দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো সারাদেশে চার হাজার ২৭৯ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ছয় ধাপে এই নির্বাচন করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এবারই প্রথম স্থানীয় পর্যায়ের সবচেয়ে বড় নির্বাচনে অনুষ্ঠানিকভাবে তফসিল ঘোষণা করেনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।
রীতি অনুযায়ী স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে গণমাধ্যমকে জানানো রেওয়াজ থাকলেও তা করেনি কমিশন। দায়সারা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তফসিল ঘোষণা করা হলেও তাতে এ নির্বাচনের ভোটার, ভোটকেন্দ্র, ভোটকক্ষ ও রিটার্নিং অফিসার নিয়োগসহ কোনো তথ্যই জানানো হয়নি।
ইসির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রথম ধাপে ৭৫২ ইউপির তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী এ ধাপের ভোট গ্রহণ হচ্ছে ২২ মার্চ। এরপর পর্যায়ক্রমে চার হাজার ২৭৫ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া প্রতি ধাপে তফসিল ঘোষণার পর পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন প্রধানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম ও নমুনা স্বাক্ষর পাঠাতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছে কমিশন।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ছয়টি ধাপে ভোটের তারিখ চূড়ান্ত করে স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিস্তারিত তফসিল ঘোষণার দায়িত্ব দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দেশের নবম ইউনিয়ন পরিষদের এ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান পদে দলভিত্তিক ভোটগ্রহণ হবে।
নানা অব্যবস্থাপনার মধ্যে বেলা দুইটার পরে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের ইউপি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের কথা জানান।
এসময় নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম ধাপে ৭৫২ ইউপির ভোট হবে ২২ মার্চ। এরপর ৩১ মার্চ ৭১০টি ইউপি, ২৩ এপ্রিল ৭১১টি ইউপি, ৭ মে ৭২৮টি ইউপি, ২৮ মে ৭১৪টি ইউপি এবং ৪ জুন ৬৬০টি ইউপিতে ভোট হবে। এইএসসি পরীক্ষার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে এই তারিখ ঠিক করা হয়েছে। প্রথম দফার তফসিল কমিশন ঠিক করেছে। বাকিগুলো স্থানীয় পর্যায়ে ঘোষণা করা হবে।
তফসিল নিয়ে কমিশনের বৈঠক শেষে শাহ নেওয়াজ বলেন, গত পৌরসভা নির্বাচনেও কিছু কিছু গাফিলতির ঘটনা ঘটেছিল, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। ইউপি নির্বাচন উপলক্ষে আরো কঠোরভাবে তাদের হ্যান্ডল করবো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দ্যেশে বলতে চাই, কেউ গাফিলতি করলে বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সাথে সাথে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আলোচনা করেই নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেন তারা সুন্দরভাবেই নির্বাচন পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। তাই কেউ গাফিলতি করলে বা কারো পক্ষে কাজ করার চেষ্টা কঠোরভাবে দমন করবো।
নির্বাচনে গণমাধ্যম কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে- প্রশাসন না ইসির এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্পষ্টভাবে বলতে চাই-গণমাধ্যম আমাদের খবর জানানোর চেষ্টা করে। তাই তারা কেন্দ্রে প্রবেশ করেই খবর দেবে। কিন্তু বেশিক্ষণ কেন্দ্রে অবস্থান করবে না।
ইসির জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান আরজু বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান, প্রথম দফায় ২২ মার্চের নির্বাচনে অংশ নিতে ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে। ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি বাছাইয়ের পর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় রাখা হয়েছে ২ মার্চ। প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে ৩ মার্চ। দলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদে প্রথম ভোট হচ্ছে এবার। চেয়ারম্যান পদে নিবন্ধিত দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকছে। চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন দলীয়ভাবে হলেও সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত নারী সদস্য পদের ভোট হবে নির্দলীয়ভাবে।
তিনি জানান, দেশের সাড়ে চার হাজার ইউপির মধ্যে মার্চ থেকে জুন সময়ে নির্বাচন উপযোগী রয়েছে চার হাজার ২৭৫টি। এর মধ্যে প্রথম পর্বে ৭৫২টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হচ্ছে। বাকি ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ভোট এইচএসসি পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে করা হবে।
এদিকে তফসিল ঘোষণার দিন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনীর জাতীয় সমাবেশে যোগ দিতে গিয়েছিলেন গাজীপুরের সফিপুরে। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে ইসি ভোটের জন্য ছয়টি দিন চূড়ান্ত করেন।
প্রথম ধাপে ৭৫২টি ইউপির ভোট হবে জানানো হলেও এ তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টায়। এসব ইউপির ভোটার সংখ্যা কত, পদ কতটি ও কয়টি ভোটকেন্দ্র ও রিটার্নিং অফিসার কে হচ্ছেন তা জানাতে পারেনি কমিশন।
ইসির জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামানই সংক্ষিপ্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রথম ধাপের তফসিল ঘোষণা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, সব সময় দেখে এসেছি বড় নির্বাচনের তফসিল সিইসি দেন, বৃহস্পতিবারের মতো ইউপির তফসিল না দেয়ার নজির এর আগে কখনো দেখেননি বলেও জানান তারা। তফসিলের আগে দলভিত্তিক ইউপি নির্বাচনের বিষয়ে বুধবার নির্বাচন বিধিমালা ও আচরণবিধি জারি করেছে ইসি সচিবালয়।
ছয় ধাপে ইউপি নির্বাচন
১১ ফেব্রুয়ারি ৭৫২ ইউপির তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এসব ইউপিতে ভোট হবে ২২ মার্চ (মঙ্গলবার)। দ্বিতীয় পর্বের ৭১০ ইউপির তফসিল হবে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ভোট ৩১ মার্চ (বৃহস্পতিবার)। তৃতীয় পর্বে ৭১১ ইউপির ১৫ মার্চ তফসিল হবে। ভোট হবে ২৩ এপ্রিল। চতুর্থ পর্যায়ে ৭২৮ ইউপির তফসিল হবে ২৭ মার্চ। ভোট হবে ৭ মে। ৫ম ধাপে ৭১৪ ইউপির তফসিল হবে ২১ এপিল। ভোট হবে ২৮ মে। এবং শেষ বা ষষ্ঠ ধাপে ভোট হবে ৪ জুন। ২৮ এপ্রিল ৬৬০ ইউপির তফসিল ঘোষণা করা হবে স্থানীয় পর্যায়ে।
সাত দিনের মধ্যে প্রার্থীর চূড়ান্তে দলকে ইসির চিঠি: প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিটি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। এজন্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে তফসিল ঘোষনার ৭ দিনের মধ্যে দলের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম,পদবী, নমুনা স্বাক্ষারসহ একটি চিঠি রিটানিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার জন্যে নিবন্ধিত দলগুলোকে চিঠি দিয়েছে ইসি।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ২৯ (৩) ধারা অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তারিখ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। এ হিসাবে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে সবগুলো ইউপির নির্বাচন শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এর আগে দেশে সব মিলিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে আটবার। সর্বশেষ ২০১১ সালে ২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল প্রথম দফায় প্রায় ছয়শ ইউপিতে ভোট হয়। দ্বিতীয় দফায় ৩১ মে থেকে ৫ জুলাই তিন হাজার আটশর বেশি ইউপিতে নির্বাচন করা হয়।