দুই সন্তানকে ছুরিকাঘাত বাবার আত্মহত্যার চেষ্টা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টা। হাজারীবাগের বটতলার বোরহানপুরের ১০ নম্বর গলির ৬৭/২ নম্বর বাড়ি। দেড়কাঠা জমির উপর নির্মিত টিনশেড দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন ব্যবসায়ী জাবেদ আহমেদ। চারপাশের পরিবেশ থমথমে। প্রতিবেশীদের অপেক্ষা কখন শিশু রোজার মৃতদেহ আসবে। শেষবারের মতো একনজর দেখতে সবাই ভিড় জমিয়েছে বাসার সামনে। ছয় বছর বয়সী শিশু জারিন হাসান রোজা ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র মেয়ে। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো রোজা।

 চাচাদের আদরের কন্যা। রাস্তা সংলগ্ন বাড়ি হওয়াতে রোজা বেশিরভাগ সময় বাবার দোকানের সামনে এবং গেটে থাকতো। ছিল অসম্ভব চঞ্চল এবং মেধাবী। পরিবারের ইচ্ছা ছিল স্কুল খুললে স্থানীয় আইডিয়াল মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিবেন। এর আগেই বাবার হতাশার বলি হলেন রোজা। এখন শিশু রোজা কেবলই স্মৃতি।
ব্যবসায়ী জাবেদ হাসান সম্প্রতি একজন ডিভোর্সী নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান। পরবর্তীতে এলাকায় ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে দুই পরিবারের সদস্য এবং এলাকার মুরব্বিরা বিষয়টি মীমাংসা করেন। জাবেদের এক প্রতিবেশী জানান, লকডাউনের পরে এলাকায় ভাড়াটিয়া এক নারীর সঙ্গে তার পরকীয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়। ত্রিশোর্ধ্ব ওই নারী এক সন্তানের জননী। তাদের প্রেমের বিষয়টি কম-বেশি অনেকেই জানতেন। এক সময় বিষয়টা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছালে দু’পক্ষ থেকে সালিশ ডাকা হয়। পরবর্তীতে ওই নারী এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে চলে যান। সম্প্রতি তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে। জাবেদ অনেকটা শান্ত স্বভাবের। সে কীভাবে পাষণ্ডের মতো নিজের সন্তানকে খুন করলেন ভেবে কুল পাচ্ছেন না প্রতিবেশীরা।
তাদের ভাষ্য মতে, জাবেদের বাসার নিচতলায় ফ্লেক্সি লোড, থ্রিপিস, মেয়েদের কসমেটিকসসহ একাধিক ব্যবসা রয়েছে। করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ থাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক টাকার মতো ঋণ হয় জাবেদের। এটা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত এবং বিষণ্ন ছিলেন। দোকানের কর্মচারীদের কাজ থেকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু পাওনাদাররা চাপ দিতে থাকেন টাকার জন্য। প্রতিবেশীদের ধারণা, ঋণের টাকার দুশ্চিন্তা থেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পুরো পরিবারকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া পরকীয়ার বিষয়টি তো ছিলই।
জাবেদের ভাই মেহেদী হাসান বলেন, জাবেদ দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমাতে আসেন। এ সময় শিশু রোজাকেও ঘুম পাড়িয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে জাবেদ বৃষ্টিতে ভিজলে কেন বলেই ছেলেকে মারতে শুরু করেন। দৌড়ে বাসার নিচে গিয়ে কাগজ কাটার একটি ধারালো ছুরি এনে প্রথমে ছেলের গলায় ছুরিকাঘাত করে এবং হাতের শিরা কেটে দেন। এ সময় স্ত্রী রিমা বেগম রোজাকে বলেন, তুমি নিচ থেকে দাদুকে ডেকে আনো। রোজা নিচে যেতে চাইলে জাবেদ দরজা বন্ধ করে রোজার গলায় ছুরিকাঘাত করেন। রিমা বেগম এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরলে তার গলায় ছুরিকাঘাত করেন। এ সময় রিমা জাবেদকে জড়িয়ে ধরায় সে পড়ে যায়। এবং নিজে নিজে বিড়বিড় করে একপর্যায়ে নিজের গলায় ছুরি চালান।
জাবেদের ভাই মেহেদী হাসান আরো বলেন, আমরা তিন ভাই। ভাই সবার বড়। গত ১৩ বছর ধরে সে পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা থাকেন। আমি এখনো বিয়ে করিনি। ছোট ভাই জাহিদ হাসান বিয়ে করলেও তাদের কোনো সন্তান নেই। রোজাই ছিল আমাদের পরিবারের অতি প্রিয় সন্তান। এলাকার কম-বেশি সকলেই তাকে চিনতো। পরকীয়ার বিষয়টি আমরা পারিবারিকভাবেই মীমাংসা করেছি। কিন্তু ঋণের কারণে ভাই এ ধরনের ঘৃণিত ঘটনা ঘটাবে আমরা চিন্তাই করতে পারছি না। তার ঋণের বিষয়ে আমরা জানতাম। তাকে আমরা আশ্বস্ত করেছি এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সবাই মিলে তার ঋণ শোধ করার ব্যবস্থা করবো। আমি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। করোনায় আমার কাজ চলে যায়। কিন্তু তারপরও হতাশ হইনি। একটি সাজানো গোছানো ছোট্ট সংসার ভাই নিজ হাতে শেষ করে দিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (এসআই) জাহানে আলম বলেন, এ বিষয়ে নিহত শিশু রোজার মা বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি জাবেদের স্ত্রী রিমা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন তাকেও হত্যাচেষ্টা চালায় স্বামী জাবেদ। অল্পের জন্য সে প্রাণে বেঁচে যায়। তার গলায় সামান্য কাটা দাগ রয়েছে। জাবেদ এবং তার ছেলে রিজন এখন কিছুটা আশঙ্কামুক্ত। গলাকাটা থাকায় কথা বলতে পারছেন না। জাবেদের সঙ্গে ইতিমধ্যে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় সামান্য কথা হয়েছে। একটু সুস্থ হলেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যার আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। তার পরকীয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি। এটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর