ঢাকা ১০:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওবামার কিউবা মিশন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৪৭:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ মার্চ ২০১৬
  • ৩২৩ বার

তিন দিনের ঐতিহাসিক সফরে একসময়ের প্রবল শত্রুদেশ কিউবা সফর করলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মূলত ১৯২৮ সালের পর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের এটিই প্রথম কিউবা সফর। গত ২০ মার্চ বিকেলে বৃষ্টির মধ্যে ওবামা ও তার পরিবার কিউবার রাজধানী হাভানার হোসে মার্তি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রদ্রিগুয়েজ তাদের লালগালিচা সংবর্ধনায় স্বাগত জানান। বিমানবন্দর থেকে হাভানার একটি হোটেলে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় দূতাবাসকর্মীদের সাথে মিলিত হন ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা।

২০০৮ সালে ফিদেল ক্যাস্ত্রো ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালে নেতৃত্বে আসেন তার ভাই রাউল ক্যাস্ত্রো। ক্ষমতায় আসার সূচনালগ্ন থেকে ভাইয়ের নীতিতে দেশ পরিচালনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন রাউল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সাল থেকে বরফ গলতে শুরু করে, যা বিশ্ববাসীকে আশান্বিতই করেছে বলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাউল-ওবামার চেষ্টার ফলেই ৮৮ বছর পর হাভানায় পা রাখলেন কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এখন দেখার বিষয়, তার এ সফর কিউবা-আমেরিকা সম্পর্কোন্নয়নে কতখানি প্রভাব ফেলে। যদিও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ এখনো আসেনি।
মূলত সফরের বিষয়টি প্রায় ১৫ মাস আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ওবামা। যে ঘোষণার আওতায় কিউবা থেকে আমেরিকায় সরাসরি ফ্লাইট চালুসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনার কথা জানানো হয়। তবে ওবামার এ সফরেই কিউবার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো উঠে যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না, তবে তা শিথিল হতে পারে। সম্প্রতি ওবামা প্রশাসন বেশ কিছু ইতিবাচক প্রদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে অনেক ইস্যুতেই যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল, যা বিশ্ববাসীকে কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানাচ্ছে, ১৯২৮ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস টেক্সাসে চেপে হাভানার বন্দরে ভিড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০তম প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিজ। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় নয় দশক। আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের পা পড়েনি কিউবার মাটিতে। দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর ২০ মার্চ হাভানায় পা রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আর এর মধ্য দিয়েই দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
৮৮ বছর আগে কেলভিন কুলিজ সাগর পাড়ি দিয়ে হাভানায় পৌঁছালেও ২০ মার্চ ওবামা সেখানে পৌঁছান বিশ্বখ্যাত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাহন এয়ারফোর্স ওয়ান-এ চেপে হাওয়ায় ভেসে। তার সাথে রয়েছেন স্ত্রী মিশেল ওবামা এবং দুই কন্যা মালিহা ও শাসা। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উৎসাহ-উদ্দীপনারও শেষ নেই।
কিউবার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে স্নায়ুযুদ্ধের সময়। আর তা চরম আকার ধারণ করে ১৯৫৯ সালে। এ বছর দেশটিতে সমাজতন্ত্রের বিপ্লব ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটি পরিচালনা করেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। কিন্তু কিউবার লৌহমানবখ্যাত সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোও কোনোভাবেই ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি মার্কিন প্রতিক্রিয়ার জবাবে দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলেন, ‘কিউবা সাগরের তলদেশে তলিয়ে গেলেও সমাজতন্ত্র অব্যাহত থাকবে,’ যা এখনো সমাজতন্ত্রীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ফিদেল ক্যাস্ত্রো প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতিকে নেতৃত্ব দেন। তার সরকারের সূচনালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্র নীতির ভিন্নতার কারণে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ভেঙে পড়তে শুরু করে কিউবার। ১৯৬১ সালে দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, দেশটির ওপর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে মার্কিন সরকার।
মূলত পুঁজিবাদী মার্কিন প্রশাসন কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে মেনে নিতে পারেনি। সেই সাথে সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়েন তিনি। তার ওপর তার ‘একলা চলো নীতি’ এ রোষকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কিউবা সফর সম্প্রতি শেষ হয়েছে। দুই নেতা বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। বহু দিন পর নতুনভাবে কাজ শুরু করা দূতাবাসকর্মীদের উদ্দেশে ওবামা বলেন, কিউবার জনগণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ এটি। তিনি বলেন, ১৯২৮ সালে প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিজ ব্যাটেলশিপে চড়ে এখানে এসেছিলেন। এখানে আসতে তার তিন দিন লেগেছিল। কিন্তু আমার মাত্র ৩ ঘণ্টা লাগল। এই প্রথম এয়ার ফোর্স ওয়ান কিউবায় অবতরণ করল এবং আমরাও প্রথমবারের মতো এলাম।
