হাওর বার্তা ডেস্কঃ সমাজে বাঁকা চোখে তাকানো মানুষগুলোর সংখ্যা একটু বেশিই। সাধারণ বিষয়টাকেও সহজভাবে গ্রহণ না করাটা যেন তাদের অভ্যাসের বাইরে। এক্ষেত্রে যদি কেউ শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার হন তাহলে তো আর কথাই নেই! সমাজ যেন তাকে গ্রহণই করতে চায় না। সে যেন ভিন্ন জগতের এক মূল্যহীন প্রাণী।
আর তখন প্রতিবন্ধকতার শিকার ওই ব্যক্তি নিজেই বোঝা হয়ে দাঁড়ায় নিজের কাছে। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে, সে সমাজের কাছে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কি না। আর এমন চিন্তার কোনো সহজ উত্তর না পেলে নিয়ে নেয় কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত। যা অনেক সময় আত্নহত্যা পর্যন্তও পৌঁছে যায়।
কিন্তু এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েও যে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, তা কি কখনও ভেবে দেখেছেন? হয়ত দেখেননি। তবে বাস্তবে ঘটছে এমনটিই। যা চমকে দেবে আপনাকে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার এক হাত না থাকা মুহিবের জীবনেও এমন ঘটনা ঘটে চলছে।
মুহিব জন্মের সময়ই শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ একটি হাত ছাড়াই পৃথিবীতে এসেছিলেন। আর এই হাত না থাকার কারণেই তার জীবন বইয়ে জায়গা পেয়েছে একটি কালো অধ্যায়।
প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে কটূক্তি, অপমান আর অবহেলার বোঝা মাথায় নিয়েই বড় হতে হয় তাকে। এমন কটূক্তি থেকে রক্ষা পায়নি তার বাবা মাও। তবুও কষ্টকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখে হাসিমুখেই গ্রহণ করতেন সবকিছু।
মুহিবের ভিন্নধর্মী চিন্তা
খুব অল্প সময়েই মুহিব বুঝতে পেরেছিলেন এই সমাজ তাকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি। সমাজের মানুষগুলোর আড় চোখে তাকানো ও নানা লাঞ্ছনা আর ভৎসনাই তার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। তখন আর পাঁচজন প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষের মতোই তার মাথায়ও ঘুরপাক খেত কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা।
তবে মুহিব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেননি। সিদ্ধান্ত নেন ঘুরে দাঁড়ানোর। তাই কটূক্তিকে গ্রহণ করেন অনুপ্রেরণা ও শক্তির উৎস হিসেবে। সমাজে তার গুরুত্বও কম নয় তা বোঝাতে চান সবাইকে। মুহিব তার যাবতীয় সব কাজ এক হাতেই সামলান।
বাইক চালানোর ইচ্ছে ছিলো তার ছোটবেলা থেকেই। এই অসাধ্যও এক হাতেই সাধন করেছেন তিনি। যদিও এক হাত না থাকায় বন্ধুরা কেউই তাকে বাইক চালাতে দিত না। উল্টো হাসিঠাট্টা আর বিদ্বেষ ভরা কথা ছুড়ে মারত তার ওপর।
তবে মুহিব তাতে কষ্ট না পেয়ে ইচ্ছেটাকে আরও গাঢ় করে। এরপর সে নিজেই একটি স্কুটি কিনে ড্রাইভিং শিখতে শুরু করে। এরপর অনেকদিনের চেষ্টায় তিনি অন্যদের চেয়েও অনেক ভালো বাইক চালাতে পারেন।
বাইক চালানোর পাশাপাশি আরও কিছু কাজ শিখেছেন মুহিব। যেমন- ফ্রিজ ঠিক করাসহ ইলেকট্রিকের বিভিন্ন কাজ। শুধু কাজ শিখেই ক্ষ্যান্ত হননি, বাড়িতে বা দোকানে গিয়ে সার্ভিসও দিয়ে থাকেন। মুহিব টাইপিংয়েও অন্যদের থেকে কম পারদর্শী না। আর এই সবকিছু সে একহাত দিয়েই করে।
অন্যদের মতো মুহিবও খেলাধুলা করতে বেশ পছন্দ করে। বিভিন্ন খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পেয়েছে নানা পুরষ্কারও।
পিছিয়ে নেই শিক্ষাক্ষেত্রেও
শিক্ষাক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই মুহিব। তবে কটূক্তির শিকার হয়েছিলেন এক্ষেত্রেও। কোনো একজন ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলেছিলেন, যেখানে স্বাভাবিক মানুষই উচ্চশিক্ষা অর্জন করে বেকার বসে আছে, সেখানে তুই আর কতদূর এগোতে পারবি? আর কি বা করতে পারবি?
এমন কথা বুকে বিঁধেছিল মুহিবের। সেদিন মনের কষ্ট নিয়েই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল উচ্চশিক্ষা অর্জন করবে সে। বর্তমানে মুহিব বরিশালের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ’ এ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিএসসি ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন।
এক নজরে মুহিব
প্রতিবন্ধকতা থাকা স্বত্তেও নিজেকে ঠিক একজন পরিপূর্ণ স্বাভাবিক মানুষের মত ব্যবহার করতে হয় তা একটি হাত না থাকা মুহিবকে না দেখলে বোঝা যেত না।
পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন এমনকি বন্ধুরা পর্যন্ত যখন প্রতিবন্ধী বলে হাসি ঠাট্টা আর টিসকারি করত তখন আর পাঁচজনের মত তার ভিতরেও চিনচিন ব্যাথা অনুভব হত। তবে সে ব্যথাকে বেশিক্ষণ পুষে রাখতো না নিজের ভিতর। বরং ওই ব্যথা শক্তিতে রুপান্তরিত করে চালাতো সামনে এগিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।
মুহিব হয়তো কোনো বড় কিছু করতে পারেননি। তবে এতটুকু বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, প্রতিবন্ধকতা থাকলেই সে পিছিয়ে থাকেনা। সামনে আগানোর অদম্য ইচ্ছেশক্তি থাকলে এগুলো খুবই তুচ্ছ বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
তাই মুহিব যতটুকুই করেছে তা হয়ত অন্যদের জন্য হতে পারে একটি অনুপ্রেরণার উৎস। তাই আসুন, আমরা প্রতিবন্ধকতার সামনে দেয়াল না তুলে দিয়ে তাদের সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করি।