হাওর বার্তা ডেস্কঃ বর্তমান ডিজিটালের যুগ এসেছে। তাই ডিজিটাল যুগের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে চায় সবাই। যেখানে একসময় হাওরের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে অবহেলিত এক জনপথ। বর্তমানে সেই কথা ভাবার আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া এখন হাওরবাসীর গায়েও লেগেছে।
বিশেষ করে তিন উপজেলা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের হাওরাঞ্চলে এখন সেই অবহেলিত জনপথ নেই।
হাওরে বদলে গেছে দৃশ্যপট, লেগেছে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এই আসন থেকে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর বর্তমানে রাষ্ট্রপতিপুত্র রেজওয়ান আহম্মদ তৌফিক এই আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য।
বৈঠা ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাই ছিল হাওরাঞ্চলের লোকজনের একমাত্র ভরসা। যোগাযোগ ও পরিবহন কাজে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহনের চিন্তাও করা যেত না।
বর্ষা মৌসুমের ৬ মাস নৌকাযোগে কোনোরকমে যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা চললেও শুকনো মৌসুমের ৬ মাস অবর্ণনীয় দুর্ভোগ-ভোগান্তির শিকার হতে হতো এ হাওরবাসীকে। অবস্থা এতটাই দুর্গম ছিল যে, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি করতে অনীহা প্রকাশ করতেন। প্রণোদনা দিতে সরকার তাদের জন্য ‘হাওর অ্যালাউন্স’ প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়।
ভৌগোলিক কারণে এ অবস্থার পরিবর্তনের চিন্তাও করত না হাওরবাসী। কিন্তু সেই দুঃস্বপ্নও গত বছরের ২৬ জানুয়ারি বাস্তব হয়ে ধরা দিল কিশোরগঞ্জের হাওরবাসীর কাছে।
চার চাকার যানবাহন নিয়ে কিশোরগঞ্জের হাওরঅধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম যেতে পারছেন হাওরবাসীরা। ছবির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সারাবছর ব্যবহার উপযোগী সড়কে চলাচল করছে যানবাহন। স্থানীয়রা এই দিনটিকে হাওরে নতুন যুগের সূচনা বলে অভিহিত করেন।
গত বছরের ২৬ জানুয়ারি জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা ও চামড়াঘাট, ইটনার বরিবাড়ি ও বলদা এবং মিঠামইনের শান্তিপুর ঘাটে পাঁচটি ফেরি একযোগে চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় সরাসরি যানবাহন চলাচল। তিন উপজেলায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৮৪ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
ধান চাষ ও সোনালি ফসল সংগ্রহের জন্য হাওরে কিছু অস্থায়ী ঘর তৈরি করেন কৃষকরা। আর ঘরগুলো তৈরি করা হয় ছন ও বাঁশ দিয়ে। কৃষকরা ধান দেখাশোনার জন্য জিরাতিদের গলা (অস্থায়ী বসতি) তৈরি করেছেন। বাড়ি থেকে জমির দূরত্ব বেশি থাকার কারণে বোরো ধান চাষ ও তদারকি করার জন্য জিরাতিদের গলায় বসতি শুরু করেন কৃষকরা।
হাওরের বোরো ধানের জমির পাশে বা অনাবাদি উঁচু জমিতে ছন ও বাঁশ দিয়ে এ জিরাতিদের গলা তৈরি করে থাকেন কৃষকরা। বোরো ধান চাষের শুরু থেকে এ সোনালি ফসল সংগ্রহের শেষ পর্যন্ত হাওরেই রাত যাপন করেন তারা।
সরেজমিনে হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, হাওরে অনেক ছোট ছোট অস্থায়ী ছনের ঘর রয়েছে। কৃষি কাজের পাশাপাশি রান্নার জন্য চুলা বানিয়ে রান্না করা হচ্ছে এসব অস্থায়ী ছনের ঘরে। থাকা খাওয়া বিশ্রাম সব কিছুই হচ্ছে হাওরের ছোট্ট এই ঘরটিতে।
এ রকম ছোট ছনের ঘরে থাকা কৃষক ছমির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘বোরো ধান চাষ করার ল্যাইগ্যেই হাওরে ছন ও বাঁশ দ্যায়া এই ঘরগুলো বানাইছে সবাই। আমরা এসব ঘরেই রাইতে থাহি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঝড়বৃষ্টি না অহলে ভয় অয় না, সারারাত হাওরে মানুষ থাহে। ঝড়বৃষ্টি অইলে এহানে থাকতে ভয় লাগে। ওপরলার উপর ভরসা কইরাই আমরা রাইত কাটাই এসব ঘরে। তবে অহন বেশি ভয় করে না, কারণ সৌরবিদ্যুৎ আছে। অন্ধকার অইলেও সারা রাইত ঘরে বাতি জ্বলে।’
অনেক ঘরে গিয়ে দেখা যায়, সৌরবিদ্যুৎ চালিত ছোট ছোট ফ্যানও আছে; যা গরমকালে কাজে লাগে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। রাতের অন্ধকারে বিশাল হাওরের বুকে অস্থায়ী ছোট ছোট ছনের ঘরে সৌরবিদ্যুতের বাতি জ্বললে জোনাকি পোকার আলোর মতো মনে হয়।