পাহাড়ি বাজার ও নাপ্পি দোচোয়ানি

মানুষ কত কিছুই না দেখে- বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া, সাগর, পাহাড়, নদী।এই দেখতে দেখতেই প্রতিনিয়ত হয় শেখা। মনে জাগে অনুভূতি। দেখার সেই শিক্ষা ও অনুভূতি থেকে আমরা চর্চা করি শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান আরও কত কি! ভ্রমণের এ পর্বে আমার দেখার বিষয় একটু ভিন্ন। আমার হঠাৎ করে বাজার দেখতে ইচ্ছে হলো। না, কারওয়ানবাজার নয়, দূর পাহাড়ের গায়ে বসে যে বাজার; সেখানকার ক্রেতা বা বিক্রেতা অথবা পাহাড়ি পণ্য। এ জন্য বেছে নিলাম খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা বাজার।

দিঘীনালা বাজারে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য
ঢাকা থেকে একদিন আগেই উপস্থিত হলাম। থাকার ব্যবস্থা হলো উপজেলার ডাকবাংলোয়। বাংলোর কাঠামো বৃটিশ আমলের, টিনের চালার নিচে পাকা ভিত্তির উপর বাঁশের শক্ত বেড়া। লাগোয়া কয়েকটা আম গাছ শীতল ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে জায়গাটি। লোকজন তেমন থাকে না, ভেতরে কেমন পুরনো একটা গন্ধ! এক সময় এসব এলাকায় কোনো বাঙালি ছিল না। পরে পার্বত্য অন্যান্য জেলার মত এখানেও বেশ কিছু বাঙালি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়, যারা ‘সেটেলার’ বলে পরিচিত। এখন দিঘীনালা বাজার কেন্দ্র করে চারপাশে সেটেলারদের ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। ক্রমেই বাড়ছে তাদের সংখ্যা।

উপকরণ সবই বন্য
দূর হবে কোষ্টকাঠিন্য
এক ফাইল-ই যথেষ্ট
বিদায় করতে জ্বালা পোড়া কষ্ট।

বাঁশপ্রোল- পাহাড়ে পরিচিত সবজি
পর দিন ঘুম ভাঙল ওষুধ বিক্রেতার ক্যানভাসের শব্দে। ডাকবাংলোর সামনে দিয়ে পাকা রাস্তা। বাজারের এক অংশ চলে এসেছে রাস্তায়। ওষুধ বিক্রেতা বসেছে ডাকবাংলোর সদর দরজা বরাবর। ভোর থেকে শুরু করে বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাজার শেষ হয়ে যায়। ভাগ্যিস ক্যানভাসারের কথায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, নইলে বাজারটাই দেখতে পেতাম না। পাহাড়িরা পাহাড়, জঙ্গলের অনেক কিছুই খায়, যা আমাদের নিকট অখাদ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ওগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তাদের সঞ্জিবনী  শক্তি। ফলে খুব সহজে তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয় না। বেশিভাগ দোকানিই নারী। আগের দিন পাহাড়, জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা জিনিস নিয়ে তরা বিক্রির জন্য এসেছে। ছোট ছোট এক ধরনের হলুদ ফুল- নাম অগয্যা। মাছের সঙ্গে এই ফুল নাকি এক অনন্য ব্যাঞ্জনা। রাস্তার দুই পাশে চাকমা মেয়েরা বিছিয়ে বসেছে অনেক দোকান। দোকানগুলোয় নানা ধরনের লতাপাতা, জুমের সবজি, সুগন্ধী গাছ সাবরাং, বিন্নি চাল, বাঁশপ্রোল, তারা ডাটা, তিতবেগুন, বয়লা শাক, ইয়েরিং শাক, কয়দা, কচি কাঁঠাল এবং কলার মোচা প্রধান পণ্য।

বাজারে বিভিন্ন শুঁটকি ও মহিষের চামড়া বিক্রি হচ্ছে
এই সকালবেলা দিঘীনালা বাজারে যেন উৎসবের আমেজ। মূল বাজারে ঢুকেই প্রথমে দৃষ্টি কাড়ল চাকমা নারীদের  আড্ডার আসর। কারও হাতে ধাবা (বাঁশের তৈরি ধূমপানের লম্বা সরঞ্জাম), কারও আঙুলের চিপায় আস্ত তামাক পাতা মোড়ানো বিড়ি। বাজারে আসার জন্য খুব ভোরে তারা রওনা হয়। এ জন্য আগের কয়েকদিন থেকেই চলে প্রস্তুতি। কারণ বিক্রির জন্য জিনিসগুলো সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া এ তো সপ্তাহান্তের মিলনমেলা। টিনের পাত্রে শক্ত কাদার মত জিনিসটা নিশ্চয় কোনো খাবার বস্তু! দেখে কৌতূহল হলো। নাম জিজ্ঞেস করতেই দোকানি বলল, নাপ্পি। নানান জাতের শুঁটকি মাছ গুঁড়া করে বানানো। পাহাড়িদের ঘরে অনেক সময় বিশেষ ধরনের গন্ধ এসে নাকে লাগে- ওটা এই নাপ্পির গন্ধ। রান্নার প্রতি পদে পাহাড়িরা নাপ্পি দিতে ভালোবাসে। এই জিনিস ছাড়া তারা কোনো খাবার যেন কল্পনাই করতে পারে না।

দুই বৃদ্ধা বাঁশের বড় ঝাকায় সাদা ডালের বড়ার মত কি যেন নিয়ে বসেছে! চাউল দিয়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বানানো। জানা গেল এই বস্তু থেকেই নাকি পাহাড়িদের নিত্যদিনের পানীয় দোচোয়ানি প্রস্তুত হয়ে থাকে। একটু দূরেই দোকানির সামনে ভিড় লক্ষ্য করে  এগিয়ে গেলাম। দেখি চামড়া টুকরো করে কেটে  স্তুপ করে রাখা হয়েছে। দোকানি বাংলা বোঝে না। ফলে জিনিসটি কী জানা হলো না। ঠিক এমন সময় একজন বাঙালি এগিয়ে এসে নাক-মুখ কুঁচকে বলল, মহিষের চামড়া, ওরা রেধে খায়। কথায় আছে, ‘এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি, এক দেশের খাদ্য আরেক দেশে অখাদ্য’। এই বাজারে এ কথার সত্যতা খুঁজে পেলাম।

খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে দোচোয়ানির উপকরণ
বাজারে পাহাড়ি কমলা লেবু মাত্র দশ টাকা হালি। স্বাদে সামান্য টক হলেও একেবারে টাটকা এবং খেতে মন্দ নয়। বাজারে ঘুরছি ছবি তুলব না তাই কী হয়! কিন্তু ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে মানুষের ভিড় জমে যায়। সবাই ছবি তুলতে চায়। অনেকে তো শূকরের বাচ্চা কোলে নিয়ে প্রস্তুত- দাদা, একতা ছবি তুলবেন যে!

এরই মধ্যে পেটে চো চো শুরু হয়ে গেছে। বিন্নি চালের পিঠা এবং রং চা দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। নাস্তার সময় আলাপ হলো চাকমা যুবক মংয়ের সঙ্গে। সে ঘুরে ঘুরে চিনিয়ে দিল আরও কিছু শাকসবজি, ফলের সাথে। হলুদের ফুলের তরকারি বা আদা ফুলের সালাদ অথবা ভর্তার পদ হলে বাড়িতে সেদিন ভাত বেশি রাধতে হয়, কারণ দুটোই পাহাড়িদের প্রিয় খাবার। শাম্বো কচু, কনর সম্বার, শিমে আলু, কাকড়া গুলা, চিনল, গোমাইত্ত্যা সহ বহু সবজি দেখলাম।

বাজারের এক কোণায় কাকড়া, শামুক, ব্যাঙ ও শূকরের মাংসের দোকান। সমতল থেকে আমদানী করা ব্যাঙের ইদানিং নাকি বেশ চাহিদা। পার্বত্য এলাকায় মাছ খুব একটা সহজলভ্য নয়। আমিষের প্রধান উৎস শূকরের মাংস। যদিও এটি সকলের নাগালের মধ্যে নয়, পক্ষান্তরে ব্যাঙের মাংসের দাম অর্ধেকেরও কম। ফলে আমিষের চাহিদা পূরণে দিনকে দিন ব্যাঙের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। যাই হোক, বাজারের সময় প্রায় শেষের দিকে। লোকজন ফিরে যেতে শুরু করেছে। আমরাও বাংলোয় ফিরে এলাম শুধুমাত্র গোসল করার জন্য। বাজারের এক চাকমা রেস্তেরাঁয় দুপুরের খাবার অর্ডার করা আছে- জুম চালের ভাতের সাথে নাপ্পি দিয়ে বাঁশপ্রোলের তরকারি, হলুদ ফুলের তরকারি ও আদা ফুলের সালাদ।

প্রয়োজনীয় তথ্য :  রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে শান্তি পরিবহণ সরাসরি দিঘীনালা  যায়, ভাড়া ৬৫০-৭০০ টাকা। এ ছাড়াও হানিফ, শ্যামলী, সৌদিয়াসহ অন্যান্য বাসে খাগড়াছড়ি যাওয়া যাবে। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি অথবা স্থানীয় বাসে দিঘীনালা যেতে হবে। থাকার জন্য বাজারে কয়েকটা হোটেল রয়েছে, জনপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা। চাইলে খাগড়াছড়ি ফিরে পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেলসহ শহরের যে কোনো হোটেলে রাতে থাকা যাবে। সেক্ষেত্রে বুকিং আগেই দিয়ে রাখতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর