এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই হবে। আগামী মার্চ থেকে ধাপে ধাপে এ নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে ইসি। জানুয়ারির শেষদিকে বা ফেব্র“য়ারির মাঝামাঝি প্রথম ধাপের তফসিল ঘোষণা করতে পারে ইসি। এরই মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদের তালিকা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন উপযোগী ইউনিয়ন পরিষদগুলো যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলছে। পৌরসভার পর ইউনিয়ন পরিষদেও একইভাবে নির্বাচন হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ পাবে। একই সঙ্গে নিজস্ব প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তীব্র হবে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন হওয়ায় চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে এবং মেম্বার পদে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামবে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের শেষ ধাপ ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় প্রতীকের নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসের প্রথম ঘটনা। এছাড়া জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত সব ধাপেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ধারা শুরু হবে। এতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সরাসরি দলীয় রাজনীতির চর্চা হবে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মেয়াদ শেষ হবে। ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে একযোগে এসএসসি, দাখিল ও ভোকেশনাল পরীক্ষা চলবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং পরীক্ষার মাসে নির্বাচন করলে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হয়। তাই ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করা সমস্যা। সেক্ষেত্রে মার্চ মাস বেছে নেয়া হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলাপ করে সুবিধাজনক সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৌরসভা নির্বাচনের চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আরও শান্তিপূর্ণ হবে। পৌর নির্বাচনে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি প্রমাণ করেছে ইউনিয়ন পরিষদে কেউ গোলমাল করার সুযোগ পাবে না।
এদিকে পৌর নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে গ্রামগঞ্জে এক ধরনের নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ের সামাজিক, রাজনৈতিকসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে জনসংযোগ, দলীয় ও স্থানীয় সভা-সমাবেশ এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে প্রার্থিতার আগাম বার্তা দিচ্ছেন ভোটারদের। বিজয় দিবস, ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে পোস্টার, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর নামে প্রচারণা শুরু করেছেন অনেকেই। পাশাপাশি দলীয় সমর্থন পেতে আগেভাগেই স্থানীয় সংসদ সদস্য ও দলের সিনিয়র নেতাদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৯ মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ধাপে ধাপে চার হাজারের বেশি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হয়েছিল। ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম সভা থেকে মেয়াদ রয়েছে পাঁচ বছর। তবে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ২৯(৩) ধারা অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তারিখ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। এ হিসাবে ২৯ মার্চের আগের ১৮০ দিন অর্থাৎ গত ২ অক্টোবর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারা আরও জানান, পৌরসভা নির্বাচন শেষ হওয়ায় ইসির নজর এখন ইউনিয়ন পরিষদের দিকে। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে আটবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এবার নবম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ৪৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৭ জন নতুন ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। কমিশন এদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে খসড়া ভোটার তালিকা তৈরি করেছে। এদের অধিকাংশই গ্রামের ভোটার। কমিশন খসড়া তালিকাটি প্রকাশ করেছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও পরবর্তী সময়ে উপজেলা পরিষদ, ঢাকার দুই ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এতে সব নির্বাচনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। তিনটি নির্বাচনে কমবেশি সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। তবে দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কিনা সে বিষয়ে দলটি এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচনে সব দল অংশ নিলে তা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো জনপ্রিয়তা যাচাইয়েরও সুযোগ পায়।
এদিকে ইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কমিশন এরই মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনাও দিয়েছে। পৌরসভা নির্বাচনের পরপরই কর্মকর্তারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠছেন। চেয়ারম্যান পদে দলীয়ভাবে নির্বাচনের বিধান রেখে আইন সংশোধন হওয়ায় সে আলোকে নির্বাচনবিধি ও আচরণবিধি সংশোধনের কাজ চলছে। এতে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের কার্যক্রম, দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়ার বিধান, প্রচার-প্রচারণা, প্রতীক বরাদ্দ, প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ, নির্বাচনী ব্যয় ও উৎসের বিবরণীর ক্ষেত্রে নতুন বিধান যুক্ত হতে যাচ্ছে। পৌরসভা নির্বাচনের বিধির আলোকেই ইউনিয়ন পরিষদের বিধি তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকারভুক্ত প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে একই বিধান রাখার পক্ষে কমিশন কর্মকর্তারা।