মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে ফেরি অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে স্পিডবোট-ট্রলার পদ্মা পারাপারে ভোগান্তি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধের সুযোগ নিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্পিডবোট ও ট্রলার চালকদের বিরুদ্ধে। পদ্মা পারাপারে ফেরি-লঞ্চের পাশাপাশি এ নৌরুটে চলাচল করে চার শতাধিক স্পিডবোট।

তবে এগুলোর কোনো নিবন্ধন নেই, সবই চলছে অবৈধভাবে। আর কারও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে নীরব থাকার অভিযোগ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বিরুদ্ধে।

নিবন্ধনবিহীন, অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন এসব স্পিডবোটে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের ফলে ঘটেছে অনেক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় স্বজনরা হারিয়েছেন প্রিয়জনকে, আবার অনেকে রয়েছেন নিখোঁজের তালিকায়।

সরেজমিনে জানা যায়, স্পিডবোট ঘাট নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই ও ঘাটের দায়িত্বের ব্যাপারে সবাই দায় এড়িয়ে যেতে চায়। গেল কয়েক বছর আগে চালু হওয়া নিবন্ধন প্রক্রিয়া স্থগিতের ব্যাপারে স্পিডবোট ঘাট ও ডিজি শিপিং অসহযোগিতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অভিযোগ করে যাত্রীরা জানান, স্পিডবোটগুলোতে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট থাকে না। মাঝ পদ্মায় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিদিনকার ঘটনা। স্পিডবোট উল্টে গিয়ে অনেকেই হারিয়েছেন স্বজনদের। অনেকে মরদেহই পাননি। উপযুক্ত বয়স ও অদক্ষ চালকের মাধ্যমে চলে এসব দ্রুতযান। ফিটনেস পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। যাত্রী চাপ থাকলে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। রাতের অন্ধকারে অনেক সময় এসব স্পিডবোট চলাচল করছে। এজন্য ঘটছে দুর্ঘটনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডাব্লিউটিএ- এর পরিবহন পরিদর্শক সোলেমান বলেন, স্পিডবোট নিবন্ধনের ব্যাপারে মন্ত্রী ও সচিবদের জানানো হয়েছে। এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে।

এক. শিমুলিয়া ও কাঁঠালবাড়ী ঘাটের স্পিডবোটগুলো ডিজি শিপিংয়ের নিবন্ধন করার কথা ছিল। নিবন্ধনের জন্য চালকরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে না, এটাই স্বাভাবিক। এখন আমরা চাইছি, বিআইডাব্লিউটিএ থেকে নিবন্ধন করার জন্য। ডিজি শিপিং না করলেও বিআইডাব্লিউটিএ’র মাধ্যমে প্রক্রিয়া শুরু হবে।

দুই. বর্তমানে শিমুলিয়া ও কাঁঠালবাড়ী ঘাটে যেসব স্পিডবোট রয়েছে তার নিবন্ধনের কোনো কাগজপত্র ডিজি শিপিং ও বিআইডাব্লিউটিএ’র কাছে নেই।

তিনি আরও বলেন, বিআইডাব্লিউটিএ একটি বড় প্রতিষ্ঠান, কিন্তু বর্তমানে এখানে নজরদারি করার জন্য কেউ নেই। আগে দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট থাকলেও এখন ফাঁকাই বলা চলে। যিনি রয়েছেন তিনি ঢাকা অফিসে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ঈদের সময় কিংবা যখন ঘাটে চাপ পড়ে তখন মোবাইল কোর্টের সহায়তা নেওয়া হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভিযান পরিচালনার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে অনুরোধও করা হয়।

তিনি আরও বলেন, শিমুলিয়া ঘাটের স্পিডবোটের নিবন্ধন নেই। অনেক আগে এসব নিবন্ধনের চেষ্টা করা হয়েছিল। সেসময় ডিজি শিপিং থেকে একজন ইন্সপেক্টর এসব স্পিডবোট নিবন্ধন করার জন্য ঘাট এলাকায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু তাকে ইজারাদার ও চালক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা না করার কারণে তিনি ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকে এভাবে নিবন্ধন ছাড়াই চলছে এসব স্পিডবোট।

বিআইডাব্লিউটিএ (শিমুলিয়া ঘাট) সহকারী পরিচালক শাহাদাত হোসেন বলেন, বিআইডাব্লিউটিএ থেকেও বলা হয় স্পিডবোট নিবন্ধন করার ব্যাপারে। স্পিডবোট চালকদের অভিযোগ নিবন্ধনের জন্য কর্মকর্তারা আসেন না। এখন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য নিবন্ধনের ব্যাপারে ডিজি শিপিং এলেও তারা সহযোগিতা পান না। শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাট নিয়ন্ত্রণ করে নৌপুলিশ সদস্যরা। বৈরী আবহাওয়ার সময় লঞ্চের সঙ্গে স্পিডবোট বন্ধও করা হয়। এখন যদি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণলায় থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাহলে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।

মেদেনীমন্ডল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার আশরাফ হোসেন বলেন, শিমুলিয়া ঘাটে ২২০টি ও কাঁঠালবাড়ী ঘাটে ২শ স্পিডবোট রয়েছে। স্পিডবোট নিবন্ধনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলেছি।

সচিবালয় গিয়ে নিবন্ধন করাতে অনীহা চালকদের -এমন দাবি করে তিনি বলেন, ৪০-৫০টি স্পিডবোটের নিবন্ধন রয়েছে। আর চালকের ক্ষেত্রে ‘দক্ষতা’ বুঝে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর ট্রেনিং শেষে এরপর স্পিডবোট চালায়। দক্ষ একজন চালকের সঙ্গে হেলপার থেকে তারপর চালক হয়। মাঝে মধ্যে স্পিডবোটের ইঞ্জিনের পেট্রোলে ভেজাল থাকে, চালুর সময় বন্ধ হয়ে যায়। স্পিডবোট দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক আরেকটি স্পিডবোট গিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার করে।

এদিকে, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার সুযোগে ট্রলারে করে পদ্মাপাড়ি দিচ্ছে মোটরসাইকেলসহ আরোহী। এ নৌরুটে ফেরি চালু থাকাকালীন নির্ধারিত ভাড়া ছিল মাত্র ৭০ টাকা। কিন্তু ফেরি বন্ধের অজুহাতে ট্রলার চালকরা জনপ্রতি ৬০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে চালক সিন্ডিকেট।

সরেজমিনে যাত্রীদের অভিযোগ বুধবার (১৬ সেপ্টম্বর) সকাল থেকেই শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে মোটরসাইকেল বহন করে চলাচল করা ট্রলারগুলোর চালকরা এমন জিম্মি করে বেশি টাকা ভাড়া আদায় করছে।

বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক মোহাম্মদ সৈকত জানান, সকালে ঘাটে এসে দেখি ফেরি চলাচল বন্ধ। শিমুলিয়া ঘাট থেকে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার জন্য এখন একমাত্র উপায় স্পিডবোট ও ট্রলার। সেজন্য যাত্রীরা বাধ্য হয়েই বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে পারাপার হচ্ছে। তবে ট্রলার ও স্পিডবোট ছাড়া আর কোনো মাধ্যম না থাকার সুযোগ নিয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে চালকরা। একেকটি ট্রলারে প্রায় ১৫টি মোটরসাইকেল বহন করা হচ্ছে। এছাড়া ফেরি অনির্দিষ্টকাল বন্ধ এক শ্রেণির অসাধু সিন্ডিকেট এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লুফে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

তিনি আরও জানান, কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে আসছে অসহায় কর্মজীবী মানুষজন। আসার পথে অনেক ঝুঁকি নিতে হয় তাদের। ট্রলারের ভেতর পানি ঢুকে পড়েছিল। কয়েকজন মোটরসাইকেল ট্রলারে ওঠাতে গিয়ে আহতও হয়েছেন।

এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হুমায়ুন কবির জানান, নৌ-পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ঘাট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা হবে।

মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, যাত্রীদের নির্বিঘ্নে চলাচলে ঘাট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করা হবে। সিন্ডিকেটের হাত ভেঙে দেওয়া হবে। যাত্রী দুর্ভোগ সহ্য করা হবে না। যদি সেরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে জেলা প্রশাসন কঠোর হস্তে আইনগত পদক্ষেপ নেবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর