সরেজমিন দেখা গেছে, হাওর জুড়ে এখন সোনালি ধানের সমারোহ। দেখতে দেখতে সবুজ রং বদলে সোনালি রং ধারণ করে এখন ঘরে তোলার উপযুক্ত দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের ফসল। আর ক’দিন পরই ধুম পড়বে ধান কাটার। হাজার হাজার কৃষক ও কৃষি শ্রমিক এখন ফসলের মাঠে। চলছে ক্ষেতের ধান গোলায় তোলার জোর প্রস্তুতি। আর এই সময়টাতে কৃষকের চোখে-মুখে থাকার কথা আনন্দের ঝিলিক।
কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শঙ্কায় হাওরে বিনিদ্র রাত কাটছে কৃষকের। চোখের সামনে আধাপাকা ধান কেড়ে নিচ্ছে ঘোলাজল। বাঁধ উপছে পানি প্রবেশ করছে ফসলের মাঠে। এ অবস্থায় হাহাকার পড়েছে হাওরের মাঠে মাঠে। চরম উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠা ঘিরে ধরেছে তাদের। খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরে একটি মাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল এ এলাকার জীবনধারা। বোরো ধানের আয়ে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের সংসার চলে। ধানের ওপর নির্ভর করেই চলে পুরো বছরের ভরণ-পোষণ, আর সন্তানের লেখাপড়ার খরচ। সেই সঙ্গে মহাজনের ঋণ পরিশোধ। কিন্তু অসময়ে আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যাওয়ায় চোখ-মুখে অন্ধকার দেখছেন এ এলাকার কৃষকরা।
পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওরে অন্তত পাঁচ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ায় আগামীর দুর্ভাবনায় চোখে অন্ধকার দেখছেন কৃষকরা। ফসল তলিয়ে যাওয়ায় উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে খাদ্য উদ্বৃত্ত কিশোরগঞ্জ জেলা জুড়ে।
অতিবৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের পাঁচটি হাওর উপজেলায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি। ধনু, ঘোড়াউত্রা, কালনি, কুশিয়ারাসহ প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি কয়েক দিন ধরে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে বইছে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ও উপচে পড়ে নতুন নতুন এলাকার বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও করিমগঞ্জে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে অন্তত পাঁচ হাজার হেক্টর বোরো জমির ধান সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। পানি বাড়তে থাকায় আশঙ্কার মধ্যে আছে আরও হাজার হাজার হেক্টর জমি। হাওরের কৃষক দিন-রাত চেষ্টা করে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নদীর পানি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় বাঁধ উপচে জমিতে প্রবেশ করছে ঢলের পানি।
জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের বড় আবদা পুবের হাওরে তিন হাজার হেক্টর জমির কাঁচা-পাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ধান কাটার আগ মুহূর্তে জমির ধান তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। গেল সপ্তাহের টানা পাঁচ দিনের ভারি বৃষ্টির পর উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওর অঞ্চলের কালনী, কুশিয়ারা, মেঘনা, খোয়াই, ধলেশ্বরী, চরদেওঘর, কলমার বাক-বলাকা, বৈঠাখালী-ঘোড়াউত্রাসহ অন্যান্য নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খয়েরপুর আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের মেঘনা ও খোয়াই নদীর শাখাসংযুক্ত রবিউল্লাহর বাঁধ, কালিচরের বাঁধ এবং বাইরার বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে খয়েরপুর আবদল্লাহপুর এলাকার কৃষক আ. রউফ জানান, এরই মধ্যে অনেক ফসল তলিয়ে গেছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে বাকি ফসলও রক্ষা করা যাবে না।
ইটনা উপজেলাও একই অবস্থা। ইটনা উপজেলার কৃষক ইদ্রিস আলী জানান, ‘ভাই কি বলবো মনের কথা, মন ত গেছে পানির তলে দুইব্বা’ ‘আর সরকার ধানের দর দিতেছে কমাইয়া’ ‘এহন সরকার যদি ধানের দর বাড়াইয়া দিতো তাহলে পানির তলে যে ধান ডুবছে সেই ধান থেকে কিছু লইতাম লইয়া জি’পুত লইয়া চলতাম’। ‘এই অবস্থা যদি হয় তাহলে আমরা কই গে ভাত পামো না ভোলাগঞ্জে না ঢাহায় গে ভাত পামো’ ‘আর জমি থাকবো সব পতিত পইরা’। ‘আমরা যদি এই জমি আবাদ না করি তাহলে আমরা কি ভাবে চলাম’। ‘তাই সরকারের কাছে আমরার অনুরোধ সরকার যেন ধানের দর বারাইয়া দেয়’ ‘আমরা যেন জি’পুত লইয়া চলতে পারি’ ‘তাদের লেহাপড়া যাতে করাইতে পারি’ এই আমার কথা।
অন্যদিকে কৃষক সফির উদ্দিন গানের তালে তালে বললেন, ‘সর্বনাশ হয়ছেরে সর্বনাশ’ ‘১০০ একর জমি গো নিছে পানিরের তলে গো’ ‘কি খাইয়া বাচাম মাগো আমরা এহন’ ‘১০০ একর জমি গো নিছে পানিরের তলে গো’ ‘সন্তান লইয়া এহন কই যাইমো গো আমরা’ ‘ধান চাওলের দর কম’ ‘সবজিনিসের দাম বেশি গো’ ‘১০০ একর জমি গো নিছে পানিরের তলে গো’ ‘দেশে চাষীদের বাচবার মত কনো বাও নাই গো’ ‘আমরা অহন কই যামো পুলাপান লইয়া গো’।
মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ও কাটাখাল ইউনিয়নের কড়ালকান্দি হাওরে পানিতে তলিয়ে গেছে আড়াইশ হেক্টর জমি। ইটনায় বাদলা ও জয়সিদ্ধি ইউনিয়নে বাঁধ ভেঙে এবং পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান। এ দিকে টানা পাঁচ দিনের ভারি বৃষ্টির পানিতে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার গুরুই ইউনিয়নের ভোলার হাওর ও রোয়াবিলের প্রায় ১৯৫ হেক্টর বোরো জমির পাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া করিমগঞ্জ ও কুলিয়ারচর উপজেলায় ঢলের পানিতে ১৩০ হেক্টর বোরো জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহকারী উপ-পরিচালক মো. শফিকুর ইসলাম জানান, তাদের হিসাব মতো-এ পর্যন্ত পাঁচটি হাওর উপজেলায় প্রায় চার হাজার হেক্টর বোরো জমি অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। তিনি আরোও জানান, নদ-নদীর পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে হাওরের বিশাল এলাকার ফসলি জমি হুমকিতে রয়েছে। তবে জেলা খামারবাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গত চার দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। আবহাওয়া ভালো থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমতে পারে।
এবার বোরো মৌসুমে জেলার ১৩টি উপজেলায় ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এসব জমি থেকে ৬ লাখ ৫৮ হাজার ১২১ টন চাল উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে কাঙ্ক্ষিত উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।