উল্লেখ্য, ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবে কিউবার মার্কিনপন্থী সরকারের পতন হলে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিবেশী দেশ দু’টি। এরপর কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, যা ৫৪ বছর ধরে বলবৎ ছিল। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওবামা ও কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো বিরোধ অবসানের বিষয়ে একমত হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় এবং টেলিযোগাযোগ ও বিমান চলাচল স্বাভাবিক করার বিষয়ে চুক্তি সই হয়। এরপর ৮৮ বছরের মধ্যে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট কিউবা সফরে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের কিউবা সফর একসময় একটি অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। সফরে কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিপ্লবের নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাথে ওবামার দেখা হয়নি।
গুয়ান্তানামো বে-তে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগার ও কিউবার রাজনৈতিক বন্দীসহ মানবাধিকার ইস্যুতে কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো ও সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। গত ২১ মার্চ কিউবার রাজধানী হাভানায় ঐতিহাসিক এক সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতা বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। রাউল বলেন, যদি তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের একটি তালিকা দেয়া হয় তবে তিনি তাদের মুক্তি দিতেন। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের তালিকা কিউবার কাছে আগেই দেয়া হয়েছে, তবে সেসব বন্দীকে ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে দেখেন না ক্যাস্ত্রো।
কিউবায় বিপ্লবের পর ওবামাই প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, যিনি দেশটিতে সফর করলেন। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবে কিউবার যুক্তরাষ্ট্রপন্থী সরকারের পতন হলে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিবেশী দেশ দু’টি। এরপর কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, যা ৫৪ বছর ধরে বলবৎ ছিল।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওবামা ও কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো বিরোধ অবসানের বিষয়ে একমত হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং টেলিযোগাযোগ ও বিমান চলাচল স্বাভাবিক করার বিষয়ে চুক্তি সই হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও কিউবান প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রোর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ৯ দশক পর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট চিরবৈরী রাষ্ট্র কিউবায় পা রাখলেন। সফরটা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণও হয়েছিল বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল। তবে দীর্ঘ বৈরিতার পর মাত্র একটি সফরের মাধ্যমেই উভয় দেশের মধ্যে সৃষ্ট তিক্ততা নিরসন হওয়ার আশা করাটা যৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। পুঁজিবাদী মার্কিন সমাজ এখনো পুরোপুরি সমাজতন্ত্রবিরোধী। আর কিউবাও যেকোনো মূল্যে তাদের সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা রাখতে বদ্ধপরিকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই কিউবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে যে, কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকার র্ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দলন-পীড়ন চালাচ্ছে। আর সে অভিযোগেই দেশটির ওপর ৫৪ বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে।
মার্কিন প্রশাসন বরাবরই কিউবায় রাজনৈতিক সংস্কার ও মানবাধিকারের বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। অবাধ গণতন্ত্রায়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা ও সমাবেশ করার অধিকার দাবি করে আসছে বরাবরই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক কিউবা তা অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অস্বীকার করে আসছে। প্রত্যুত্তরে মার্কিন সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম ও বৈষম্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে কিউবা সরকার। কিউবা বরাবরই মার্কিন নৌঘাঁটি গুয়ান্তানামো বে মার্কিনিদের কাছ থেকে ফেরত ও বন্দিশালা বন্ধের দাবি জানিয়ে এসেছে এবং অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তোলারও দাবি জানিয়েছে। কিন্তু এসব সমস্যা সহসাই সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কিউবা সফরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি যা-ই হোক না কেন অন্তত ইতিবাচক বলতে হবে।
mail@seydmasud.com

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ওবামার কিউবা মিশন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

আপডেট টাইম : ১০:৪৭:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ মার্চ ২০১৬

তিন দিনের ঐতিহাসিক সফরে একসময়ের প্রবল শত্রুদেশ কিউবা সফর করলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মূলত ১৯২৮ সালের পর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের এটিই প্রথম কিউবা সফর। গত ২০ মার্চ বিকেলে বৃষ্টির মধ্যে ওবামা ও তার পরিবার কিউবার রাজধানী হাভানার হোসে মার্তি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রদ্রিগুয়েজ তাদের লালগালিচা সংবর্ধনায় স্বাগত জানান। বিমানবন্দর থেকে হাভানার একটি হোটেলে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় দূতাবাসকর্মীদের সাথে মিলিত হন ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা।

২০০৮ সালে ফিদেল ক্যাস্ত্রো ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালে নেতৃত্বে আসেন তার ভাই রাউল ক্যাস্ত্রো। ক্ষমতায় আসার সূচনালগ্ন থেকে ভাইয়ের নীতিতে দেশ পরিচালনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন রাউল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সাল থেকে বরফ গলতে শুরু করে, যা বিশ্ববাসীকে আশান্বিতই করেছে বলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাউল-ওবামার চেষ্টার ফলেই ৮৮ বছর পর হাভানায় পা রাখলেন কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এখন দেখার বিষয়, তার এ সফর কিউবা-আমেরিকা সম্পর্কোন্নয়নে কতখানি প্রভাব ফেলে। যদিও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ এখনো আসেনি।
মূলত সফরের বিষয়টি প্রায় ১৫ মাস আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ওবামা। যে ঘোষণার আওতায় কিউবা থেকে আমেরিকায় সরাসরি ফ্লাইট চালুসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনার কথা জানানো হয়। তবে ওবামার এ সফরেই কিউবার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো উঠে যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না, তবে তা শিথিল হতে পারে। সম্প্রতি ওবামা প্রশাসন বেশ কিছু ইতিবাচক প্রদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে অনেক ইস্যুতেই যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল, যা বিশ্ববাসীকে কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানাচ্ছে, ১৯২৮ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস টেক্সাসে চেপে হাভানার বন্দরে ভিড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০তম প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিজ। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় নয় দশক। আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের পা পড়েনি কিউবার মাটিতে। দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর ২০ মার্চ হাভানায় পা রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আর এর মধ্য দিয়েই দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
৮৮ বছর আগে কেলভিন কুলিজ সাগর পাড়ি দিয়ে হাভানায় পৌঁছালেও ২০ মার্চ ওবামা সেখানে পৌঁছান বিশ্বখ্যাত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাহন এয়ারফোর্স ওয়ান-এ চেপে হাওয়ায় ভেসে। তার সাথে রয়েছেন স্ত্রী মিশেল ওবামা এবং দুই কন্যা মালিহা ও শাসা। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উৎসাহ-উদ্দীপনারও শেষ নেই।
কিউবার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে স্নায়ুযুদ্ধের সময়। আর তা চরম আকার ধারণ করে ১৯৫৯ সালে। এ বছর দেশটিতে সমাজতন্ত্রের বিপ্লব ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটি পরিচালনা করেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। কিন্তু কিউবার লৌহমানবখ্যাত সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোও কোনোভাবেই ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি মার্কিন প্রতিক্রিয়ার জবাবে দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলেন, ‘কিউবা সাগরের তলদেশে তলিয়ে গেলেও সমাজতন্ত্র অব্যাহত থাকবে,’ যা এখনো সমাজতন্ত্রীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ফিদেল ক্যাস্ত্রো প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতিকে নেতৃত্ব দেন। তার সরকারের সূচনালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্র নীতির ভিন্নতার কারণে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ভেঙে পড়তে শুরু করে কিউবার। ১৯৬১ সালে দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, দেশটির ওপর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে মার্কিন সরকার।
মূলত পুঁজিবাদী মার্কিন প্রশাসন কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে মেনে নিতে পারেনি। সেই সাথে সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়েন তিনি। তার ওপর তার ‘একলা চলো নীতি’ এ রোষকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কিউবা সফর সম্প্রতি শেষ হয়েছে। দুই নেতা বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। বহু দিন পর নতুনভাবে কাজ শুরু করা দূতাবাসকর্মীদের উদ্দেশে ওবামা বলেন, কিউবার জনগণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ এটি। তিনি বলেন, ১৯২৮ সালে প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিজ ব্যাটেলশিপে চড়ে এখানে এসেছিলেন। এখানে আসতে তার তিন দিন লেগেছিল। কিন্তু আমার মাত্র ৩ ঘণ্টা লাগল। এই প্রথম এয়ার ফোর্স ওয়ান কিউবায় অবতরণ করল এবং আমরাও প্রথমবারের মতো এলাম।
