সৌদি আরবের তেলের উপর নির্ভরতা কমছে গোটা বিশ্বের। সন্দেহাতীত ভাবেই ভৌগোলিক রাজনীতির প্রশ্নে এই সংবাদটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। আগামীতে খনিজ তেলমুক্ত বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রাখতে তাই সৌদি আরব দুই ট্রিলিয়ন ডলারের একটি সার্বভৌম তহবিল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহনের পর থেকেই মূলত আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নে উঠেছে, তাহলে কি সৌদিআরবের তেলের মজুদ শেষের দিকে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, কারণ সৌদি কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেনি। যদিও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলে, কোনো মন্তব্য বা বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
২০১১ সালে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, সৌদি আরবে মাটির তলায় তেলের মজুদ রয়েছে প্রায় ২৬৮ বিলিয়ন ব্যারেল। বিশেষ করে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশেই অধিকাংশ তেলের খনি অবস্থিত। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, বিশ্বের মোট খনিজ তেলের পাঁচভাগের একভাগ মজুদ আছে শুধু সৌদি আরবের কাছেই। কিন্তু এই বিশাল পরিমান তেলের মজুদ থাকলেও সমস্যা অন্যখানে। সৌদি আরবের খনিতে প্রচুর পরিমাণে তেল থাকলেও, তাদের খনির সংখ্যা খুবই কম। অল্পকিছু সংখ্যক খনি থেকে বিপুল পরিমান তেল উত্তোলনের কারণে অধিকাংশ সময়ই সৌদি আরবকে বাধ্য হয়ে অধিক তেল উত্তোলন করতে হয় কারিগরি দিক বিবেচনা করে। আর এই তেলের বাড়তি অংশ নিজ দেশে না রেখে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় দেশটি। এদিক বিবেচনায় সৌদি আরবের বাড়তি তেল কেনায় এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র।
কয়েকদিন আগেই সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান
তার পর্ষদদের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় সাক্ষাতকার দেন দেশিয় অর্থনীতি প্রশ্নে। বেলা চারটা পর্যন্ত চলা ওই সাক্ষাতকারে সৌদি আরবের স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন তিনি। সৌদি আরবের অর্থনীতির শেকড় তেলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায়, অনতিবিলম্বে খনিজ তেলমুক্ত সময়ের হিসেব করে একটি পরিকল্পনা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা এই সাক্ষাৎকারেই প্রথমবারের মতো বললেন যুবরাজ সালমান। যুবরাজের এই ঘোষণা একদিকে ইতিবাচক হলেও, ভিন্নার্থে নেতিবাচক। কারণ বিশ্ব রাজনীতির এই অবস্থায় সৌদিআরবের খনিজ তেল যদি ফুরিয়ে যায় এবং রিজার্ভ দিয়ে তাদের চলতে হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে রাতারাতি ক্ষমতা হারাবে সৌদিআরব। আর তাই হয়তো, বাকী তেলটুকু শেষ হওয়ার আগেই দুই ট্রিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্তের দিকে আগাচ্ছে সৌদি রাজ প্রশাসন।
সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানিটির নাম আরামকো। বিশ্বের অন্যতম বিশাল সম্পদশালী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি অন্যতম। সৌদিআরবের নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই কোম্পানিটি চলতি বাজেটগুলো থেকে আগামীর সঙ্কট মোকাবেলায় তহবিল গঠন করবে। আর এক্ষেত্রে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করারও স্বাধীনতা থাকবে বলে জানা গেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, আগামী ২০১৭ অথবা ২০১৮ সাল নাগাদ আরামকো তার শেয়ার বিক্রি শুরু করতে পারে। এখন পর্যন্ত এই কোম্পাটির মাত্র পাঁচ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছে সৌদিআরব। ধারণা করা হচ্ছে, বাকী পচানব্বই শতাংশ শেয়ার ওই নতুন তহবিলে চলে যাবে। বিন সালমান বলেন, ‘কৌশলগতভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে সৌদিআরবের রাজস্ব আসে, তেল থেকে নয়। তাই এই কোম্পানিটিই হতে পারে বিনিয়োগের মূল ক্ষেত্র। বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে বিনিয়োগ করার সুযোগ নেই। সুতরাং আগামী বিশ বছরের মধ্যে আমাদের দেশটি আর শুধুমাত্র তেলের উপর নির্ভর করবে না।’
দুই ট্রিলিয়ন ডলার কি খুব অধিক পরিমান অর্থ একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য? এক হিসেবে জানা যায়, বিশ্বের প্রথমসারির নয়টি তেল কোম্পানিগুলো সম্পদ একত্রিত করলে যে পরিমান অর্থ হয়, তার দ্বিগুন এই প্রস্তাবিত তহবিল। আর এই বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে বিশ্বের প্রথমসারির চারটি কোম্পানি অনায়াসেই কিনে ফেলা যায়। যেগুলো মধ্যে রয়েছে, অ্যাপল, গুগুল, মাইক্রোসফট এবং বার্কশায়ারের মতো কোম্পানি। তবে সৌদিআরব এই বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে তেলের বাইরে কোন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদে বলা হচ্ছে, সৌদি আরব তেল সঙ্কট মোকাবেলার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন জ্বালানির দিকে আগাচ্ছে। আগামী পাঁচ বছর মেয়াদী যে জ্বালানি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং এর পেছনে যা বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তা দিয়ে আগামী চার বছরে পৃথিবীতে ব্যবহার্য সকল ফসিল ফুয়েল কিনে ফেলা যাবে।
সৌদি আরবের অর্থনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তহবিল পুরোপুরি গঠন করতে দুই দশক সময় লেগে যাবে। কারণ রাতারাতি অর্থনীতির উৎসকে তেল থেকে সরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। আর আরামকোর এই সিদ্ধান্ত থেকে এটা অন্তত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, সৌদিআরবও ভাবতে বাধ্য হচ্ছে যে তেলের রাজনীতির দিক শেষ হবার পথে এবং তাদের তেলও তলানিতে। আর তাই যদি হয়, আগামী দশ বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ভিন্নখাতে প্রবাহিত হবে সন্দেহাতীতভাবেই।-বাংলামেইল