তারাপুর চা বাগানের অবৈধ দখলদার ‘দানবীর’ রাগীব আলী

একজন মুসলিমকে সেবায়েত বানিয়ে তারাপুর টা বাগানের প্রায় হাজার কোটি টাকার দেবোত্তোর সম্পত্তি দখল করেন সিলেটের কথিত ‘দানবীর’ শিল্পপতি রাগীব আলী। তার কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য ১৭ বছর আগেই সুপারিশ করেছিলো সংসদীয় কমিটি। এছাড়া এই বাগানে গড়ে তোলা রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ নাম পরিবর্তন করে ও টাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।

২০০৯ সালে এই বিষয়ে গঠিত সংসদীয় সাব কমিটি এসব সুপারিশ করে। তবে ১৭ বছরেও আমলে নেওয়া হয়নি কমিটির সুপারিশ। অবশেষে সম্প্রতি তারাপুর চা বাগান থেকে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজসহ সব স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ছয় মাসের মধ্যে এই নির্দশনা বাস্তবায়নেরও আদেশ দেন আদালত। তারাপুর চা বাগান লিজ প্রদানকেও অবৈধ বলে রায় দেন আদালত।

আদালতের নির্দেশনার বিষয়টি শুনেছেন জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক জয়নাল আবেদীন বলেন, কোর্টের লিখিত আদেশ এখনো আমি পাইনি। লিখিত আদেশ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নেবো। কোর্টের আদেশ তো পালন করতেই হবে।

আর শিল্পপতি রাগীব আরী রায়ের প্রতিক্রিয়ায় একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ৬ মাসের মধ্যে স্থাপনা
সরানো কীভাবে সম্ভব। এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হবে। রায়ের কপি হাতে পেলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

দেবত্তোর সম্পত্তির সেবায়েত ছিলেন অহিন্দু: ১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত তার তারাপুর চা বাগানসহ সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউড় দেবতার নামে রেজিষ্ট্রি দানপত্র করে দলিল করেন। তখন থেকে এ সম্পত্তিটি দেবোত্তোর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তারও পূর্বে এ বাগানটি তৎকালীন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত জনসন এন্ড কোম্পানীর নিয়ন্ত্রাধীন ছিলো। বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র লাল গুপ্ত এ দেবোত্তোর সম্পত্তিটির সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত হন। যুদ্ধকালীন সময়ে রাজেন্দ্র গুপ্ত প্রাণ হারালে তার পুত্র পঙ্কজ কুমার গুপ্ত এই বাগানটির সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।

পরবর্তীকালে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ভারত চলে গেলে কথিত পাওয়ার অব এটর্নি মূলে দেবোত্তোর সম্পত্তিটির সেবায়েত বনে যান দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। যিনি রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে জানা গেছে। একজন অহিন্দু ব্যক্তিকে দেবোত্তোর সম্পত্তির সেবায়েত করা হয় ‘পাওয়ার অব এটর্নি’র মাধ্যমে। যার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়। পরবর্তীতে এই মোস্তাক মজিদই রাগীব আলী পুত্র আব্দুল হাইকে ৯৯ বছরের লিজ প্রদান করেন হাজার কোটি টাকার বাগানটি।

সহকারী সচিবের স্বাক্ষর জাল করে বাগানের লিজ প্রদান: ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক সহকারী সচিবের স্বাক্ষর জাল করে ৯৯ বছরের জন্য লিজ প্রদান করা হয় তারাপুর চা বাগান। ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্বারক নং ভূঃ মঃ/শা-৮/খাজব ৫৩/৮৯-এ মির্জা ফজলুল করিমের স্বাক্ষরকে জাল করা হয়।

তারাপুর চা বাগান উদ্ধারের গঠিত সংসদীয় তদন্ত কমিটিকে মির্জা ফজলুল করিম জানান, আদেশের কপিতে যে স্বাক্ষর করা হয়েছে তা তিনি করেননি। এছাড়া তিনি কখনো আদেশের কপিতে উল্লেখিত শাখা ৮ এ কোন শাখা অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি এমনকি কারো অনুপস্থিতিতেও তিনি কোনোদিন এ দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি পুরো বিষয়টি উদ্দেশ্য প্রনোদিত, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

মির্জা ফজলুল করিমের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ হোসেন জানান, আদেশের কপিতে উল্লেখিত ইস্যু নম্বর, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেখা যায় আদেশের উল্লেখিত ইস্যু নম্বর মারফত যে পত্র বিলি করা হয়েছে তা পাবনার জেলা প্রশাসক বরাবরে পাঠানো হয়েছে। দেবোত্তর তারাপুর চা বাগানের সম্পত্তি হস্তান্তরের সরকারি অনুমতির চিঠি জাল করে এ সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়।

চা বাগানটি উদ্ধারের জন্য সংসদীয় কমিটির সুপারিশ : ১৯৯৯ সালের ২৫ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৪তম বৈঠকে তারাপুর চা বাগান নিয়ে বিশেষ আলোচনা ও কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক তৎকালীন সাংসদ মুজিবুর রহমান তালুকদারকে আহবায়ক এবং শেখ রাজ্জাক আলী, এনামুল হক, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও কবির হোসেনকে সদস্য করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়।

