ঢাকা ০৭:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৮:৩৭:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ নভেম্বর ২০২১
  • ২৮৭ বার

রফিকুল ইসলামঃ ‘ জীবনটা আজ সাদা পাতা / লিখার কিছুই নেই, /  মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে / অভাগিনী আমি সেই।  / ধাঁ করে কেন আজ /  ঢুকরে কাঁদে মন, / পিছে ফিরে দেখি / হারিয়েছি বরপ্রতিম রতন।’

বিরহের বিষাদময় এই স্বরচিত পঙক্তিমালা রওশন আরা শারমিন দিবা ওরফে রেখার; যা পরম পূজনীয় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা স্বামী অ্যাডভোকেট রফিকুল আলম রতনের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকীতে উৎসর্গ করেন।

কমরেড রফিকুল আলম রতন দুবারের নির্বাচিত সর্বজন গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আদরণীয় ভাতিজা এবং কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদের ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান মো. আবদুল গণি’র বড় ছেলে।

দক্ষ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক এই সংগঠক আজীবনই সাম্য মৈত্রী ও সৌহার্দ্যের জয়গান গেয়ে গেছেন। সমাদৃতও ছিলেন কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের বন্ধু বলে এবং পরিচিতি লাভ করেন শোষণহীন সমাজব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার নির্লোভ নিরহংকার মানুষ হিসেবে।

বিগত ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর ৬৬ বছর বয়সে প্রিয়তমা স্ত্রী রওশন আরা শারমিন দিবা ওরফে রেখা, দুই মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা ইন্দিরা অবন্তী ও বিশাখা প্রিয় দর্শিনী ছোঁয়া অজন্তা, এক ছেলে শাশ্বত মুজিব অরোরা জয় এবং এক ভাই মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম মানিকসহ আত্মীয়-স্বজন, সহযোদ্ধা ও অসংখ্য গুণগ্রাহীদের রেখে মর্ত্যলোকে চলে যান। এমন পরোপকারী সুহৃদকে হারিয়ে মানুষ আজও স্মরণ করে – কাঁদে।

কমরেড রফিকুল আলম রতন ছিলেন স্পষ্টভাষী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর; যাঁকে কোনদিন কোনরকম সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দুর্বলতা স্পর্শ করতে পারেনি। কারো কাছে কখনো ছলনার আশ্রয় নেয়নি। সত্যাশ্রয়ী, উদার ও মুক্তচিন্তার মানুষটি সকল ভালো কাজের সাথে এবং অসহায়ের সহায় ছিলেন। তাছাড়া নিরলস পাঠ্যাভ্যাসে গড়ে ওঠা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও শাণিত স্মরণশক্তিতে রাজনীতি, সমাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা সুকুমারবৃত্তি অন্তরে নিরন্তর লালন করতেন বলে দেশ-বিদেশের গতি-প্রকৃতি ছিল তাঁর নখদর্পনে। সত্য ও স্পষ্টবাদিতায় কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কাছে আরাধনার পাত্র হয়ে ওঠা কমরেড রতন প্রতিভার বহুমাত্রিকতায় রাজনীতি, আইন ও সাংবাদিকতার পেশার পাশাপাশি গবেষণার কাজেও নিজেকে সম্পৃক্ত করে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ সেবক হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৫৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বর্তমান কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ধুবাজোড়া গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন রফিকুল আলম রতন। শিক্ষা ও কর্মজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ১৯৭৮ সালে অনার্সসহ মাস্টার্স এবং ১৯৮৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। এরপর নতুন ধারার দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ‘মুক্তি’ পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি।

তুখোড় ছাত্রনেতা রতন নিম্ন মাধ্যমিকেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে ঢাকা কলেজে গিয়ে যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। এ চেতনার নেপথ্যে পটভূমিকাও ঐতিহাসিক। বাবা ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুল গণি’র আদিষ্ট হয়ে ১৯৬৭ সালে কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ছেড়ে মাতৃকোলে এসে শিক্ষার গতি সঞ্চারে নবপ্রতিষ্ঠিত মিঠামইন জুনিয়র হাইস্কুলে (বর্তমানে রাষ্ট্রতির পিতৃনামীয় বিদ্যাপীঠ হাজী তায়েব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়) ভর্তি হলে প্রগতিশীল স্বদেশী বিপ্লবী চেতনার ভাটি অঞ্চলের আরেক ঋজু ব্যক্তিত্ব শিক্ষক বাবু বনবাসী দাসের সাহচর্যে এসে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে মিঠামইন সফরে আসলে ছাত্রনেতা বাগ্বিধি সুদর্শন রতন বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি কাড়লে দরাজ গলায় কাঁধ চাপড়ে বলেছিলেন- ‘কী-রে, দেশমুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে পারবি?’ প্রত্যুত্তরে টগবগে কিশোর রতন সেদিন সিংহগ্রীবে উচ্চকিত কণ্ঠে জানিয়ে দেন- ‘হ্যাঁ, পারুম’।

কিশোর রতন ওয়াদা রেখে পেরেছেনও। দেশপ্রেমেের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ফিরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় কৃষক শ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে আত্মনিয়োগ করেছিলেন পঙ্গুত্ববরণকে আলিঙ্গন করে। মৃত্যুর বহু আগেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ালেও পদ-পদবি মাড়াননি। নিজে মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের সন্তান ছাড়াও নানার বাড়ির দিকেও শহিদ পরিবারের নাতি হিসেবে গৌরবের জায়গাটি অবস্থান করছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, একাত্তরের ১ সেপ্টেম্বর মিঠামইনের ধুবাজোড়া গ্রামে ক্রাকডাউনের পরেই বজ্রশক্তিতে রফিকুল আলম রতন প্রথমে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া, জয়ন্তিয়া হিল ডিস্ট্রিক্টের থানা শহরে বালাটে গমন করেন। সেখানে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য তাঁর আপন চাচা বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একাধারে মুক্তিবাহিনী তথা মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক প্রধান FF, BLF রিক্রুটিং কমিটির চেয়ারম্যান এবং BLF – এর সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। পরে চাচারই মাধ্যমে আসাম রাজ্যের হাফলং গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের E ব্যাচের প্রশিক্ষাণার্থী হিসেবে রতন দেড় মাস ধরে চলা  Demolation অর্থাৎ বোমা, মাইন ও বিস্ফোরক দলে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মেরুদন্ডে মারাত্মক ইনজুরিতে মৃত্যু পর্যন্ত ভোগার ফলে রাজধানী ঢাকার আলোকিত জীবন ফেলে গ্রামে ফিরে এসে অন্যায়-অবিচার, সুস্থ ও কুসংস্কারমুক্ত সচেতন সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে গেছেন জীবনভর।

সংগ্রামী এই মহৎ মানুষটি ৬৬ বছরের আয়ুষ্কালের ৭ বছর ৫ মাসই চিকিৎসার জন্য কেটেছে দেশ-বিদেশের হাসপাতালে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সরকারের আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে উন্নত চিকিৎসায়ও স্বভাবিক জীবন ফিরে না পেলেও শক্ত মনোবলে মানব কাননে সরোবর ছিলেন। তাছাড়া মহান স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সোচ্চার থেকে অজ্ঞতা, অন্যায় ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। স্থিতপ্রজ্ঞ, তেজস্বী, ভয়শুন্য  নিরহংকারী এ অগ্রপথিকের জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে সত্য ও স্বদেশপ্রেমের চর্চা করা উচিত বলে মনে করেন রতন-সুহৃদ মঞ্চের কর্তৃপক্ষ।

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম রতনের ছোট্ট মেয়ে বিশাখা প্রিয়দর্শিনী ছোঁয়া অজন্তা। সে তার বাবাকে লেখা চিঠি লেখেন – ‘প্রিয় বাবা, তুমি কেমন আছো? আমি বালো আছি। তোমার কথা খুব মনে পরে আমার। আমার কথা কি মনে পরে তোমার? তোমার কোলে বসা আমার একটা ছবি আছে। সেটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তোমার কবরের পাশ দিয়ে আমি স্কুলে যাই। আর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি কি আমায় দেখতে পাও? তোমার কবরে ফোঁটা ফুল আমি খু্ব ভালোবাসি। তাই আমার চুলে পরি। তুমি আমার জন্য দোয়া করো। ভালো থেকো বাবা। আমার চিঠির উত্তর দিও। ঠিক মত ওষুধ খাও তো? ঠিক মত খাবার খাও তো? লকডাউনে কি তোমার জীবনটা বন্দী হয়ে আছে? যদি কখনো বাইরে বের হও মাস্ক পরে হবে কিন্তু। আমাদের জন্য দোয়া করো পৃথিবী যেন আবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে। আল্লাহ যেন তোমাকে ভালে স্থানে রাখেন।’

একাত্তরের সম্মুখ রণাঙ্গনের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রফিকুল আলম রতনের সহধর্মিণী রওশন আরা শারমিনা দিবা ওরফে রেখা এবং ছোট ভাই কিশোরগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম মানিক ধর্মীয় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠাদির মাধ্যমে মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবার কথা জানিয়ে মরহুমসহ সকল কবরবাসীর আত্মার শান্তির জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।

এছাড়া তারা বলেন, দেশ, জাতি তথা মা মাটি ও মানুষের কল্যাণে অবদান রেখে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম রতন। সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় অতি সম্প্রতি ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষণ ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন নীতিমালা-২০২১’ প্রণয়ন করেছে। এর মাধ্যমে বরেণ্য ব্যক্তিদের কর্ম স্মরণীয় করে রাখতে জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদযাপন হবে সরকারিভাবে, যাতে তরুণ সমাজ ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা রতনের পরিবার জাতির সেই গৌরবের ভাগিদার হতে চায় বলে জানান তারা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

আপডেট টাইম : ০৮:৩৭:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ নভেম্বর ২০২১

রফিকুল ইসলামঃ ‘ জীবনটা আজ সাদা পাতা / লিখার কিছুই নেই, /  মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে / অভাগিনী আমি সেই।  / ধাঁ করে কেন আজ /  ঢুকরে কাঁদে মন, / পিছে ফিরে দেখি / হারিয়েছি বরপ্রতিম রতন।’

বিরহের বিষাদময় এই স্বরচিত পঙক্তিমালা রওশন আরা শারমিন দিবা ওরফে রেখার; যা পরম পূজনীয় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা স্বামী অ্যাডভোকেট রফিকুল আলম রতনের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকীতে উৎসর্গ করেন।

কমরেড রফিকুল আলম রতন দুবারের নির্বাচিত সর্বজন গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আদরণীয় ভাতিজা এবং কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদের ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান মো. আবদুল গণি’র বড় ছেলে।

দক্ষ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক এই সংগঠক আজীবনই সাম্য মৈত্রী ও সৌহার্দ্যের জয়গান গেয়ে গেছেন। সমাদৃতও ছিলেন কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের বন্ধু বলে এবং পরিচিতি লাভ করেন শোষণহীন সমাজব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার নির্লোভ নিরহংকার মানুষ হিসেবে।

বিগত ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর ৬৬ বছর বয়সে প্রিয়তমা স্ত্রী রওশন আরা শারমিন দিবা ওরফে রেখা, দুই মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা ইন্দিরা অবন্তী ও বিশাখা প্রিয় দর্শিনী ছোঁয়া অজন্তা, এক ছেলে শাশ্বত মুজিব অরোরা জয় এবং এক ভাই মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম মানিকসহ আত্মীয়-স্বজন, সহযোদ্ধা ও অসংখ্য গুণগ্রাহীদের রেখে মর্ত্যলোকে চলে যান। এমন পরোপকারী সুহৃদকে হারিয়ে মানুষ আজও স্মরণ করে – কাঁদে।

কমরেড রফিকুল আলম রতন ছিলেন স্পষ্টভাষী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর; যাঁকে কোনদিন কোনরকম সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দুর্বলতা স্পর্শ করতে পারেনি। কারো কাছে কখনো ছলনার আশ্রয় নেয়নি। সত্যাশ্রয়ী, উদার ও মুক্তচিন্তার মানুষটি সকল ভালো কাজের সাথে এবং অসহায়ের সহায় ছিলেন। তাছাড়া নিরলস পাঠ্যাভ্যাসে গড়ে ওঠা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও শাণিত স্মরণশক্তিতে রাজনীতি, সমাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা সুকুমারবৃত্তি অন্তরে নিরন্তর লালন করতেন বলে দেশ-বিদেশের গতি-প্রকৃতি ছিল তাঁর নখদর্পনে। সত্য ও স্পষ্টবাদিতায় কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কাছে আরাধনার পাত্র হয়ে ওঠা কমরেড রতন প্রতিভার বহুমাত্রিকতায় রাজনীতি, আইন ও সাংবাদিকতার পেশার পাশাপাশি গবেষণার কাজেও নিজেকে সম্পৃক্ত করে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ সেবক হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৫৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বর্তমান কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ধুবাজোড়া গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন রফিকুল আলম রতন। শিক্ষা ও কর্মজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ১৯৭৮ সালে অনার্সসহ মাস্টার্স এবং ১৯৮৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। এরপর নতুন ধারার দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ‘মুক্তি’ পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি।

তুখোড় ছাত্রনেতা রতন নিম্ন মাধ্যমিকেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে ঢাকা কলেজে গিয়ে যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। এ চেতনার নেপথ্যে পটভূমিকাও ঐতিহাসিক। বাবা ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুল গণি’র আদিষ্ট হয়ে ১৯৬৭ সালে কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ছেড়ে মাতৃকোলে এসে শিক্ষার গতি সঞ্চারে নবপ্রতিষ্ঠিত মিঠামইন জুনিয়র হাইস্কুলে (বর্তমানে রাষ্ট্রতির পিতৃনামীয় বিদ্যাপীঠ হাজী তায়েব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়) ভর্তি হলে প্রগতিশীল স্বদেশী বিপ্লবী চেতনার ভাটি অঞ্চলের আরেক ঋজু ব্যক্তিত্ব শিক্ষক বাবু বনবাসী দাসের সাহচর্যে এসে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে মিঠামইন সফরে আসলে ছাত্রনেতা বাগ্বিধি সুদর্শন রতন বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি কাড়লে দরাজ গলায় কাঁধ চাপড়ে বলেছিলেন- ‘কী-রে, দেশমুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে পারবি?’ প্রত্যুত্তরে টগবগে কিশোর রতন সেদিন সিংহগ্রীবে উচ্চকিত কণ্ঠে জানিয়ে দেন- ‘হ্যাঁ, পারুম’।

কিশোর রতন ওয়াদা রেখে পেরেছেনও। দেশপ্রেমেের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ফিরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় কৃষক শ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে আত্মনিয়োগ করেছিলেন পঙ্গুত্ববরণকে আলিঙ্গন করে। মৃত্যুর বহু আগেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ালেও পদ-পদবি মাড়াননি। নিজে মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের সন্তান ছাড়াও নানার বাড়ির দিকেও শহিদ পরিবারের নাতি হিসেবে গৌরবের জায়গাটি অবস্থান করছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, একাত্তরের ১ সেপ্টেম্বর মিঠামইনের ধুবাজোড়া গ্রামে ক্রাকডাউনের পরেই বজ্রশক্তিতে রফিকুল আলম রতন প্রথমে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া, জয়ন্তিয়া হিল ডিস্ট্রিক্টের থানা শহরে বালাটে গমন করেন। সেখানে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য তাঁর আপন চাচা বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একাধারে মুক্তিবাহিনী তথা মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক প্রধান FF, BLF রিক্রুটিং কমিটির চেয়ারম্যান এবং BLF – এর সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। পরে চাচারই মাধ্যমে আসাম রাজ্যের হাফলং গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের E ব্যাচের প্রশিক্ষাণার্থী হিসেবে রতন দেড় মাস ধরে চলা  Demolation অর্থাৎ বোমা, মাইন ও বিস্ফোরক দলে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মেরুদন্ডে মারাত্মক ইনজুরিতে মৃত্যু পর্যন্ত ভোগার ফলে রাজধানী ঢাকার আলোকিত জীবন ফেলে গ্রামে ফিরে এসে অন্যায়-অবিচার, সুস্থ ও কুসংস্কারমুক্ত সচেতন সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে গেছেন জীবনভর।

সংগ্রামী এই মহৎ মানুষটি ৬৬ বছরের আয়ুষ্কালের ৭ বছর ৫ মাসই চিকিৎসার জন্য কেটেছে দেশ-বিদেশের হাসপাতালে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সরকারের আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে উন্নত চিকিৎসায়ও স্বভাবিক জীবন ফিরে না পেলেও শক্ত মনোবলে মানব কাননে সরোবর ছিলেন। তাছাড়া মহান স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সোচ্চার থেকে অজ্ঞতা, অন্যায় ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। স্থিতপ্রজ্ঞ, তেজস্বী, ভয়শুন্য  নিরহংকারী এ অগ্রপথিকের জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে সত্য ও স্বদেশপ্রেমের চর্চা করা উচিত বলে মনে করেন রতন-সুহৃদ মঞ্চের কর্তৃপক্ষ।

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম রতনের ছোট্ট মেয়ে বিশাখা প্রিয়দর্শিনী ছোঁয়া অজন্তা। সে তার বাবাকে লেখা চিঠি লেখেন – ‘প্রিয় বাবা, তুমি কেমন আছো? আমি বালো আছি। তোমার কথা খুব মনে পরে আমার। আমার কথা কি মনে পরে তোমার? তোমার কোলে বসা আমার একটা ছবি আছে। সেটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তোমার কবরের পাশ দিয়ে আমি স্কুলে যাই। আর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি কি আমায় দেখতে পাও? তোমার কবরে ফোঁটা ফুল আমি খু্ব ভালোবাসি। তাই আমার চুলে পরি। তুমি আমার জন্য দোয়া করো। ভালো থেকো বাবা। আমার চিঠির উত্তর দিও। ঠিক মত ওষুধ খাও তো? ঠিক মত খাবার খাও তো? লকডাউনে কি তোমার জীবনটা বন্দী হয়ে আছে? যদি কখনো বাইরে বের হও মাস্ক পরে হবে কিন্তু। আমাদের জন্য দোয়া করো পৃথিবী যেন আবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে। আল্লাহ যেন তোমাকে ভালে স্থানে রাখেন।’

একাত্তরের সম্মুখ রণাঙ্গনের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রফিকুল আলম রতনের সহধর্মিণী রওশন আরা শারমিনা দিবা ওরফে রেখা এবং ছোট ভাই কিশোরগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম মানিক ধর্মীয় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠাদির মাধ্যমে মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবার কথা জানিয়ে মরহুমসহ সকল কবরবাসীর আত্মার শান্তির জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।

এছাড়া তারা বলেন, দেশ, জাতি তথা মা মাটি ও মানুষের কল্যাণে অবদান রেখে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম রতন। সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় অতি সম্প্রতি ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষণ ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন নীতিমালা-২০২১’ প্রণয়ন করেছে। এর মাধ্যমে বরেণ্য ব্যক্তিদের কর্ম স্মরণীয় করে রাখতে জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদযাপন হবে সরকারিভাবে, যাতে তরুণ সমাজ ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা রতনের পরিবার জাতির সেই গৌরবের ভাগিদার হতে চায় বলে জানান তারা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।