হাওর বার্তা ডেস্কঃ নেত্রকোণার খালিয়াজুরী একটি হাওড় অধ্যুষিত উপজেলা হিসেবে খ্যাত। যেখানকার জলাশয়গুলি বছরের প্রায় সাত মাস পানির নীছে থাকে। এক সময় এই উপজেলা দেশীয় প্রজাতির মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য মৎস্য সম্পদের ভান্ডার হিসেবে পরিচিতি ছিল। নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের রাজধানীসহ সারাদেশে খালিয়াজুরীর প্রাকৃতিক মাছ রপ্তানি হত। খালিয়াজুরী মাছের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। নানা অব্যবস্থাপনা ও সরকারী অপরিকল্পিত কিছু সিদ্ধান্তের কারণেই হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাকৃতিক দেশীয় মৎস্য সম্পদ। দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে এই সম্পদ।
খালিয়াজুরীর যেমন উৎপন্ন হয় ধান তেমনি ধান চাষের পরেই দ্বিতীয় আয়ের উৎস মৎস্য। মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে হাওড় এলাকার হাজারো মানুষসহ খেটে খাওয়া জেলেরা। জেলে পাড়ার জেলেরাও হতাশা গ্রস্থ মৎস্য সম্পদ প্রায় বিলুপ্তির জন্য। তাদের রুজি রুজগার দিনকে দিন কমে যাচ্ছে, ফলে জেলেদেরও জীবণ ধারণে হচ্ছে কষ্ট। এখন আগের মত শিকার করতে পারে না মাছ। জেলে পাড়ার কয়েকজন জেলে প্রতাকী বর্মন, পৃথ্বিশ বর্মন, তারামন বর্মন নিখিল বর্মন, রঞ্জিত দাসসহ অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন জলাশয় গুলিতে আর আগের মত মাছ আর পাওয়া যায় না। আর মাছ না পাওয়াতে ঋণ করে বা আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে মাছ ধরার জাল কিনে ঠিকমত ঋণ পরিশোধ করতে পারি না। যার ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে কোন রকমে কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। দাদনের টাকাও সময়মত পরিশোধ করতে পারি না। এ বিষয়ে তারা আরো বলেন, আগের মত দেশীয় প্রজাতির গাং রানী, মাইট্যা রানী, গাং মাগুড় পুটি,গাউরা, বাচা, শিং, মাগুর, মেনি, চিতল, গাঙ্গের পাঙ্গাস, মলা, ঢেলা, ছেলা, খলিশা, কই, শোল, গজার, টাকিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এগুলো বড় বেশী পাওয়া যায় না। তারমধ্যে নানিদ, রিডা, গাং মাগুড় এগুলো তো বিলুপ্ত হয়েই গেছে, সারা বছরেও চোঁখে পড়ে না।
স্থানীয় মাছের আড়ঁতে দেখা যায় এখন আর আগের মত দেশীয় মাছ পাওয়া যায় না। বড় বড় হাওড়, বিল থাকার পরও মিলে না পর্যাপ্ত মাছ। আর জেলেরা মাছ না পাওয়াতে আমরাও মাছ বিক্রি করতে পারি না। কর্মচারীদের বেতন ও ঠিকমত দিতে পারি না। একথা বলছেন মৎস্য আড়তদাররা । মা গঙ্গা মৎস্য সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিখিল বর্মন বলেন, প্রতিবছর জলমহাল খাজনার পরিমাণ বেশী ও জলমহালে মাছ কম থাকায় দিনে দিনে মৎস্যজীবি সমিতি গুলো টিকিয়ে রাখার আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে।
শুকনো মৌমুমে পানি কমতে শুরু করলে প্রথমে জাল দিয়ে মাছ ধরা শুরু করে। মাঘ ও ফাল্গুন মাসে পানি যখন একেবারে কমে যায় ইজারাধারা ও জেলেরা তখন নদী, নালা, বিল সব সেচ দিয়ে শুঁকিয়ে মাছ ধরে অধিক লাভের আশায়। সেচকৃত জলাশয় গুলোতে লবণ ও সার দিয়ে মাটির নিচের মাছ গুলিও ধরে ফেলে। যার কারণে বৈশাখ মাসে নতুন পানিতে প্রজননের সময় মাছ ডিম দিতে না পারায় জন্ম নেয় না নতুন মাছের পোনা। আগের মত নাব্যতা না থাকায় মাছ বিলুপ্তির আরও একটি কারণ বলছেন হাওড় ও মৎস গবেষকরা ।
দিনে দিনে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। জেলেরা মাছ পায় না। । মাছ কম আসাতে আড়ৎদারদের আড়ৎ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। কর্মচারীদের বেতন দিতে মালিক পক্ষের খুবই কষ্ট হয়, এ কথা গুলো বলছেন শাহজালাল মৎস্য আড়ৎ মালতি মৎস্য আড়ৎ, অনিমা মৎস্য আড়ৎ, গাং চিল মৎস্য আড়ৎসহ অনেক আড়তের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যাপস্থাপকরা।
খালিয়াজুরী জলমহাল ইজারাদারেরা বলেন, মা মাছ নিধন, এক ধরণের বিষ টোপ ব্যবহার করে মাছ ধরা, শুকিয়ে মাছ ধরা ক্ষুদ্র জলাশয় গুলি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে আশানুরূপ মাছ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালিয়াজুরী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) বলেন, জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি মালা ২০০৯ সনের আইনে ধারায় ২০ একরের নিচে জলমহাল গুলো ইজারা দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি আরো বলেন, ২০০৯ সনের আইনের নীতি মালা ৭ এর (ঙ) ধারায় প্রকৃত মৎস্যজীবিদের মাছ চাষ ও বিপননের সাথে জড়িত যারা আছে কেবল তারাই ইজারা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবেন। এই নীতিমালার প্রেক্ষিতেই জলমহাল ইজারা প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ নীতিমালা বেশীর ভাগ ইজারাধাররা মানছেন না।
দেশীয় প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্তির কারণ জানতে চাইলে খালিয়াজুরী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মুজিবুর রহমান (চলতি দায়িত্ব) বলেন, জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেকটি জলাশয়ের একতৃতীয়াংশ অভয়াশ্রম রাখার কথা থাকলে ও মানা হয় না এ নীতি অনেক ক্ষেত্রেই। তাছাড়া নদীর নাব্যতা কম, কৃষি মৌমুমে জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাছের আবাসন স্থান নষ্ট হওয়ায় মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়। অনেক ক্ষেত্রে মাছও মরে যায়।
হাওড় এলাকার জেলেরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, চট্টগ্রামের হালদা নদী ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ন্যায় যদি আমাদের হাওড় এলাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষার জন্য কিছু নির্দিষ্ট এলাকা বা জলাশয় লিজ মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা গেলেই কেবল হাওড়র মাছের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে খালিয়াজুরী উপজেলার অধ্যাবধি পর্যন্ত কোন টেকনিক্যাল বি,সি,এস কর্মকর্তা যোগদান করে নাই। যার ফল শ্রুতিতে এধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দেশীয় মাছ রক্ষায় নেওয়া হয়না প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। দেশীয় মাছ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করবে সরকার এমনটাই আশাবাদ ব্যক্ত করেন হাওড় পাড়ের জেলেরা।