এ কমিটি চা বাগানের ৪শ’ ৪৪ একর ভূমি উল্লেখ করে বলা হয়- এ ভূমি হস্তান্তর অযোগ্য। এই দেবোত্তর সম্পত্তি বিতর্কিত ভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং এই হস্তাস্তর বৈধ নয়। দখলকারীর মালিকানা অর্জনের কোন ভিত্তি নেই। এই বাগানের কিছু অংশ অধিগ্রহণের পর রাগীব আলী দেবত্তোর সম্পত্তির ক্ষতিপুরন বাবদ ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১শ’ ৮৯ টাকা কোন ভাবেই তিনি ভোগ করতে পারেন না বলে মন্তব্য করা হয়।

সাব কমিটি তারাপুর চা বাগান পরিদর্শন শেষে সুপারিশ করেন, চা বাগানটি যথাশীঘ্র সম্ভব ঐ চক্রের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য। স্পর্শকাতর বিধায় রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও মসজিদের ব্যাপারে স্থিতাবস্থা চেয়ে পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে স্থায়ী ও বৈধভাবে তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য টিম সুপারিশ করে।

সাব কমিটি তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ মামলায় উল্লেখ করেন, তারাপুর চা বাগান অবৈধভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে দলিলপত্র সৃষ্টি করে প্রতারণামূলকভাবে লিজি হিসেবে দখলে রাখার জন্য রাগীব আলীর বিরুদ্ধে অভিলম্বে ফৌজদারী ও দেওয়ানী উভয়বিধ মামলা করার।

রাগীব আলীর আত্মসাতকৃত টাকা উদ্ধার ও রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, মদন মোহন কলেজের ক্যাম্পাসের নাম পরিবর্তন করে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করে সাব কমিটি।

প্রতারণা মামলা: ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতারণার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ভূ-সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তৎকালীন সিলেট সদর ভূমি কমিশনার এসএম আব্দুল হাই কোতোয়ালী থানায় এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং-১১৭/০৫।
মামলায় উল্লেখ করা হয় রাগীব আলী তার নিজের স্বার্থে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে জাল আমমোক্তারনামা তৈরী করেছেন। তিনি তারাপুর চা বাগান আত্মসাত করার জন্য জাল অনুমতি পত্র এবং সন্দেহজনক আমমোক্তারনামার বলে নিজের লোক দিয়ে আব্দুল হাই’র নামে বিক্রি রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছেন।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ৪২২.৯৬ একর জমি সাড়ে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রির চুক্তিতে আবাদ্ধ হন। অথচসেবায়েত ঐ দলিলে স্বাক্ষর করেননি। দেওয়ান মোস্তাক মজিদ ৪ জনকে দিয়ে একটি আমমোক্তারনামা তৈরি করেন। তারাপুর চা বাগান আত্মসাত করার উদ্দেশ্যেই নিজের লোকদের দিয়েই আমমোক্তারনামার বলে আব্দুল হাই বিক্রি রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেন।
মামলায় রাগীব আলী ছাড়াও তার স্ত্রী প্রয়াত রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, পুত্র আব্দুল হাই, কন্যা রেজিনা কাদির, জামাতা আব্দুল কাদির, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দেওয়ান আব্দুল মজিদ ও সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে আসামি করা হয়।

পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে এই প্রতারণা মামলা স্থগিত করা হয়। তবে আপিল বিভাগের চার বিচারক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ১৯ জানুয়ারি এই প্রতারণা মামলা পুণরায় চালুর নির্দেশ দেন।

এই রায়ে তারাপুর চা বাগানে নির্মিত সব অবকাঠামো ৬ মাসের মধ্যে অপসারণ করে সে জায়গায় চা বাগান করার আদেশ দেওয়া হয় এই রায়ে। রিট আবেদনকারীরা তা করতে ব্যর্থ হলে পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের সহায়তা নিয়ে স্থাপনা অপসারণের কথাও উল্লেখ করা হয় রায়ে। তবে এ খাতে ব্যয় হওয়া অর্থ জেলা প্রশাসক রিট আবেদনকারীদের কাছ থেকে গ্রহণ করবেন বলেও উল্লেখ করা হয়।

রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, জেলা প্রশাসক আপিল বিভাগে প্রদত্ত রায়ের আদেশগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করবেন। রিট আবেদনকারীরা যদি এ আদেশ না মানে সে ক্ষেত্রে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। উপযুক্ত জায়গায় মেডিকেল কলেজটিকে স্থানান্তর করবেন। রিট আবেদনকারীদের সমস্ত ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করবেন এবং মেডিকেল কলেজের জন্য সাময়িক লীজ নেয়ার জন্য অর্থ প্রয়োজনে এই সব জব্দকৃত একাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। রিট আবেদনকারীরা যদি চা বাগান পুন:নির্মাণে ব্যর্থ হন সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক একটি কমিটি গঠন করে এ কাজটি সম্পন্ন করবেন। এ বাবতে যে অর্থ ব্যয় হবে তা তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি থেকে আদায় করবেন।

এই রায়ে বলা হয়েছে, রাগীব আলী কর্তৃক সরকারের থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা উত্তোলন সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং এখতিয়ার বহির্ভূত। এই আদেশ পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে আইনানুগ সেবায়েতের অনুপস্থিতে দেবীর নামে নির্ধারিত একাউন্টে উত্তোলিত টাকা জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন সুপ্রিমকোর্টের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর