ঢাকা ০২:৩৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফেইসবুক আমারে বারোডা বাজাইয়া দিসে :চাষি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:০৩:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২১
  • ২০৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রথমবারের মতো সূর্যমুখি চাষ করেছেন কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় এক চাষি। তার দৃষ্টিনন্দন ফসলের মাঠ এখন হয়ে গেছে তার গলার কাটা। মাঠে গিয়ে ছবি তুলতে দলে দলে মানুষ এসে ক্ষতি করছে গাছের। শেষ পর্যন্ত ফলন ঘরে তুলতে পারবেন কি না, এ নিয়েই শঙ্কিত চাষি।

কিশোরগঞ্জের হাওরের উপজেলা নিকলীতে চাষিরা ধান থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। এবার ব্যাপকভাবে চাষ হয়েছে ভুট্টা, কেউ কেউ ফলিয়েছেন সরিষা।সূর্যমুখী চাষে স্বপ্ন দেখছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চাষিরা | Adhunik Krishi  Khamar

চারিদ্বার গ্রামের পাটাচড়া কান্দার মিয়া হোসেন তিন বছর ধরেই আবাদ করেছেন সূর্যমুখী। কিন্তু এবারের মতো বিপাকে আর কখনও পড়েননি।

মিয়া হোসেন চাষ করেছেন ৭৫ শতাংশ জমিতে। পুরো মাঠেই ফুলগুলো দৃষ্টিনন্দন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটিই কাল হলো তার।

গাছগুলো বড় হয়ে যখন ফুল ধরেছে, তখন কেউ একজন ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ওমনি এলাকায় হয়ে গেল ভাইরাল। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে ২০, ৩০, ৪০ কিলোমিটার দূর থেকে মানুষ আসতে থাকে ফসলের মাঠে। এমনকি ঢাকা থেকেও মানুষ যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।সূর্যমুখী ফুল চাষ | Greeniculture

কেউ ছবি তুলে মাঠের পাশে থেকে, কেউ বা ভেতরে চলে যায়। তাতে গাছের ক্ষতি হলো কি না, তার ভ্রুক্ষেপ নেই।

মিয়া হোসেন বলেন, ‘ফেইসবুক আমারে বারোডা বাজাইয়া দিসে। ছবি ছাড়ার লাইগ্গা মাইনষে আমার সর্বনাশ কইরে দিসে। ক্ষেতে আইলে হেরার তো আনন্দের সীমা নাই আর আমার বুকটা ফাইট্টা যায়।

 

‘হের পরেও যহন জিগাই আফনেরা কইত্তে (কোথা থেকে) আইছুইন? কয় ঢাহাত্তে (ঢাকা থেকে) আইছি। হেইবালা (তখন) আমার ক্ষতি অইলেও হেরার (তাদের) মুহের দিকে চাইয়া আমি আর না করতাম ফারি না।’

চাষির দুঃখ, মানুষ কেবল ছবি তুলে না, ফুলও ছিড়ে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘কষ্টডা লাগে যেইবালা (যখন) দেহি ছবিও তুলে আরেকবার যাওনের সময় ফুল ছিইড়া ব্যাগে ভইরা লইয়া যায়।’

মানুষের এই প্রবণতা নিয়ে কিশোরগঞ্জকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ফসলের মাঠের কেন ক্ষতি না করার অনুরোধ করে শত শত মানুষ লিখছেন।

চাষি মিয়া হোসেন বলেন, ‘কেউ কেউ দেহি ভিডিও করোনের লাইগ্গা ক্ষেত পাতাইরা (মাঝ বরাবর) দৌড় মারে। মাঝে মাঝে মনডা কয় লাডি দিয়া ফিট পাতাইরে (পিঠের মধ্যে) একটা বারি মারি।’

অতিথি আপ্যায়নে এই এলাকার সুনাম আছে। আর সেই চিন্তা থেকেই মিয়া হোসেন কড়া হতে পারেন না।

তিনি বলেন, ‘হেরা মেমান (মেহমান)। এর লাইগ্গা আর কিস্তা (কিছু) না কইয়া খালি চাইয়া চাইয়া দেহি।’

এই এলাকাটি ধান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু দাম না পাওয়া, অকাল বন্যায় ফসলহানি, আবাদের খরচ বেশিসহ নানা কারণে ধান চাষ থেকে সরেছেন মিয়া হোসেন।

গত দুই বছর সূর্যমুখি চাষ করে বেশ ভালো মুনাফা হয়েছে তার। কিন্তু এবার সেলফিবাজরা তার সর্বনাশ করে দেবে বলে ধারণা তার।

ঢাকার জুরাইন থেকে আসা ছবি তুলতে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব রহমান জানান, গত বর্ষায় সপরিবারের নিকলীতে এসেছিলেন পানি দেখতে। এখন ফেসবুকে সূর্যমুখী ফুলের ছবি দেখে সপরিবারে আবার এসেছেন তিনি।

ক্ষেতে এভাবে নিজেদের ছবি তুলতে গিয়ে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের তিনি বলেন, ‘ক্ষতি তো হচ্ছেই।’

তিনি বলেন, ‘জমির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে তো কৃষকের কোন ক্ষতি হওয়ায় কথা না, কিন্তু জমিতে দৌড়াদৌড়ি করে ফুল ছিড়লে তো ক্ষতি হবেই।’

 

হাসিবুর রহমান মানুষের অসচেতনতা দেখে নিজেও লজ্জিত। বলেন, ‘এভাবে মানুষের দৌড়াদৌড়ি দেখে আমারও খারাপ লাগছে। নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য অন্যের ক্ষতি করা তো ঠিক না।’

চাষি মিয়া হোসেনের শ্যালক জাইদুল নাঈম জানান, মানুষ এত ক্ষতি করার পড়েও আন্তরিকতার সঙ্গে সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করছেন কৃষক মিয়া হোসেন।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য যে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে সে বিষয়ে তাদের কারো কোনো খেয়ালই নাই।

‘কারও পৌষ মাস, আর কারও সর্বনাশ’- হতাশ কণ্ঠে বলেন চাষির শ্যালক।

নিকলী উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সূর্যমুখী বারি-৩ প্রদর্শনীর জন্য কৃষক জালালউদ্দীনের মাধ্যমে এক একর জমিতে চাষ করা হয়েছিল।

ফুল ফোটার পর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় পর পর্যটকদের ভিড় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জমিতে প্রবেশ কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ফেইসবুক আমারে বারোডা বাজাইয়া দিসে :চাষি

আপডেট টাইম : ০৬:০৩:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২১

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রথমবারের মতো সূর্যমুখি চাষ করেছেন কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় এক চাষি। তার দৃষ্টিনন্দন ফসলের মাঠ এখন হয়ে গেছে তার গলার কাটা। মাঠে গিয়ে ছবি তুলতে দলে দলে মানুষ এসে ক্ষতি করছে গাছের। শেষ পর্যন্ত ফলন ঘরে তুলতে পারবেন কি না, এ নিয়েই শঙ্কিত চাষি।

কিশোরগঞ্জের হাওরের উপজেলা নিকলীতে চাষিরা ধান থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। এবার ব্যাপকভাবে চাষ হয়েছে ভুট্টা, কেউ কেউ ফলিয়েছেন সরিষা।সূর্যমুখী চাষে স্বপ্ন দেখছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চাষিরা | Adhunik Krishi  Khamar

চারিদ্বার গ্রামের পাটাচড়া কান্দার মিয়া হোসেন তিন বছর ধরেই আবাদ করেছেন সূর্যমুখী। কিন্তু এবারের মতো বিপাকে আর কখনও পড়েননি।

মিয়া হোসেন চাষ করেছেন ৭৫ শতাংশ জমিতে। পুরো মাঠেই ফুলগুলো দৃষ্টিনন্দন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটিই কাল হলো তার।

গাছগুলো বড় হয়ে যখন ফুল ধরেছে, তখন কেউ একজন ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ওমনি এলাকায় হয়ে গেল ভাইরাল। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে ২০, ৩০, ৪০ কিলোমিটার দূর থেকে মানুষ আসতে থাকে ফসলের মাঠে। এমনকি ঢাকা থেকেও মানুষ যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।সূর্যমুখী ফুল চাষ | Greeniculture

কেউ ছবি তুলে মাঠের পাশে থেকে, কেউ বা ভেতরে চলে যায়। তাতে গাছের ক্ষতি হলো কি না, তার ভ্রুক্ষেপ নেই।

