মনির হোসেনঃ ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের বৈচিত্রময় বাংলাদেশের একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে হাওর। বিশেষ করে নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ভূমি নিয়ে হাওর জলাভূমি গঠিত। এসব নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের শ্রেণি-পেশায় ভিন্নতার ছোঁয়া একবারেই কম। আশ্বিন মাসের শেষে হাওরের ভাসাপানি সরে যাওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় মানুষের কৃষিকাজের কর্মচাঞ্চল তা। বিস্তৃর্ণ হাওরে কাক-ডাকা ভোর হতে সূর্যাস্ত অবধি চলে সংগ্রামী মানুষের স্বপ্ন বুননের কাজ। শষ্যদোলা বাতাসে দোল খায় কৃষকের আদরের সন্তান। এ যেন হাওর নয়, সবুজ-শ্যামলের গালিচা। তার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকা-বাঁকা নদী। নদীতে চলে হরেক রকমের নৌকা। এক সময় চলতো গুণটানা নৌকা। এখন আর দেখা যায় না। স্থান করে নিয়েছে কলওয়ালা নৌকা। দেখতে দেখতে সবুজ ধানে সোনা রঙ ধরে। বিস্তৃর্ণ হাওরে ছড়িয়ে থাকে কাঁচা সোনা। বৈশাখ মাসে কৃষকের কণ্ঠে থাকে গান, মুখে হাসি আর ঘরে গোলাভরা ধান। শষ্যভান্ডারখ্যাত হাওরাঞ্চলের মানুষের ছয় মাসের পেশা কৃষি কাজ। জ্যৈষ্ঠমাসে হাওরে পানি আসার সাথে সাথে তারা পেশা পরিবর্তন করে হয়ে যায় মৎস্য শিকারী। ছোট-বড় নৌকায় রূপালীজলে দিন-রাত মাছ শিকার করে তারা। এভাবেই চলে তাদের বাকি ছয়মাস। পালাক্রমে পেশা পরিবর্তনের এই ধারা বহমান যুগযুগ ধরে।
হাওরের যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে প্রাজ্ঞজনের বচন- শুকনায় পাও, বর্ষায় নাউ। কিন্তু বর্ষায় হাওর যখন প্রাণ পায়, তখন হাওরের এক উপজেলার সঙ্গে আরেক উপজেলা হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। একেকটি গ্রাম বা উপজেলাকে একেকটি দ্বীপ মনে হয়। শুধু যে দ্বীপ মনে হয় তা কিন্তু নয়। হাওরবাসী আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। যদিও হাওরের প্রান্ত অঞ্চলগুলোকে ‘আভুরা সড়ক’ (যে সড়ক পানিতে ডুবে না) নির্মাণ করে অনেক আগে থেকেই জনগণকে চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সংযুক্ত করা হয়েছে নগর রাষ্ট্রের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সাথে। কিন্তু গভীর হাওরের অবস্থার পরিবর্তন খুব একটা এগোয়নি। তবে ছোঁয়া যে লাগেনি সেটা বলা যাবে না।
নব্বই দশকের শেষের দিকে ইটনা উপজেলায় সড়কপথ ছিল মাত্র দেড় কিলোমিটার। অন্যান্য উপজেলার ইতিহাস খুব বেশি অগ্রসর ছিল বলে মনে হয় না। হাওরে উন্নয়নের পরশ পাথরের ছোঁয়াটা লাগে তখন থেকেই। যার শুরু বিজলী বাতির মাধ্যমে। হাওরের যে জনপদগুলো কেরোসিনের বাতি জ্বেলে সন্ধ্যার পরপরই ঘুমিয়ে পড়তো সেই জনপদগুলো আজ মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকে বিদ্যুতের কল্যাণে। বিদ্যুতের আলোর সাথে সাথেই জ্বেলে ওঠে শিক্ষার আলো। কোন একটি জনপদকে অগ্রসর করার প্রথম সোপান।
শতবছর পরে শুরুটা হলেও গত দুই দশকে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। হাওরের জনপদের মানুষের কল্যাণে তৈরি করা হচ্ছে সমভূমি থেকে ৩০/৪০ ফুট উঁচু রাস্তা। হাওরের বুকচিড়ে পলি-কাদামাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে কাঁচাসড়ক। প্রতিবছর হাওরের বিপুল জলরাশির ঢেউ দ্বারা যেন এসড়ক ওয়াশআউট হয়ে না যায় সেজন্যে সড়কের দু’পাশে বসানো হচ্ছে কংক্রিট নির্মিত স্লাব। উপরে দেয়া হয়েছে পাথরের সাথে বিটুমিন মিশ্রিত প্রলেপ। এভাবেই গভীর হাওরে ২৯.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম মহাসড়ক তৈরি করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে বড়বড় তিনটি ব্রিজ এবং ১৪টি ছোট বড় কালভার্ট ও আরসিসি পুল। স্থানে স্থানে বসানে হয়েছে ফেরী নৌকা। গভীর হাওরের সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। একসময় যারা গুণটানা কিংবা পালতোলা নৌকায় যাতায়াত করতো তারা আজ সাঁ-সাঁ করা গাড়িতে যাতায়াত করছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনে হাওরের জনসাধারণ উপভোগ করছে নগরায়নের পূর্ণ সুবিধা।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা হয়েছে কুসংস্কারমুক্ত। উন্মুক্ত হয়েছে প্রসূতিসহ মানুষের জরুরি চিকিৎসা সেবার দ্বার। হ্রাস পেয়েছে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। উন্নত হয়েছে মানুষের জীবনমান।
এজনপদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বাধাকে সমূলে উৎপাটিত করেছে হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সুষম বন্টন হচ্ছে হাওরের উৎপাদিত ধান ও মাছের। স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণের পর বাড়তি ধান ও মাছ অংশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে অনায়েসে। উন্মুক্ত ও মিশ্রণ ঘটেছে নানান পেশার। কাজে লাগছে অলস পড়ে থাকা শ্রম। বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের জিডিপি। হাওর এলাকার সুনামগঞ্জে ১৯০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে অল সিজন সড়ক, সাবমারজিবল সড়ক এবং উড়াল সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
হাওর এলাকায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করায় প্রতিটি অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বরফকল, চালকলসহ নানান ধরণের কলকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সেনানীবাস স্থাপন করা হয়েছে। উন্মুক্ত হচ্ছে পর্যটনের সম্ভবনা। তৈরি করা হচ্ছে অবকাশ কেন্দ্র ও রিসোর্ট। দূরদূরান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসুর সমাগম ঘটছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। এভাবেই হাওরে তৈরি হচ্ছে নগরায়ন। তবে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে নগরায়নের যাতাকলে যেন হাওরের ইকোলজি ও বায়োডাইভারসিটি নষ্ট না হয়।
হাওরের নগরায়ন কোন একক ব্যক্তি বা দলের কৃতিত্ব নয়। স্থানীয় জনগণ, বুদ্ধিজীবী, উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদসহ সমাজের নানা পেশার মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে বাস্তবায়ন হচ্ছে হাওরের নগরায়ন। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন ঝক ঝক ঝক শব্দে ট্রেন ছুটে চলবে হাওরের বুকচিরে।