হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওরাঞ্চলের অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ও পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে মজুরি বঞ্চনার শিকার হচ্ছে শত শত নারী শ্রমিক। কৃষি নির্ভর যে সভ্যতা মানুষ প্রথম প্রর্বতন করে তাতে প্রধান অবদান ছিল নারীর। কিন্তু এক সময়ের কৃষকের ভূমিকায় আমরা পুরুষদের অধিষ্ঠিত হতে দেখি। তাতে কৃষিকাজ থেকে নারীর পুরোপুরি বিচ্যুতি ঘটেনি। বর্তমান আর্তসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে নারী-পুরুষ শ্রম বিভাজনের পরিবর্তন আসছে। পুরুষ কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। এতে কৃষিকাজে নারীদের দায়িত্ব বেড়েছে।
রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, শীত ইত্যাদি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার শিকার হয়ে এসব নারী শ্রমিকেরা সারাদিন কাজ করে। কিন্তু পুরুষদের থেকে ভাল কাজ করেও তাদের দৈনিক মজুরি কখনো পুরুষদের অর্ধেক, কখনোবা অর্ধেকের সামান্য বেশি পেয়ে থাকেন।
সরকারি বা স্থানীয়ভাবে বঞ্চিত এসব নারী শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন বা মজুরি বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ গ্রহণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।
সূত্র জানায় কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সংযোগস্থল এক ফসলী বোরো উৎপাদনী এই বিস্তৃর্ণ হাওরাঞ্চল। হেমন্তের ৬ মাস কাজ থাকে। বর্ষার পানিতে একাকার হয়ে গেলে কাজের কোন সংস্থান থাকে না। এছাড়াও এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই শ্রমজীবী খেটে খাওয়া শ্রেণীর। স্বাধীনতার পর ভাত কাপড়ের সংস্থান হলেও এসব পরিবার দরিদ্রই রয়ে গেছে। হেমন্তের কাজ করে ওদের বর্ষার খাবার সংগ্রহ করতে হয়। বেশির ভাগ মজুরই বোরো উৎপাদনে রোপণ, বাচাই, নিরানী, সার দেওয়া, ধান কাটা, মাড়াই এবং কৃষকদের গোলায় গোলা কাজ করার কাজে মজুরি বিক্রি করেন।
অষ্টগ্রামের বড় হাওড়, শিয়াল ডাঙ্গা, চৌদন্ত বস্তি, ভাটিনগর, শরীফপুর, ভাতশালা, কাকুরিয়া, চন্ডীপুরের হাওর, বাজিতপুরের হুমায়ুনপুর, আছানপুর দিঘীরপাড়, কামেরবাওলীর হাওর, আজমিরীগঞ্জের পাহাড়পুর, বদলপুরের হাওর, লাখাই মাহমুদপুর, সন্তোষপুরের হাওর, বামৈ হাওর, নাসিরনগরের গোয়ালনগর, চাতলপাড়, নোয়াগাঁও ইত্যাদি এলাকার হাওরসমূহ ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
অসংখ্য নারী শ্রমিকরা ফসলি জমি, সড়ক নির্মাণে ও খামারে কাজ করছেন। বর্তমানে এই অঞ্চলের সরকারি উন্নয়নের কাজে যোগালী, নির্মাণ, মাটি ভরাট এবং কোন কোন ইউনিয়নে কাঁচা সড়ক সংস্কারে মহিলা কাজ করতে দেখা যায়। এক সময় বৃদ্ধ মহিলারই শুধু মজুরি বিক্রি করতেন। বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ট যুবতী, গৃহবধু, কিশোরীরাও মজুরি বিক্রি করছেন। এছাড়া বৃদ্ধারাও মনের আনন্দেই কাজ করছেন।
একাধিক নদী পাড় হয়ে ৫-৭ মাইল দূরে গিয়ে কোন সময় এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় গিয়ে তারা কাজ করছেন। মাঝে মধ্যে এরা পাশবিক লালশাসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয় এবং কাজ করেও মজুরি না পাওয়ার মত ঘটনার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবুও সন্তান ও পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে এরা কাজ করেই যাচ্ছেন।
অকাল বন্যা, ঝড়, শীলাবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি ঘটলে এদের কাজের পরিধি কমে যায়। অভাব-অনটন এদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। বেসরকারি এনজিও গুলোতেও কাজ করেও যেখানে পুরুষদের দৈনিক মজুরি চারশ টাকা যেখানে মহিলা মজুরদের মজুরি একশ বা দেড়শ টাকা দেয় বলে একাধিক নারী শ্রমিকেরা জানান। মজুরি বঞ্চনার শিকার হলেও তাদের প্রতিবাদ করার উপায় নেই বলেও জানান তারা।
মহিলা নেতৃত্ব বিকাশে এখানে কোন নারী সংগঠনও গড়ে উঠেনি। হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর কাজ হলেও নারীদের কাজ করার মত কোন কুটির শিল্প বা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। অষ্টগ্রামের দুইজন নারী জানান তারা কুটির শিল্প পরিচালনা করে উৎপাদন শুরু করার পর পুঁজির অভাবে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
অষ্টগ্রামের শেফালি দাস (৫০)কাস্তুলের জুলেখা (৩৫) সহ অসংখ্যা মহিলা মজুরের ভাষ্য সারাদিন কাজ করে পুরুষরা যেখানে ৪ থেকে ৫ শত টাকা মজুরী পায় সেখানে নারীরা ভাল কাজ করেও ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা মজুরী পেয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে ঢাকার হাওরাঞ্চলবাসীর সাধারণ সম্পাদক রোটারিয়ান কামরুল হাসান বাবু বলেন শ্রম আইন অনুযায়ী নারী কিংবা পুরুষ সমমান, সমঘন্টা কাজ করলে তার সম পরিমান মজুরি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এতে যদি কম দেওয়া হয় তাতে রাষ্ট্রীয় শ্রম আইন লঙ্গন এবং এটি আইন বর্হিভূত হবে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের আরোও কঠোর হওয়ার দরকার বলে মনে করেন তিনি।