ঢাকা ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাতিলে ভাসিয়ে শিশুকে পোলিও খাওয়াতে নিয়ে গেলেন বাবা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:৪৬:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • ১৬৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একটানা বৃষ্টিতে গ্রামের মাটির রাস্তা ডুবে গেছে। বাড়ির চারিদিকে জমে আছে পানি। সদ্য বাবা হওয়া নিজামুদ্দিন মোল্লা সে কারণে ঘরবন্দি। এরই মধ্যে গতকাল রবিবার সকালে পোলিও টিকা খাওয়ানোর জন্য ‘আশাদিদি’রা ডাকাডাকি শুরু করেন।

পানি যতই ঘিরে ধরুক, দেরি করতে চাননি ব্যাগ তৈরির কারিগর নিজামুদ্দিন। নবজাতককে বড় মুখওয়ালা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে শুইয়ে পানিতে ভাসিয়ে পোলিও টিকা খাওয়াতে নিয়ে যান তিনি।

সঙ্গীর কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে যান আড়াই বছর বয়সের বড় ছেলে শামিমকেও। তিনি বলেন, বাচ্চা দুটোকে পোলিও তো খাওয়াতেই হবে। তাই এভাবে পৌঁছে গেলাম।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ক্যানিং-২ নম্বর ব্লকের সারেঙ্গাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের সিংহেশ্বর সাবসেন্টার এলাকা পানির তলায়। আবার শুরু হওয়া বৃষ্টিতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, ভাবলেই শিউরে উঠছেন বাসিন্দারা।

পোলিও টিকা খাওয়াতে সেখানেই নবজাতককে হাঁড়িতে ভাসিয়ে নিয়ে আসতে দেখে চমকে উঠেছিলেন আশাকর্মী থেকে মিডওয়াইফ-ও।

কোথাও কোমরসমান, কোথাও হাঁটুসমান পানিতে নেমে বাচ্চাদের পোলিও টিকা খাওয়াতে খাওয়াতেই নিজামুদ্দিনদের এলাকায় পৌঁছে যান আশাকর্মী সোনালি প্রধান এবং এএনএম (২) নমিতা হালদার।

তারা ছিলেন একটু উঁচু মূল রাস্তায়। এর পরে যে-মাটির রাস্তা ধরে নিজামুদ্দিনের বাড়ির সামনে যেতে হবে, সেখানে প্রায় এক কোমর পানি। আর ওই যুবকের বাড়ির সামনে পানি বুক পর্যন্ত।

তাই ঝুঁকি নেননি সোনালি-নমিতারা। তারা বলেন, আমরা প্রায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলাম। কারণ, তার পরে পানি এত বেশি যে, পোলিও বাক্স নিয়ে যাওয়া মুশকিল।

তাই বলে বাচ্চাকে হাঁড়িতে শুইয়ে পোলিও! কল্পনাও করতে পারেননি ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা। সোনালি জানান, আচমকা তারা দেখেন, পানিতে ভাসানো একটি হাঁড়ি ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন নিজামুদ্দিন। পেছনে অন্য একজনের কাঁধে তার বড় ছেলে।

সোনালি বলেন, প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। পরে বুঝলাম, হাঁড়িতে করে একরত্তিটাকেই নিয়ে আসছে।

নমিতা জানান, শিশুকে ওই ভাবে আনতে দেখে তারাও মূল রাস্তা থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে যান। নিজামুদ্দিনের কাছে জানতে চান, হাঁড়িতে করে কেন?

নীজামুদ্দিন তাদের জানান, স্ত্রী সাফিয়া খাতুনের পানি ঠেলে আসার ক্ষমতা নেই। আবার তিনি নিজেও ১৫ দিন বয়সের ছেলেকে কোলে নিয়ে পানি ঠেলে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। কোনো ভাবে বাচ্চা যদি পড়ে যায়! তাই আশাকর্মীদের ডাক শুনেই বাড়িতে থাকা বড় মুখের হাঁড়িতে ছেলেকে কাঁথায় মুড়িয়ে শুইয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন নিজামুদ্দিন।

ক্যানিং-২ নম্বর ব্লকের বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিবন্দি। সেই পানি ভেঙেই ১৭৬ জন আশাকর্মী মোট ১২,৬১২ জন বাচ্চাকে পোলিও খাইয়েছেন। একই হাল ক্যানিং-১ নম্বর ব্লকেরও। সেখানকার নবপল্লি এলাকায় বাঁশের তৈরি ভেলায় চেপে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পোলিও খাওয়াতে দেখা গেছে আরেক আশাকর্মী ফাল্গুনী মণ্ডলকে।

পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানান, সাধারণত মায়েরাই বাচ্চাদের পোলিও খাওয়াতে নিয়ে আসেন। সেখানে এক জন বাবা দুর্যোগের মধ্যে এভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এটা খুবই প্রশংসার।

স্বাস্থ্য অধিকর্তা একই সঙ্গে বলেন, দুর্যোগ ঠেলে, কোমরসমান পানিতে দাঁড়িয়ে আশাকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে পোলিও খাওয়ানোর কাজ করছেন, তাতে কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তাদের জন্য গোটা স্বাস্থ্য দপ্তর গর্বিত।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

পাতিলে ভাসিয়ে শিশুকে পোলিও খাওয়াতে নিয়ে গেলেন বাবা

আপডেট টাইম : ০২:৪৬:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একটানা বৃষ্টিতে গ্রামের মাটির রাস্তা ডুবে গেছে। বাড়ির চারিদিকে জমে আছে পানি। সদ্য বাবা হওয়া নিজামুদ্দিন মোল্লা সে কারণে ঘরবন্দি। এরই মধ্যে গতকাল রবিবার সকালে পোলিও টিকা খাওয়ানোর জন্য ‘আশাদিদি’রা ডাকাডাকি শুরু করেন।

পানি যতই ঘিরে ধরুক, দেরি করতে চাননি ব্যাগ তৈরির কারিগর নিজামুদ্দিন। নবজাতককে বড় মুখওয়ালা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে শুইয়ে পানিতে ভাসিয়ে পোলিও টিকা খাওয়াতে নিয়ে যান তিনি।

সঙ্গীর কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে যান আড়াই বছর বয়সের বড় ছেলে শামিমকেও। তিনি বলেন, বাচ্চা দুটোকে পোলিও তো খাওয়াতেই হবে। তাই এভাবে পৌঁছে গেলাম।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ক্যানিং-২ নম্বর ব্লকের সারেঙ্গাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের সিংহেশ্বর সাবসেন্টার এলাকা পানির তলায়। আবার শুরু হওয়া বৃষ্টিতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, ভাবলেই শিউরে উঠছেন বাসিন্দারা।

পোলিও টিকা খাওয়াতে সেখানেই নবজাতককে হাঁড়িতে ভাসিয়ে নিয়ে আসতে দেখে চমকে উঠেছিলেন আশাকর্মী থেকে মিডওয়াইফ-ও।

কোথাও কোমরসমান, কোথাও হাঁটুসমান পানিতে নেমে বাচ্চাদের পোলিও টিকা খাওয়াতে খাওয়াতেই নিজামুদ্দিনদের এলাকায় পৌঁছে যান আশাকর্মী সোনালি প্রধান এবং এএনএম (২) নমিতা হালদার।

তারা ছিলেন একটু উঁচু মূল রাস্তায়। এর পরে যে-মাটির রাস্তা ধরে নিজামুদ্দিনের বাড়ির সামনে যেতে হবে, সেখানে প্রায় এক কোমর পানি। আর ওই যুবকের বাড়ির সামনে পানি বুক পর্যন্ত।

তাই ঝুঁকি নেননি সোনালি-নমিতারা। তারা বলেন, আমরা প্রায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলাম। কারণ, তার পরে পানি এত বেশি যে, পোলিও বাক্স নিয়ে যাওয়া মুশকিল।

তাই বলে বাচ্চাকে হাঁড়িতে শুইয়ে পোলিও! কল্পনাও করতে পারেননি ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা। সোনালি জানান, আচমকা তারা দেখেন, পানিতে ভাসানো একটি হাঁড়ি ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন নিজামুদ্দিন। পেছনে অন্য একজনের কাঁধে তার বড় ছেলে।

সোনালি বলেন, প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। পরে বুঝলাম, হাঁড়িতে করে একরত্তিটাকেই নিয়ে আসছে।

নমিতা জানান, শিশুকে ওই ভাবে আনতে দেখে তারাও মূল রাস্তা থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে যান। নিজামুদ্দিনের কাছে জানতে চান, হাঁড়িতে করে কেন?

নীজামুদ্দিন তাদের জানান, স্ত্রী সাফিয়া খাতুনের পানি ঠেলে আসার ক্ষমতা নেই। আবার তিনি নিজেও ১৫ দিন বয়সের ছেলেকে কোলে নিয়ে পানি ঠেলে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। কোনো ভাবে বাচ্চা যদি পড়ে যায়! তাই আশাকর্মীদের ডাক শুনেই বাড়িতে থাকা বড় মুখের হাঁড়িতে ছেলেকে কাঁথায় মুড়িয়ে শুইয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন নিজামুদ্দিন।

ক্যানিং-২ নম্বর ব্লকের বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিবন্দি। সেই পানি ভেঙেই ১৭৬ জন আশাকর্মী মোট ১২,৬১২ জন বাচ্চাকে পোলিও খাইয়েছেন। একই হাল ক্যানিং-১ নম্বর ব্লকেরও। সেখানকার নবপল্লি এলাকায় বাঁশের তৈরি ভেলায় চেপে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পোলিও খাওয়াতে দেখা গেছে আরেক আশাকর্মী ফাল্গুনী মণ্ডলকে।

পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানান, সাধারণত মায়েরাই বাচ্চাদের পোলিও খাওয়াতে নিয়ে আসেন। সেখানে এক জন বাবা দুর্যোগের মধ্যে এভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এটা খুবই প্রশংসার।

স্বাস্থ্য অধিকর্তা একই সঙ্গে বলেন, দুর্যোগ ঠেলে, কোমরসমান পানিতে দাঁড়িয়ে আশাকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে পোলিও খাওয়ানোর কাজ করছেন, তাতে কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তাদের জন্য গোটা স্বাস্থ্য দপ্তর গর্বিত।