জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ঢাকাস্থ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আরবী ভাষা শিখছেন রুমা আক্তার। রুটি মানে খবুজ, ভাত মানে রুজ- এমন দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য ৩০০ থেকে ৩৫০টি শব্দ শিখতে হচ্ছে তাকে।
রুমা জানান, অভাবের সংসার, স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এখন দুইটি সন্তান নিয়ে ভালভাবে বেঁচে থাকতে তিনি আরবী শিখে কোনো আরব দেশে যেতে চান। হবিগঞ্জের মাহমুদার মাথায় ঋণের বোঝা, স্বামী অসুস্থ হওয়ায় তাকে ঋণ করতে হয়েছে।
জায়গা-জমি যা ছিল তা গেছে আগেই। এখন শুধু ভিটেটা আছে। তাই বাঁচাতে বিদেশ যাবেন। পড়ালেখা জানেন না। তবে ঘর-সংসারের কাজ সবই জানেন। তাই পুঁজি করে যেতে চান জর্ডান। গ্রামের এক আত্মীয় তাকে এখানে হাউজকিপিংয়ে ট্রেনিং নিতে বলেছেন।
রুমা-মাহমুদার মতো এমন হাজার হাজার নারী এখন দারিদ্র্যমুক্ত জীবনের স্বপ্নপূরণে পাড়ি জমাতে চাচ্ছেন বিদেশে। সে কারণে প্রশিক্ষণের জন্য ছুটে আসছেন জনশক্তি ব্যুরোর ছয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে গত বছর ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮ নারী শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন।
এদের মধ্যে ৬১ হাজার ৮৬৬ জনই গৃহশ্রমিক বা হাউজকিপিং কাজে দেশ ছাড়েন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, নারী শ্রমিকের অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। যার ফলে ক্রমেই বাড়ছে বিদেশগামী নারী শ্রমিকের সংখ্যা।
সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক খলিলুর রহমান জানান, ঢাকাসহ দেশের ৬ বিভাগীয় শহরে ৬টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বছরে ৫০ হাজারেরও অধিক নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। তাছাড়া অন্যান্য প্রশিক্ষ কেন্দ্র থেকেও হাউজকিপিং-এর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কেউ কেউ নিজেরা এলেও বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থী আসেন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে।
সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, দুবাই, আবুধাবি, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে গৃহশ্রমিকের চাহিদা আছে। সৌদি আরবে ২০১৪ সাল থেকে নারী গৃহশ্রমিক নেয়া শুরু হয়েছে। এদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ সুবিধাও দেয় বলে তিনি জানান।
জনশক্তি ব্যুরো পরিচালিত ঢাকার শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ফৌজিয়া শাহনাজ জানান, তার প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে তিনশ নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেই হিসেবে বছরে ৩ হাজার ৬শ নারী আবাসিক ও অনাবাসিক প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। এখানে সৌদি আরবগামীদের জন্য একমাসের আবাসিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে।
এই প্রশিক্ষণ বিনামূল্যে করানো হয়, তবে আবাসিকদের জন্য থাকা-খাওয়া বাবদ কিছু ফি নেয়া হয়। তিনি আরো জানান, প্রশিক্ষণার্থীদের দৈনন্দিন জীবযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন ব্যবহার, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারা কোনো বিপদে পড়লে কি করবেন এবং অর্জিত অর্থ সদ্ব্যবহারের বিষয়টিও প্রশিক্ষণের আওতায় থাকে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস (বিলস)-এর সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, এই নারী শ্রমিকরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, তবে তাদের নিরাপত্তার দিকটিকে উপেক্ষা করা যাবে না। কারণ এই শ্রমিকরা নানা রকম পরিবেশগত অসুবিধায় ভোগেন।
তাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে নিয়মিত শ্রমিকদের মনিটরিং করা দরকার। তিনি সপ্তাহে একদিন গৃহশ্রমিকদের সাথে ফোনে কথা বলা এবং তিনমাসে অন্তত একবার শ্রমিকদের সাথে দূতাবাসের পক্ষ থেকে দেখা করার ব্যাপারে সুপারিশ করেন।
এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে বৈধভাবে নারী শ্রমিক প্রবাসে কাজ করতে যায়। এপর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ নারী শ্রমিক প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। যা মোট প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকের ১৫ শতাংশ। তিনি বলেন, বিদেশে গৃহশ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণে আমরা নারীদের চুক্তিপত্রসহ গমনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেই। চুক্তিপত্রে কত ঘণ্টা কাজ, বেতন কত, খাবার ও থাকা কার অধীনে, চিকিত্সা ও ছুটিসহ সকল বিষয় উল্লেখ থাকে।
নিরাপত্তার স্বার্থে সম্প্রতি সৌদি আরবে কোনো নারী কাজ করতে গেলে সেখানে তার নিকট পুরুষ আত্মীয় নেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন একই বাড়িতে বোন গৃহশ্রমিক হলে ভাই ড্রাইভার হতে পারবে। তিনি আরো বলেন, স্মার্ট কার্ড বিদেশে গমনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বৈধতা নিশ্চিত করেছে। কার্ডে তাদের সব তথ্য থাকে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একজন কল্যাণ সহায়ক দূতাবাসে থাকেন। যে কোনো বিপদে তার সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি জানান। -ইত্তেফাক