত্যাগ না করা পর্যন্ত পরিত্যাগ করেন। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ১২৮৬২)।
এ হাদিসগুলো দ্বারা বোঝা যায়, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনী অন্যান্য রজনীর ন্যায় সাধারণ কোনো রজনী নয়, বরং এর ফজিলত রয়েছে। আর তা হলো এ রাতে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদের ক্ষমা করে থাকেন। তাই কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির উচিত নয় এ রাতকে অবহেলা করা। বরং উচিত হলো, এ রাতে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগি করে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। যাতে তিনি দয়া করে ক্ষমা করেন।
হজরত মা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক রজনীতে আমি রাসুল (সা.) কে বিছানা থেকে হারিয়ে ফেললাম। আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখি তিনি বাকি গোরস্তানে আছেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে, আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার সঙ্গে বেইনসাফি করবেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গেছেন। তিনি বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা শাবানের মধ্যবর্তী রজনীতে দুনিয়ার আসমানে অবস্থান করেন এবং বনি কালব গোত্রের ছাগলের পশমের চেয়ে বেশি মানুষকে ক্ষমা করেন। (জামে তিরমিজি : ৭৩৯)। ওই হাদিসটি মুসান্নাফে আবি শায়বাতেও আছে। সেখানে বলা আছে, মহানবী (সা.) বাকি গোরস্তানে দুই হাত তুলে দোয়া করছিলেন। (হাদিস : ৩০৪৭৮)। আলবানি বলেন, তিরমিজির হাদিসটি জয়িফ। তবে এতে কোনো সমস্যা নেই। কেননা মূল ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তাই হাদিস শাস্ত্রের মূলনীতি মোতাবেক সহিহ এর আওতায় জয়িফ বা দুর্বল বর্ণনাও গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া এ হাদিসের দুর্বলতাও মারাত্মক নয়।
আয়েশা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনীতে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দার প্রতি নজর দেন। অতঃপর ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন, দয়াপ্রার্থীদের দয়া করেন আর হিংসুকদের তাদের স্বীয় অবস্থায় ফেলে রাখেন।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৩৮৩৫; ইমাম বায়হাকি (রহ.) বলেন, হাদিসটি মুরসালে জাইয়্যেদ)।
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, যখন শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত আসে তোমরা ওই রাতে নামাজ আদায় করো এবং পরের দিন রোজা পালন করো। কেননা সে রাতে ফজর পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা বলতে থাকেন, আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কি কোনো রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। আছে কি কোনো প্রার্থনাকারী? আমি তাকে তার কাম্য বিষয় দেব। (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি : ৩৮২২)।
এ হাদিস এবং আগের হাদিস প্রমাণ করে যে, শবেবরাতে নফল নামাজ পড়া মোস্তাহাব। এটি রাসুল (সা.) এর আমল। তাছাড়া আগের সহিহ হাদিসগুলোয় যেখানে এ রাতকে ‘ক্ষমার রাত’ বলা হয়েছে সেগুলো দ্বারাও এ রাতে নফল আমল করার অনুমোদন পাওয়া যায়।
 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর