২০২২ সালে নতুন বছরে ভালোয় শেয়ারবাজারের প্রত্যাশা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিদায়ী ২০২১ সালের শুরুটা দুর্দান্ত হলেও শেষটা ভালো হয়নি দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য। এই সালের প্রথম নয় মাসই বেশ চাঙা ছিল শেয়ারবাজার। কিন্তু শেষ দুই মাস অনেকটা টানা পতনের মধ্য দিয়ে পার করেছে। ফলে হাসিমুখ নিয়ে বছরের প্রথমার্ধ পার করলেও শেষদিকে হাহুতাশ করেই কেটেছে বিনিয়োগকারীদের।

তবে নতুন বছরের (২০২২) শুরুটা আবারও দুর্দান্ত হয়েছে বিনিয়োগকারীদের জন্য। ২০২২ সালের প্রথম সপ্তাহ বড় ধরনের উত্থান দিয়ে পার করেছে শেয়ারবাজার। এতে আবারও নতুন করে লোকসান কাটিয়ে মুনাফা করার স্বপ্ন দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। আশা করছেন, এ বছর ভালো শেয়ারবাজার পাবেন তারা। এমনকি শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরাও আশা করছেন ২০২২ সালে শেয়ারবাজার বেশ ভালো যাবে।

তাদের অভিমত, ২০২১ সালের শেষদিকে শেয়ারবাজার কিছুটা নেতিবাচক ধারায় থাকলেও সার্বিকভাবে বছরটি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো ছিল। বছরের প্রথম নয় মাস বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে যথেষ্ট মুনাফা তুলে নিতে পেরেছেন। তব শেষদিকে এসে কিছুটা লোকসানের মধ্যে পড়েন বিনিয়োগকারীরা।

তারা আরও বলছেন, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। করোনার তাণ্ডবে অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা নেমে এসেছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে। এছাড়া ২০২১ সালের শেষদিকে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন হওয়ায় অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশ কমে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে এখন বাজার বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। সুতরাং সামনে শেয়ারবাজার আরও ভালো হবে এমনটা আশা করা যায়।

বিনিয়োগকারী ইব্রাহিম হোসেন বলেন, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শেয়ারবাজারের সঙ্গে আছি। শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের মহাধস দেখেছি। সেই সময় যে ক্ষতির মধ্যে পড়েছিলাম, তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ২০২১ সালের প্রথম কয়েক মাস ভালো ব্যবসা হয়েছে। কিন্তু বছরের শেষ তিন মাস আবার লোকসান করেছি। সে হিসেবে ২০২১ সাল আমার জন্য ছিল মিশ্র।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের শেষ দুই মাস যে হারে পতন হয়েছে তাতে অনেক পুঁজি হারিয়েছি। নতুন বছরেও যদি বাজার পতনের মধ্যে থাকে, তবে পথে নামতে হবে। আশা করছি, এ বছর বাজার ভালো যাবে। বছরের শুরুটা যেমন হয়েছে, শেষটাও যেন তেমন হয় এ প্রত্যাশা করছি।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম শেয়ারবাজার ভালো করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। আশা করি, নতুন বছরেও কমিশন শেয়ারবাজার ভালো করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে। বিশেষ করে ভালো মানের আইপিও যেন আসে সেজন্য কমিশনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

মো. মশিউর রহমান নামে আরেক বিনিয়োগকারীরা বলেন, শেয়ারবাজারে কখন কী হয় বলা মুশকিল। তবে আশা করছি ২০২২ সাল শেয়ারবাজারের জন্য ভালো যাবে। ২০২১ সালের শেষদিকে বাজার কিছুটা নেতিবাচক থাকলেও সার্বিকভাবে বছরটি আমাদের জন্য ভালো গেছে। ২০১০ সালের ধসের পর শেয়ারবাজারে যে ক্ষত হয়েছে তা এখনো শুকায়নি।

তিনি বলেন, বিএসইসির চেয়ারম্যান একাধিকবার বলেছেন শেয়ারবাজারে আর ২০১০ সালের মতো ঘটনা ঘটবে না। আমরা তার কথার ওপর আস্থা রাখতে চাই। এজন্য কমিশনকে আরও তৎপর হতে হবে। কারসাজি চক্র যাতে বাজার থেকে ফায়দা লুটে নিতে না পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

বর্তমানে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়েছে কিছু চক্র। এগুলো কারা করছে, সে সংক্রান্ত গুঞ্জন বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে ঘুরছে। কিন্তু কমিশন তাদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটা ভালো লক্ষণ নয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে হলে এসব চক্রের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যবস্থা নিতে হবে।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী   বলেন, ২০২১ সালের শেষদিকে বাজার কিছুটা নিম্নমুখী থাকলেও সার্বিকভাবে বছরটি ভালো গেছে। আমরা আশা করছি নতুন বছরে শেয়ারবাজার ভালো হবে। কারণ দেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে রয়েছে। আবার গত দুই মাসের দরপতনে অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমে গেছে। এখন বাজারে কেনার উপযোগী অনেক শেয়ার আছে। তাছাড়া নতুন নতুন আইপিও আসছে। এতে বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়বে। তাই অস্বাভাবিক কিছু না হলে নতুন বছরে শেয়ারবাজার বেশ ভালো থাকবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম নেতৃত্বাধীন বিএসইসির বর্তমান কমিশন শেয়ারবাজারের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করছি, নতুন বছরে দেশের শেয়ারবাজার ভালো থাকবে। আমরা এটাও প্রত্যাশা করছি নতুন বছরে বিএসইসি ভালো মানের আইপিও আনবে। কারণ তারা বিভিন্ন দেশে রোডশ’ করেছে। ভালো মানের কোম্পানির আইপিও আনতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা যাবে। আর বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে বাজারও ভালো হবে।

উল্লম্ফনে শুরু বছর
নতুন বছরের প্রথম কার্যদিবসেই দেশের শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন ঘটে। প্রথমদিনের লেনদেনেই প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৯৬ পয়েন্ট বেড়ে যায়। বছরের প্রথম কার্যদিবসে দেখা দেওয়া বড় উত্থান বছরের প্রথম সপ্তাহজুড়েই অব্যাহত থাকে। এতে বছরের প্রথম সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক বেড়েছে ২৩০ পয়েন্ট। বাজার মূলধন বেড়েছে ১৫ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বেড়েছে লেনদেনের গতি। হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন আবারও হাজার কোটি টাকায় ফিরে এসেছে। নতুন বছরের প্রথম পাঁচ কার্যদিবসের চার কার্যদিবসেই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।

ফিরে দেখা ২০২১
২০২১ সালের প্রথম কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক বাড়ে ২১৬ পয়েন্ট। লেনদেন হয় ১ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। বছরের প্রথম কার্যদিবসে এমন চাঙাভাব পরের কয়েক মাসও অব্যাহত থাকে। ফলে রেকর্ড অবস্থানে উঠে আসে মূল্যসূচক। সেই সঙ্গে একমাত্র লেনদেন ছাড়া সব ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় নতুন রেকর্ড। অবশ্য ডিএসইতে ২০১০ সালের পর সর্বোচ্চ লেনদেনের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু বছরের শেষটা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো হয়নি। মূলত শেষ দুটি মাস অনেকটা পতনের মধ্যদিয়েই পার করেছে শেয়ারবাজার। এরপরও সার্বিকভাবে ২০২১ সালটা শেয়ারবাজারের জন্য ভালোই কেটেছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আসা কোম্পানির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে গড় লেনদেন। সেই সঙ্গে বেড়েছে মূল্যসূচক। বাজার মূলধনও বেড়েছে বছরটিতে।

আইপিও
২০২১ সালে একটি সুকুক বন্ড (ইসলামিক শরিয়াহভিত্তিক বন্ড) ও ১৪টি কোম্পানিসহ মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠান আইপিওর মাধ্যমে বাজার থেকে ১৬৫৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ২৯৭ কোটি ৭৩ টাকা মূলধন উত্তোলন করে। এছাড়া চারটি প্রতিষ্ঠান বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। ২০২০ সালে আটটি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে।

লেনদেন
২০২১ সালে ডিএসইতে ২৪০ কার্যদিবস লেনদেন হয়। এতে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ ৫৪ হাজার ৫২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা ডিএসইর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন এবং ২০২০ সালের তুলনায় ১৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালে ডিএসইতে দুই লাখ ১৯ হাজার ৭১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার লেনদেন হয়।

মূল্যসূচক
২০২১ সালে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স এক হাজার ৩৫৪ পয়েন্ট বা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বছর শেষে সূচকটি দাঁড়ায় ছয় হাজার ৭৫৬ পয়েন্টে। অবশ্য ১০ অক্টোবর এ সূচকটি সর্বোচ্চ সাত হাজার ৩৬৮ পয়েন্ট পর্যন্ত উঠেছিল। ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করার পর এখন পর্যন্ত এটিই সূচকটির সর্বোচ্চ অবস্থান।

প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত সূচকটিও এ বছর রেকর্ড সৃষ্টি করে। ৬ অক্টোবর সূচকটি সর্বোচ্চ দুই হাজার ৭৮৭ পয়েন্টে ওঠে। অবশ্য বছরের শেষদিকে বাজার নিম্নমুখী থাকায় বছর শেষে সূচকটি দাঁড়ায় দুই হাজার ৫৩২ পয়েন্টে। এরপরও বিদায়ী বছরটিতে এ সূচকটি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৫৬৮ পয়েন্ট বা ২৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

ডিএসইর আরেক সূচক ডিএসই শরিয়াহ্ ২০২১ সালজুড়ে বেড়েছে ১৮৯ পয়েন্ট বা ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এতে সূচকটি এক হাজার ৪৩১ পয়েন্টে উঠে বছর শেষ করে। অবশ্য ৬ অক্টোবরে সূচকটি রেকর্ড এক হাজার ৬০০ পয়েন্ট পর্যন্ত উঠেছিল।

বাজার মূলধন
সূচকের মতো ২০২১ সালে বাজার মূলধনেও নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ডিএসইর বাজার মূলধন ইতিহাসে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৮ কোটি টাকায় উঠে যায়। তবে বছরের শেষদিকে কিছুটা দরপতন হওয়া বছর শেষে বাজার মূলধন দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৪২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এরপরও বছরটিতে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ৯৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর