হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের তথ্যমতে, মালয়েশিয়ায় বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ৩০-৩২ লাখ অভিবাসী শ্রমিক রয়েছে। বিদেশি শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি। মূলত বাংলাদেশিদের কাছে কর্মক্ষেত্র হিসাবে মালয়েশিয়া আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করে ১৯৯০ সালের পর থেকে এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা। এ ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৭৩ হাজারে। মাঝে এ সংখ্যা কমলেও ২০১৬ সালে উভয় দেশের একাধিক শ্রম সংগঠন ও মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষের বিরোধিতার মুখে ১৫ লাখ শ্রমিক নিয়োগের চুক্তি দুই লক্ষাধিক শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে শেষ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শ্রমিক পরবর্তী সময়ে অবৈধ হয়ে যায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুক্তির অস্পষ্টতা, নিয়োগকৃত কোম্পানির জবাবদিহিতার অভাব, অপর্যাপ্ত বেতন, আবাসন সমস্যা এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদাসীনতার কারণে মোট শ্রমিকের বড় একটা অংশ বাধ্য হয় অবৈধ হতে। এ ছাড়া ২০১২-১৩ সাল থেকে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন নামসর্বস্ব কলেজের অধীন ছাত্র ভিসায় যারা এসেছিল, তাদের বড় একটা অংশ পরে অবৈধ হয়ে যায়। আর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া আসা অনেক পর্যটকই নির্ধারিত সময় শেষ হলেও দেশে ফেরত যান না। পাশাপাশি মানব পাচার সিন্ডিকেট তো আছেই। বিদেশ-বিভুঁইয়ে যে কোনো দেশের নাগরিকদের জন্য সেদেশের দূতাবাসের ভূমিকা সহায়ক হয়। সেদিক থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি প্রবাসীরা যেন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মতো! অথচ এ দেশে বিশ্বের অন্য দেশগুলো থেকে আসা শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অভিবাসন ব্যয় সর্বোচ্চ! একই খাতে, একই চুক্তিতে নেপালের একজন শ্রমিক মাত্র ৪০-৫০ হাজার বাংলাদেশি টাকা খরচ করে এলেও বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে সেটা ৩-৪ লাখের মতো! যখন এ লেখাটি লিখছি তখন মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকার একটি খবর: ‘গত ৭ মার্চ রাতে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের হাতে বাংলাদেশিসহ ২০৫ জন আটক’। খবরটি দেখেই বোঝা যায়, আটক বাংলাদেশি শ্রমিকরা অবৈধ। গত ৫ বছরের মালয়েশিয়া প্রবাসজীবনে খুব কাছ থেকে দেখেছি একজন প্রবাসী কেন অবৈধ হয়। আমাদের স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিক ভাইদের অবৈধ হওয়ার পেছনে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো নিজেদেরই দোষ আছে; কিন্তু মোটা দাগে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। কোনো দেশ বা সেদেশের কোম্পানিগুলোতে শ্রমিক পাঠাতে গেলে অবশ্যই চুক্তিতে চুক্তির মেয়াদ, শ্রমঘণ্টা, ঘণ্টাপ্রতি মজুরি, সাপ্তাহিক ছুটি, বার্ষিক ছুটি কিংবা আবাসন ব্যবস্থার সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা উচিত এবং এক্ষেত্রে যথাযথ মনিটরিংও জরুরি। সেদিক থেকে মালয়েশিয়া প্রবাসীরা চরম অবহেলিত ও বঞ্চিত। শ্রম আইন অনুযায়ী ৮ ঘণ্টা বেসিক উল্লেখ থাকলেও প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই ১০-১২ ঘণ্টা বেসিক হিসাবে কাজ করে থাকেন।
কুয়ালালামপুরে অবস্থিত অন্যান্য দেশের যত দূতাবাস আছে, তার মধ্যে আমাদের হাইকমিশনই একমাত্র দূতাবাস যেখানে পাসপোর্ট নবায়ন করতে গেলে দালালের দ্বারস্থ হতে হয়, না-হলে ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায় না। করোনাকালে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে হাইকমিশন থেকে ‘পোস্টলাজু’র মাধ্যমে পাসপোর্ট রি-ইস্যুর আবেদন গ্রহণ শুরু করা হয়। এতে মনে হয়েছিল, দালাল প্রথা হয়তো এবার থাকবে না। কিন্তু বিধি বাম! দালাল প্রথা তো টিকে আছেই, সেই সঙ্গে বেড়েছে দালালদের সার্ভিস চার্জ! গত বছর ১০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বাহিনীর হাতে আটক হয়ে জেল খাটার পর দেশে ফেরত গেছেন এবং এখনো যাচ্ছেন। এর দায়ভার কি শুধু এই স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকদের? যাদের শ্রমে-ঘামে মজবুত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, তারা আর কতদিন এভাবে অভিভাবকহীন থাকবেন? তাদের দেখার কি কেউ নেই?
মাহবুব হাসান : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া