উল্লেখ্য, ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবে কিউবার মার্কিনপন্থী সরকারের পতন হলে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিবেশী দেশ দু’টি। এরপর কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, যা ৫৪ বছর ধরে বলবৎ ছিল। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওবামা ও কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো বিরোধ অবসানের বিষয়ে একমত হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় এবং টেলিযোগাযোগ ও বিমান চলাচল স্বাভাবিক করার বিষয়ে চুক্তি সই হয়। এরপর ৮৮ বছরের মধ্যে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট কিউবা সফরে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের কিউবা সফর একসময় একটি অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। সফরে কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিপ্লবের নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাথে ওবামার দেখা হয়নি।
গুয়ান্তানামো বে-তে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগার ও কিউবার রাজনৈতিক বন্দীসহ মানবাধিকার ইস্যুতে কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো ও সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। গত ২১ মার্চ কিউবার রাজধানী হাভানায় ঐতিহাসিক এক সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতা বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। রাউল বলেন, যদি তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের একটি তালিকা দেয়া হয় তবে তিনি তাদের মুক্তি দিতেন। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের তালিকা কিউবার কাছে আগেই দেয়া হয়েছে, তবে সেসব বন্দীকে ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে দেখেন না ক্যাস্ত্রো।
কিউবায় বিপ্লবের পর ওবামাই প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, যিনি দেশটিতে সফর করলেন। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবে কিউবার যুক্তরাষ্ট্রপন্থী সরকারের পতন হলে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিবেশী দেশ দু’টি। এরপর কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, যা ৫৪ বছর ধরে বলবৎ ছিল।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওবামা ও কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো বিরোধ অবসানের বিষয়ে একমত হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং টেলিযোগাযোগ ও বিমান চলাচল স্বাভাবিক করার বিষয়ে চুক্তি সই হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও কিউবান প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রোর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ৯ দশক পর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট চিরবৈরী রাষ্ট্র কিউবায় পা রাখলেন। সফরটা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণও হয়েছিল বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল। তবে দীর্ঘ বৈরিতার পর মাত্র একটি সফরের মাধ্যমেই উভয় দেশের মধ্যে সৃষ্ট তিক্ততা নিরসন হওয়ার আশা করাটা যৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। পুঁজিবাদী মার্কিন সমাজ এখনো পুরোপুরি সমাজতন্ত্রবিরোধী। আর কিউবাও যেকোনো মূল্যে তাদের সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা রাখতে বদ্ধপরিকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই কিউবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে যে, কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকার র্ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দলন-পীড়ন চালাচ্ছে। আর সে অভিযোগেই দেশটির ওপর ৫৪ বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে।
মার্কিন প্রশাসন বরাবরই কিউবায় রাজনৈতিক সংস্কার ও মানবাধিকারের বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। অবাধ গণতন্ত্রায়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা ও সমাবেশ করার অধিকার দাবি করে আসছে বরাবরই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক কিউবা তা অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অস্বীকার করে আসছে। প্রত্যুত্তরে মার্কিন সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম ও বৈষম্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে কিউবা সরকার। কিউবা বরাবরই মার্কিন নৌঘাঁটি গুয়ান্তানামো বে মার্কিনিদের কাছ থেকে ফেরত ও বন্দিশালা বন্ধের দাবি জানিয়ে এসেছে এবং অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তোলারও দাবি জানিয়েছে। কিন্তু এসব সমস্যা সহসাই সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কিউবা সফরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি যা-ই হোক না কেন অন্তত ইতিবাচক বলতে হবে।
mail@seydmasud.com