মিয়া হোসেন বলেন, ‘ফেইসবুক আমারে বারোডা বাজাইয়া দিসে। ছবি ছাড়ার লাইগ্গা মাইনষে আমার সর্বনাশ কইরে দিসে। ক্ষেতে আইলে হেরার তো আনন্দের সীমা নাই আর আমার বুকটা ফাইট্টা যায়।

 

‘হের পরেও যহন জিগাই আফনেরা কইত্তে (কোথা থেকে) আইছুইন? কয় ঢাহাত্তে (ঢাকা থেকে) আইছি। হেইবালা (তখন) আমার ক্ষতি অইলেও হেরার (তাদের) মুহের দিকে চাইয়া আমি আর না করতাম ফারি না।’

চাষির দুঃখ, মানুষ কেবল ছবি তুলে না, ফুলও ছিড়ে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘কষ্টডা লাগে যেইবালা (যখন) দেহি ছবিও তুলে আরেকবার যাওনের সময় ফুল ছিইড়া ব্যাগে ভইরা লইয়া যায়।’

মানুষের এই প্রবণতা নিয়ে কিশোরগঞ্জকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ফসলের মাঠের কেন ক্ষতি না করার অনুরোধ করে শত শত মানুষ লিখছেন।

চাষি মিয়া হোসেন বলেন, ‘কেউ কেউ দেহি ভিডিও করোনের লাইগ্গা ক্ষেত পাতাইরা (মাঝ বরাবর) দৌড় মারে। মাঝে মাঝে মনডা কয় লাডি দিয়া ফিট পাতাইরে (পিঠের মধ্যে) একটা বারি মারি।’

অতিথি আপ্যায়নে এই এলাকার সুনাম আছে। আর সেই চিন্তা থেকেই মিয়া হোসেন কড়া হতে পারেন না।

তিনি বলেন, ‘হেরা মেমান (মেহমান)। এর লাইগ্গা আর কিস্তা (কিছু) না কইয়া খালি চাইয়া চাইয়া দেহি।’

এই এলাকাটি ধান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু দাম না পাওয়া, অকাল বন্যায় ফসলহানি, আবাদের খরচ বেশিসহ নানা কারণে ধান চাষ থেকে সরেছেন মিয়া হোসেন।

গত দুই বছর সূর্যমুখি চাষ করে বেশ ভালো মুনাফা হয়েছে তার। কিন্তু এবার সেলফিবাজরা তার সর্বনাশ করে দেবে বলে ধারণা তার।

ঢাকার জুরাইন থেকে আসা ছবি তুলতে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব রহমান জানান, গত বর্ষায় সপরিবারের নিকলীতে এসেছিলেন পানি দেখতে। এখন ফেসবুকে সূর্যমুখী ফুলের ছবি দেখে সপরিবারে আবার এসেছেন তিনি।

ক্ষেতে এভাবে নিজেদের ছবি তুলতে গিয়ে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের তিনি বলেন, ‘ক্ষতি তো হচ্ছেই।’

তিনি বলেন, ‘জমির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে তো কৃষকের কোন ক্ষতি হওয়ায় কথা না, কিন্তু জমিতে দৌড়াদৌড়ি করে ফুল ছিড়লে তো ক্ষতি হবেই।’

 

হাসিবুর রহমান মানুষের অসচেতনতা দেখে নিজেও লজ্জিত। বলেন, ‘এভাবে মানুষের দৌড়াদৌড়ি দেখে আমারও খারাপ লাগছে। নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য অন্যের ক্ষতি করা তো ঠিক না।’

চাষি মিয়া হোসেনের শ্যালক জাইদুল নাঈম জানান, মানুষ এত ক্ষতি করার পড়েও আন্তরিকতার সঙ্গে সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করছেন কৃষক মিয়া হোসেন।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য যে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে সে বিষয়ে তাদের কারো কোনো খেয়ালই নাই।

‘কারও পৌষ মাস, আর কারও সর্বনাশ’- হতাশ কণ্ঠে বলেন চাষির শ্যালক।

নিকলী উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সূর্যমুখী বারি-৩ প্রদর্শনীর জন্য কৃষক জালালউদ্দীনের মাধ্যমে এক একর জমিতে চাষ করা হয়েছিল।

ফুল ফোটার পর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় পর পর্যটকদের ভিড় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জমিতে প্রবেশ কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না।