হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলা নতুন বছর বৈশাখ। কিশোরগঞ্জের হাওর সেজেছে এখন সোনালী রূপে। দিগন্তজোড়া হাওরে এখন শুধুুই সোনালী ধানের ঢেউ, ফলন হয়েছে বাম্পার। কেউ কেউ শুরু করেছেন ধান কাটা। দিন পনেরোতেই শুরু হবে ধান কাটার ধুম। কিশোরগঞ্জের হাওরের বর্তমান চিত্র এটি।
দেশের সাতটি জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে এই হাওরাঞ্চল গঠিত। এই হাওরাঞ্চলের ১২২টি হাওর কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে এই হাওরাঞ্চল থেকে।জেলার কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের সম্পূর্ণ হাওর উপজেলাগুলো হলো অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ও নিকলী। এই এলাকার কৃষকরা বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল। এবারও এই ৪টি হাওর উপজেলার সব কটিতেই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। হাওরে বিআর-২৮, ২৯, ৫৪, ৫৮, ৭৪, ৮৮ জাতের ধানের চাষ বেশি হয়।
প্রতিবছরই এই ৪টি উপজেলার প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়। এইসব জমিতে প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ লক্ষ মেট্রিক টন চাউল উৎপন্ন হয়। জেলায় খাদ্য চাহিদা আছে প্রায় ৫ লক্ষ মেট্রিক টন। ফলে প্রায় ২ থেকে ৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাউল বেশি অবশিষ্ট থাকে। জেলার শুধুমাত্র এই ৪টি হাওর উপজেলা থেকেই দেশে প্রতিবছর মোট খাদ্য চাহিদার ৩০ শতাংশ পূরণ করা হয় বলে জানা গেছে। ফলে কিশোরগঞ্জের এইসব হাওরে উৎপাদিত বোরো দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে।অষ্টগ্রাম উপজেলার ভাতশালা হাওর, কাস্তুল হাওর, ধোবা বিল, বগাডুবি, মান্দা, কারানল, কুলানী, বড়ধলি ও চান্নার হাওর ঘুরে জানা যায়, প্রতি বছর বাম্পার ফলন হলেও বিগত কয়েক বছরের আগাম বন্যা ও নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগে হতাশ হয়ে পড়েছে এই এলাকার কৃষক। তবে এবার কোনো ধরনের দূর্যোগ ও পোকার আক্রমণ না থাকায় এবার ফলন বেশি হয়েছে। তবুও দুশ্চিন্তা যেন পিছু ছাড়ে না কৃষকদের।
সাম্প্রতিক বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি কৃষকদের জন্য নতুন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে সারা দেশে জনসমাগম নিষিদ্ধ করেছে এবং অনেক জেলা, উপজেলা লকডাউন করে দিয়েছে। যার ফলে প্রতি বছর বাহিরের জেলা থেকে যেসব দাওয়াল (ধান কাটা শ্রমিক) হাওরে আসতো এবার সারাদেশ লকডাউন অবস্থাতে থাকায় শ্রমিক আসতে পারবে না। ফলে এবার শ্রমিক সংকটের চিন্তায় অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন এই হাওর এলাকার কৃষকরা।অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়নের কলাপাড়া গ্রামের কৃষক ফারুক মিয়া অনেকটা হতাশা নিয়ে বলেন, “প্রতি বছরই ক্ষেত করি, লাভ নাই। কোনো বছর পানি, কোনো বছর কিরা (পোকা) সব শেষ কইরা দেয়। অহন আর গিরস্তি (চাষাবাদ) ভালা লাগে না। এইবারও কিছু করছিলাম, ফসলও ভালোই অইছে। দেশে নাকি করোনা আইছে সব বন্ধ অইয়া রইছে। সপ্তাহ, দশ দিনের মধ্যে ধান কাটতে অইবো। করোনার লাইগ্য হুনলাম দাওয়াল (শ্রমিক) আইতনা। দাওয়াল না পাইলে ধানও আর ঘরে উঠতনা।
এছাড়া কাস্তুল ইউনিয়নের কৃষক ওবায়দুল্লাহ জানান, আমি দুুই একর ক্ষেত করছি। ফসল ভালোই অইছে। এইবার কোনো ধরনের পোকার আক্রমণ আর দূর্যোগ না থাহুনে ফলন ভালা পাইছি। তবে বৃষ্টি কম হওয়াতে একর প্রতি দুই থাইক্যা তিন হাজার টেহা খরচ বাইরা গেছে। করোনা ভাইরাসের কারণে দাওয়াল পাইতাম না। তবে এলাকার যারা বাইরে কাজ কাম করতো তারা এইবার দেশে আছে। সবাই যদি নিজের জমিতে নিজেরা সময় দেয় তাইলে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব অইবো।
অষ্টগ্রামের কৃষকদের অনেকেই জানান, প্রতি বছর ধান কাটা মৌসুমে এপ্রিল মাসেই দেশের বিভিন্ন জেলা যেমন- দিনাজপুর, রংপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম, কুমিল্লা অঞ্চল থেকে দল বেধে শ্রমিক আসা শুরু হতো। কিন্তু এবার হাওরে শ্রমিক আসার চিত্রটা ভিন্ন। শুধু অষ্টগ্রামেই শ্রমিকের প্রয়োজন প্রায় ৪ হাজার। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি চলে গেলেও কোনো শ্রমিক এলাকায় আসতে পারেনি। তাই দেশের এই করোনা পরিস্থিতিতে যদি ঠিকমতো ফসল ঘরে না উঠাতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। যা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটে রূপ নেবে।
অষ্টগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ শহীদুল ইসলাম জানান, অষ্টগ্রাম উপজেলায় প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। এবারও উপজেলায় বাম্পার ফলন হয়েছে। শ্রমিক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, শ্রমিক সংকট হবে না বলে আশা করি। আমরা এলাকার স্থানীয় শ্রমিকদের ধান কাটতে উদ্বুুদ্ধ করছি। এতে করে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উপজেলার বেকারত্বের হার কমবে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। আমরা মাইকিং করে, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সাথে যোগাযোগ করে শ্রমিক সংগ্রহ করছি। স্থানীয় সংসদ সদস্যও নিয়মিত খোজ খবর রাখছেন ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। সরকার ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্রপাতি দিচ্ছে, আশা করি সমস্যা হবে না।
এ বিষয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রফিকুল আলমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিক সংকট হাওরে কিছুটা প্রভাব ফেলবে। তবে আমরা এলাকার স্থানীয় শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী, রিকশা চালক, হোটেল শ্রমিক যারা ইতিমধ্যে অনেকেই করোনার কারনে বেকার হয়ে পড়েছেন তাদের দিকে জোর দিচ্ছি। ধান কাটা বিষয়ে আমরা প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দিয়েছি। প্রতি ইউনিয়নে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বা নিজেরা যোগাযোগ করে বেকার শ্রমিকদের তালিকা করছি। এছাড়া হাওর উপজেলা হওয়াতে আমাদের হারভেস্টিং মেশিন, ধান কাটা যন্ত্র পর্যাপ্ত পরিমানে সংগ্রহে রয়েছে। যদি বাহিরের শ্রমিকের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে এবার আলাদা মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। যে জেলা থেকে শ্রমিকরা আসবে সেই জেলার জেলা প্রশাসক ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সাথে সমন্বয় করে শ্রমিক আনা হবে এবং তাদেরকে হাওরে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। সংকটময় মুহুুর্তে সবাই একসাথে কাজ করলে আশা করি শ্রমিক সংকট খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।
কিশোরগঞ্জ-৪ (অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন) আসনের স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সারা পৃথিবী এখন আতঙ্কের মাঝে আছে। যেটা হলো করোনা ভাইরাস। তারপরও আমরা যারা হাওরে বসবাস করি বৈশাখ মাসে আমাদের ধান কাটতে হয়। আমরা আশঙ্কা করছি এ বছর অন্যান্য জায়গা থেকে যে ধান কাটার শ্রমিক যাদেরকে আমরা দাওয়াল বলি তারা এইবার আসবে কি না আমরা সন্দিহান। সেই লক্ষ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়েছি আমার এলাকায় যারা ছাত্রলীগ, যুবলীগ করে তারা এই ধান কাটার সময়টাতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে হাওরে ধান কেটে দিবো। যাতে ধান কাটতে কৃষকের সমস্যা না হয়। যদি আমরা এ ফসলটা না উঠাতে পারি তাহলে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিবে। আমরা সবাই এই মুহুর্তে লকডাউন অবস্থায় আছি। লকডাউন অবস্থায় থেকেও আমি মিঠামইনে ছাত্রলীগ, যুবলীগকে সাথে নিয়ে ধান কাটা শুরু করেছি এবং আমি নিজেও কাটছি। ইতিমধ্যে ধান কাটার কাঁচি তৈরীর অর্ডার দিয়েছি। কাঁচিগুলো প্রস্তুত হলে প্রত্যেক ইউনিয়নে আমরা টিম গঠনের মাধ্যমে ধান কাটবো। আমার হাওরের ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবার নজির সৃষ্টি করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।