ঢাকা ০৫:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুইডেনে সন্তানের প্রতি এক মায়ের ভালোবাসার গল্প

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:০৬:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ নভেম্বর ২০২০
  • ২১২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের সমাজে যে জিনিসগুলো বেমানান ছিল জানি না আজ সেগুলো কীভাবে দেখা হয়। তবে আশি বছর আগে সুইডেনের সমাজে যে জিনিসগুলো অগ্রহণযোগ্য ছিল আজ সেটাই গ্রহণযোগ্য। কেন যেন বহু বছর পর আজ মনে পড়ছে একটি বাস্তব ঘটনা যেটা শুনেছিলাম ১৯৮৫ সালে।

লার্স আমার এক সুইডিশ বড় ভাই। তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডরমিটরিতে থাকি। সবাই লার্সকে লাছে বলে ডাকে। তার বয়স তখন ৪৬ বছর। পিএইচডি শেষ করেছে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের ওপর। আমার থেকে ২৫ বছরের সিনিয়র। ডরমিটরির রান্নাঘর, টিভিরুম সবাই মিলে ব্যবহার করি। আমার সঙ্গে তার প্রায়ই নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়।

সুইডিশ ভাষা সহজে এবং তাড়াতাড়ি শেখার পেছনে যারা আমাকে বেশি সাহায্য করেছে, লাছে তাদের মধ্যে একজন। তাকে রান্না করতে দেখেছি তবে লন্ড্রি করতে কখনও দেখিনি। প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর তার মা এসে লন্ড্রি করতে সাহায্য করতো। কয়েক মাস যেতেই লাছের মা আস্ট্রিডের সঙ্গেও আমার একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছুটিতে লাছের বাড়িতে মাঝে মধ্যে গিয়েছি তবে কখনও লাছের বাবাকে দেখিনি।

একদিন জিজ্ঞেস করলাম আস্ট্রিডকে লাছের বাবা সম্পর্কে। আমার সঙ্গে আস্ট্রিড সেদিন জীবনের অনেক কথা শেয়ার করেছিল। মূলত আমি এক কৃষি পরিবারের সন্তান। ষোল বছর বয়সে সুইডেনের একটি ছোট্ট শহর ভিমারবির একটি সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদকের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করি। সম্পাদকের বয়স চল্লিশ বছর, বিবাহিত, নাম আন্দেস।

বিবাহিত জীবনে আন্দেস সুখি নয়; তাই তাদের ডিভোর্স প্রক্রিয়া চলছে তখন। আন্দেস প্রায়ই অফিসে বেশি সময় কাটায় এবং আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কাজ শেষে আমাকে বাইরে ডিনারে নিয়ে যায়। বাড়িতে দেরি করে আসাটা আমার মা-বাবা পছন্দ করেন না তখন।

গ্রামের পরিবেশে সব ঘটনাই সবার নজরে পড়তে থাকে এবং আমাদেরকে নিয়ে নানাভাবে গুজব ছড়াতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে আন্দেসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকে। কিছুদিন যেতেই আমি প্রেগন্যান্ট হই। বিষয়টি আমার বাবা-মা জেনে যায়। আন্দেস তার ডিভোর্সের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে চেষ্টা করলেও নানা কারণে সেটা বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।

বাবা-মা তাদের মানসম্মান এবং সামাজিক নিন্দার হাত থেকে রেহাই পেতে সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে স্টকহোমে একটি মহিলা আবাসিক স্কুলে সেক্রেটারি কোর্সে ভর্তি করতে। আন্দেস আমার সমস্ত খরচ বহন করতে থাকে।

সময়টি হবে ১৯৪৬ সালের দিকে। সুইডেন তখন আজকের মতো এত উন্নত ছিল না। জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত এসব তখন ভাবা যেতো না। আমার বাড়ি ছেড়ে স্টকহোমে থাকা এবং বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত সময়টি ছিল শুধু লজ্জার, আর আমার প্রতি ছিল বাবা-মা এবং সমাজের এক চরম ঘৃণা।

শেষে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের একটি ক্লিনিকে লার্সের জন্ম হয়। লার্স পালিত মায়ের কাছে বড় হতে থাকে কোপেনহেগেনে। আর আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে দেখা করে আসি তার সঙ্গে। এ ভাবেই চলতে থাকে আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক।

এদিকে আমি অন্য আরেকটি জুডিশিয়াল কোম্পানিতে সেক্রেটারি হিসেবে কাজ পেয়ে যাই। সিদ্ধান্ত নেই লার্সকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আন্দেসের সঙ্গে কথা বলি কিন্তু সে হঠাৎ মত পরিবর্তন করে। বাবা-মাকে বলি তারাও সম্পূর্ণ নারাজ লার্সকে কোপেনহেগেন থেকে আনতে। তাদের প্রেসটিজ এবং সমাজে কীভাবে মুখ দেখাবে এটা বড় হয়ে দাঁড়ায়।

বিবাহিত এক পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করে অবৈধ সন্তান। সে সন্তানকে কীভাবে সমাজের কাছে তুলে ধরবো? শেষে বাড়ি ছেড়ে, নতুন কাজ ছেড়ে আবারও স্টকহোমে ফিরে আসি। ‍আমি যেহেতু সেক্রেটারির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং অতীতে দুই জায়গায় কাজ করেছি, তাই স্টকহোমে নতুন কাজ পেতে সমস্যা হয়নি।

পরে সেখানে ছোট একটি বাসা ভাড়া করি আমার এবং লার্সের জন্য। ইতিমধ্যেই লার্সের বয়স দুই বছর পার হয়ে গেছে। সে তার পালিত মাকে মা মনে করে আসছে। যদিও পালিত মা লার্সকে শিখিয়েছে আমাকে যেন লাছেমামা বলে ডাকে। ভাগ্যের পরিহাস, লার্সের নিজের মা আমি অথচ হয়েছি লাছেমামা!

লার্সকে আনতে যখন কোপেনহেগেনে এসেছি তখন শুধু দেখি লার্স তার মনপ্রাণ সব কিছুই পালিত মাকে দিয়েছে। দিবেই বা না কেন? আমি তাকে জন্মের পরই ছেড়ে চলে এসেছি। বুকের দুধটুকুও তাকে দিতে পারিনি। বুকের দুধ দিলে শরীরে দুধ আসতে শুরু করবে বিধায় লার্সের জন্মের পরপরই আমাকে তার কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

শর্ত ছিল, ক্লিনিকের সাথে সন্তান প্রসব হলেই তাকে বিনা শর্তে অন্য পরিবারের কাছে লালন পালন করার দায়ভার ক্লিনিকের। ক্লিনিক সময় সুযোগ মতো লার্সকে পালিতপুত্র হিসেবে অন্য কোনোখানে দিয়ে দিবে। আন্দেস প্রমিজ করে আমাকে মাতৃত্বের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সব রকম সাহায্য করবে।

প্রতিদিন লার্সের সঙ্গে দেখা না হলেও একটি এককেন্দ্রিক ভালোবাসা গড়ে ওঠে আমার তরফ থেকে। কিন্তু লার্সকে আনতে গিয়ে দেখলাম সে তার পালিত মাকেই বেছে নিয়েছে নিজের মা হিসেবে। লার্সের ভালোবাসা তার পালিত মাকে ঘিরে তাই নিজেকে ব্যর্থ ভেবে ফিরে এলাম স্টকহোমে।

খুব ভেঙ্গে পড়ি, কী হতে কী হয়ে গেল! জীবনের প্রথম ভালোবাসা, বাবা-মা, সমাজ সব কিছু ফেলে হয়ে গেলাম এত অল্প বয়সে একা। ফেলে আসা দিনগুলোকে ভুলে যেতে কী-ই না করেছি, তারপরও সম্ভব হয়নি সবকিছু ভুলে যেতে।

তিন মাস কেটে গেছে। কোনো যোগাযোগ নেই কারও সাথে। লার্সের কথা মনে পড়ে কিন্তু তার জীবনকে নষ্ট হতে দিতে পারি না ভেবে দূরে আছি। পার্কে যখন লার্সের বয়সী কাউকে দেখি মন ভরে চেয়ে থাকি আর কল্পনা করি লার্সকে নিয়ে।

একদিন হঠাৎ একটি চিঠি এসেছে ডেনমার্ক থেকে। কী ব্যাপার? খুলে দেখি লার্সের পালিত মা তাকে এক এতিমখানায় রেখে হাসপাতালে মৃত্যুর দিন গুনছে। আমি আন্দেসসহ বাবা-মাকে আবারও অনুরোধ করি কিন্তু কেউ আমার সেই দুর্দিনে সাড়া দেয়নি। শেষে মনের ওপর বিশ্বাস রেখে লার্সকে ডেনমার্ক থেকে নিয়ে আসি এবং স্টকহোমে বসবাস করতে শুরু করি।

সেই থেকে তাকে ঘিরে আমার জীবন। তাকে তার ইচ্ছানুযায়ী লেখাপড়া শিখতে যা প্রয়োজন তাই করেছি। লার্স লেখাপড়ায় এত ভালো ছিল যে আমার তার জন্য কোনো এক্সট্রা খরচ কখনও করতে হয়নি। সে ফিজিসিস্ট হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করেছে এবং পিএইচডি শেষ করেই লিনসোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছে।

লার্সের মা আস্ট্রিডের গল্প শুনতে শুনতে সেদিন বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল। লার্স সেসময় সোফাতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাকে ঘুম থেকে তুলে দুজনে ফিরে এলাম আমাদের ডরমিটরিতে। সেই ১৯৯০ সালে আমি লিনসোপিং ছেড়ে স্টকহোমে বসবাস করছি।

জানুয়ারি ২০২০ সালে লার্সের মা মারা যান, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। লার্স মস্তবড় প্রফেসর হয়ে শেষে অবসরে গিয়েছে। গতকাল সে হঠাৎ ফোন করেছে। আমার একটি আর্টিকেল জাতিসংঘের ৭৫ বছর পূর্তিতে সুইডেনের পত্রিকা ডগেন্স নিহেতারে পাবলিশ হয়েছে। লিখাটি লার্সের নজরে পড়েছে এবং পড়া শেষ করে ফোন দিয়েছে। তার সঙ্গে কথা শেষে স্মৃতির জানালা খুলে দেখছি, এই তো সেদিনের কথা, লার্সের মা আস্ট্রিডের সঙ্গে কত কথাই না হয়েছিল সেদিন।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

সুইডেনে সন্তানের প্রতি এক মায়ের ভালোবাসার গল্প

আপডেট টাইম : ০৭:০৬:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ নভেম্বর ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের সমাজে যে জিনিসগুলো বেমানান ছিল জানি না আজ সেগুলো কীভাবে দেখা হয়। তবে আশি বছর আগে সুইডেনের সমাজে যে জিনিসগুলো অগ্রহণযোগ্য ছিল আজ সেটাই গ্রহণযোগ্য। কেন যেন বহু বছর পর আজ মনে পড়ছে একটি বাস্তব ঘটনা যেটা শুনেছিলাম ১৯৮৫ সালে।

লার্স আমার এক সুইডিশ বড় ভাই। তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডরমিটরিতে থাকি। সবাই লার্সকে লাছে বলে ডাকে। তার বয়স তখন ৪৬ বছর। পিএইচডি শেষ করেছে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের ওপর। আমার থেকে ২৫ বছরের সিনিয়র। ডরমিটরির রান্নাঘর, টিভিরুম সবাই মিলে ব্যবহার করি। আমার সঙ্গে তার প্রায়ই নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়।

সুইডিশ ভাষা সহজে এবং তাড়াতাড়ি শেখার পেছনে যারা আমাকে বেশি সাহায্য করেছে, লাছে তাদের মধ্যে একজন। তাকে রান্না করতে দেখেছি তবে লন্ড্রি করতে কখনও দেখিনি। প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর তার মা এসে লন্ড্রি করতে সাহায্য করতো। কয়েক মাস যেতেই লাছের মা আস্ট্রিডের সঙ্গেও আমার একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছুটিতে লাছের বাড়িতে মাঝে মধ্যে গিয়েছি তবে কখনও লাছের বাবাকে দেখিনি।

একদিন জিজ্ঞেস করলাম আস্ট্রিডকে লাছের বাবা সম্পর্কে। আমার সঙ্গে আস্ট্রিড সেদিন জীবনের অনেক কথা শেয়ার করেছিল। মূলত আমি এক কৃষি পরিবারের সন্তান। ষোল বছর বয়সে সুইডেনের একটি ছোট্ট শহর ভিমারবির একটি সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদকের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করি। সম্পাদকের বয়স চল্লিশ বছর, বিবাহিত, নাম আন্দেস।

বিবাহিত জীবনে আন্দেস সুখি নয়; তাই তাদের ডিভোর্স প্রক্রিয়া চলছে তখন। আন্দেস প্রায়ই অফিসে বেশি সময় কাটায় এবং আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কাজ শেষে আমাকে বাইরে ডিনারে নিয়ে যায়। বাড়িতে দেরি করে আসাটা আমার মা-বাবা পছন্দ করেন না তখন।

গ্রামের পরিবেশে সব ঘটনাই সবার নজরে পড়তে থাকে এবং আমাদেরকে নিয়ে নানাভাবে গুজব ছড়াতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে আন্দেসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকে। কিছুদিন যেতেই আমি প্রেগন্যান্ট হই। বিষয়টি আমার বাবা-মা জেনে যায়। আন্দেস তার ডিভোর্সের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে চেষ্টা করলেও নানা কারণে সেটা বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।

বাবা-মা তাদের মানসম্মান এবং সামাজিক নিন্দার হাত থেকে রেহাই পেতে সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে স্টকহোমে একটি মহিলা আবাসিক স্কুলে সেক্রেটারি কোর্সে ভর্তি করতে। আন্দেস আমার সমস্ত খরচ বহন করতে থাকে।

সময়টি হবে ১৯৪৬ সালের দিকে। সুইডেন তখন আজকের মতো এত উন্নত ছিল না। জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত এসব তখন ভাবা যেতো না। আমার বাড়ি ছেড়ে স্টকহোমে থাকা এবং বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত সময়টি ছিল শুধু লজ্জার, আর আমার প্রতি ছিল বাবা-মা এবং সমাজের এক চরম ঘৃণা।

শেষে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের একটি ক্লিনিকে লার্সের জন্ম হয়। লার্স পালিত মায়ের কাছে বড় হতে থাকে কোপেনহেগেনে। আর আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে দেখা করে আসি তার সঙ্গে। এ ভাবেই চলতে থাকে আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক।

এদিকে আমি অন্য আরেকটি জুডিশিয়াল কোম্পানিতে সেক্রেটারি হিসেবে কাজ পেয়ে যাই। সিদ্ধান্ত নেই লার্সকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আন্দেসের সঙ্গে কথা বলি কিন্তু সে হঠাৎ মত পরিবর্তন করে। বাবা-মাকে বলি তারাও সম্পূর্ণ নারাজ লার্সকে কোপেনহেগেন থেকে আনতে। তাদের প্রেসটিজ এবং সমাজে কীভাবে মুখ দেখাবে এটা বড় হয়ে দাঁড়ায়।

বিবাহিত এক পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করে অবৈধ সন্তান। সে সন্তানকে কীভাবে সমাজের কাছে তুলে ধরবো? শেষে বাড়ি ছেড়ে, নতুন কাজ ছেড়ে আবারও স্টকহোমে ফিরে আসি। ‍আমি যেহেতু সেক্রেটারির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং অতীতে দুই জায়গায় কাজ করেছি, তাই স্টকহোমে নতুন কাজ পেতে সমস্যা হয়নি।

পরে সেখানে ছোট একটি বাসা ভাড়া করি আমার এবং লার্সের জন্য। ইতিমধ্যেই লার্সের বয়স দুই বছর পার হয়ে গেছে। সে তার পালিত মাকে মা মনে করে আসছে। যদিও পালিত মা লার্সকে শিখিয়েছে আমাকে যেন লাছেমামা বলে ডাকে। ভাগ্যের পরিহাস, লার্সের নিজের মা আমি অথচ হয়েছি লাছেমামা!

লার্সকে আনতে যখন কোপেনহেগেনে এসেছি তখন শুধু দেখি লার্স তার মনপ্রাণ সব কিছুই পালিত মাকে দিয়েছে। দিবেই বা না কেন? আমি তাকে জন্মের পরই ছেড়ে চলে এসেছি। বুকের দুধটুকুও তাকে দিতে পারিনি। বুকের দুধ দিলে শরীরে দুধ আসতে শুরু করবে বিধায় লার্সের জন্মের পরপরই আমাকে তার কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

শর্ত ছিল, ক্লিনিকের সাথে সন্তান প্রসব হলেই তাকে বিনা শর্তে অন্য পরিবারের কাছে লালন পালন করার দায়ভার ক্লিনিকের। ক্লিনিক সময় সুযোগ মতো লার্সকে পালিতপুত্র হিসেবে অন্য কোনোখানে দিয়ে দিবে। আন্দেস প্রমিজ করে আমাকে মাতৃত্বের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সব রকম সাহায্য করবে।

প্রতিদিন লার্সের সঙ্গে দেখা না হলেও একটি এককেন্দ্রিক ভালোবাসা গড়ে ওঠে আমার তরফ থেকে। কিন্তু লার্সকে আনতে গিয়ে দেখলাম সে তার পালিত মাকেই বেছে নিয়েছে নিজের মা হিসেবে। লার্সের ভালোবাসা তার পালিত মাকে ঘিরে তাই নিজেকে ব্যর্থ ভেবে ফিরে এলাম স্টকহোমে।

খুব ভেঙ্গে পড়ি, কী হতে কী হয়ে গেল! জীবনের প্রথম ভালোবাসা, বাবা-মা, সমাজ সব কিছু ফেলে হয়ে গেলাম এত অল্প বয়সে একা। ফেলে আসা দিনগুলোকে ভুলে যেতে কী-ই না করেছি, তারপরও সম্ভব হয়নি সবকিছু ভুলে যেতে।

তিন মাস কেটে গেছে। কোনো যোগাযোগ নেই কারও সাথে। লার্সের কথা মনে পড়ে কিন্তু তার জীবনকে নষ্ট হতে দিতে পারি না ভেবে দূরে আছি। পার্কে যখন লার্সের বয়সী কাউকে দেখি মন ভরে চেয়ে থাকি আর কল্পনা করি লার্সকে নিয়ে।

একদিন হঠাৎ একটি চিঠি এসেছে ডেনমার্ক থেকে। কী ব্যাপার? খুলে দেখি লার্সের পালিত মা তাকে এক এতিমখানায় রেখে হাসপাতালে মৃত্যুর দিন গুনছে। আমি আন্দেসসহ বাবা-মাকে আবারও অনুরোধ করি কিন্তু কেউ আমার সেই দুর্দিনে সাড়া দেয়নি। শেষে মনের ওপর বিশ্বাস রেখে লার্সকে ডেনমার্ক থেকে নিয়ে আসি এবং স্টকহোমে বসবাস করতে শুরু করি।

সেই থেকে তাকে ঘিরে আমার জীবন। তাকে তার ইচ্ছানুযায়ী লেখাপড়া শিখতে যা প্রয়োজন তাই করেছি। লার্স লেখাপড়ায় এত ভালো ছিল যে আমার তার জন্য কোনো এক্সট্রা খরচ কখনও করতে হয়নি। সে ফিজিসিস্ট হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করেছে এবং পিএইচডি শেষ করেই লিনসোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছে।

লার্সের মা আস্ট্রিডের গল্প শুনতে শুনতে সেদিন বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল। লার্স সেসময় সোফাতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাকে ঘুম থেকে তুলে দুজনে ফিরে এলাম আমাদের ডরমিটরিতে। সেই ১৯৯০ সালে আমি লিনসোপিং ছেড়ে স্টকহোমে বসবাস করছি।

জানুয়ারি ২০২০ সালে লার্সের মা মারা যান, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। লার্স মস্তবড় প্রফেসর হয়ে শেষে অবসরে গিয়েছে। গতকাল সে হঠাৎ ফোন করেছে। আমার একটি আর্টিকেল জাতিসংঘের ৭৫ বছর পূর্তিতে সুইডেনের পত্রিকা ডগেন্স নিহেতারে পাবলিশ হয়েছে। লিখাটি লার্সের নজরে পড়েছে এবং পড়া শেষ করে ফোন দিয়েছে। তার সঙ্গে কথা শেষে স্মৃতির জানালা খুলে দেখছি, এই তো সেদিনের কথা, লার্সের মা আস্ট্রিডের সঙ্গে কত কথাই না হয়েছিল সেদিন।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।