একাশি গম্বুজ কেন ষাটগম্বুজ

সকাল থেকেই টানা বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে ঝড়ো হাওয়া। খবর পেলাম মংলা বন্দরসহ সমগ্র উপকূল এলাকায় তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এর মাঝেই আমরা খুলনা থেকে বাগেরহাটের দিকে যাচ্ছি হযরত খান জাহান আলীর (র.) মাজার ও ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখবো বলে। বাগেরহাট নিয়ে কবি আবু জাফর সিদ্দিক বলেছেন-
‘সুন্দরবনে বাঘের বাস
দড়াটানা ভৈরব পাশ
সবুজে শ্যামলে ভরা,
নদীর বাঁকে বসতো যে হাট
তার নাম বাগেরহাট।’

সড়কের দু’পাশে সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততই কবির চরণগুলো মনে পড়ছিলো। এত সবুজ! মনে হচ্ছিল ঝুপ করে যেন সবুজের রাজ্যে এসে পড়েছি। আশে-পাশের গ্রামের কিছু ঘরবাড়ি, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি পাড়া, চিংড়ীর ঘের আর দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ পেরিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম হযরত খান জাহান আলীর (র.) মাজার চত্বরে। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে গিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা রোদ্দুরে মাজার চত্বরের দিঘির পানিকে মনে হচ্ছিল যেন তরল সোনা। প্রচুর দর্শনার্থীর কেউ মাজার জেয়ারতে ব্যস্ত, কেউবা আবার মাজার সংলগ্ন বিশাল দিঘির পানিতে ওজু বা গোসল সেড়ে নিচ্ছিলেন।

khan-jahan

মাজারের পবিত্রতা রক্ষার্থে বাইরে জুতো রেখে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। আমরাও তাই করলাম। ইতিহাস অনুযায়ী পীর হযরত খান জাহান আলী (র.) ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আজর খান বা ফরিদ খান মতান্তরে আকবর খাঁ। মায়ের নাম আমিনা বিবি বা আম্বিয়া বিবি। ধারণা করা হয় তাদের পূর্ব পুরুষেরা বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন এবং হযরত বড়পীরের (র.) বংশধর ছিলেন। হযরত খান জাহান আলীর মূল নাম ছিলো শের খান, কিশোয়ার খান বা কেশর খান। হালাকু খান বাগদাদ আগমন করলে আজর খান পরিবার নিয়ে দিল্লি চলে আসেন, পরবর্তীতে গৌড়ে স্থায়ী হন এবং রাজপরিবারে গৃহশিক্ষকের চাকরি লাভ করেন। পিতার মৃত্যুর পর কেশর খান সাধারণ সৈনিক হিসেব কর্মজীবন শুরু করেন। নিজ মেধা, যোগ্যতা আর প্রজ্ঞাবলে অল্পদিনেই তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে ৬০ হাজার প্রশিক্ষিত অগ্রবর্তী সেনাদলসহ আরো দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমন করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন। ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে খান জাহান আলী যশোরের বার বাজার নামক স্থানে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন। তিনি সততা, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে দীর্ঘদিন যশোরে তার শাসন ব্যবস্থা কায়েম রেখেছিলেন। ইসলামের সমস্ত বৈরী শক্তির মোকাবেলায় দুর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন। জনকল্যাণে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। এলাকার মানুষের সুপেয় পানির জন্য বহু দীঘি খনন করে গেছেন যা এখনো কালের সাক্ষী বহন করে চলেছে।

khan-jahan

মাজার শরীফের শিলালিপি অনুযায়ী হযরত খান জাহান আলী (র.) ৮৬৩ হিজরির ২৬/২৭ জিলহজ (১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর) মাসে ষাটগম্বুজ মসজিদের দরবার কক্ষে এশার নামাজরত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। বর্গাকারে নির্মিত এই সমাধি সৌধের প্রত্যেক বাহু ৪৬ ফুট লম্বা এবং প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট। ৪ কোণায় ৪টি গোলাকার মিনার আছে। সমাধি সৌধের ভিতর একটি প্রস্থর নির্মিত বেদিতে হযরত খান জাহান আলীর (র.) মাজার অবস্থিত। শিলালিপিতে মৃত্যু তারিখ, দাফন তারিখ ছাড়াও আল্লাহর নাম, কোরআন শরীফের কয়েকটি সুরা এবং তার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক ইত্যাদি লিপিবদ্ধ আছে। স্থানীয় একজন মুরুব্বি জানালেন প্রতিবছর ২৫ অগ্রহায়ণে এ মহান সাধকের মাজার প্রাঙ্গনে বার্ষিক ওরশ মোবারক এবং চৈত্র মাসের প্রথম পূর্ণিমায় বার্ষিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

মাজারের সামনের খাঞ্জেলী নামের দিঘিতে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশে বিলুপ্তপ্রায় মিঠাপানির কুমিরের বসবাস। মানুষের ভক্তি-ভালোবাসা নিয়ে প্রায় ছয়শ’ বছর ধরে বংশপরম্পরায় তারা এখানেই বসবাস করছে। স্থানীয়দের কাছে পুরুষ কুমিরগুলো ‘কালাপাহাড়’ আর স্ত্রী কুমিরগুলো ‘ধলাপাহাড়’ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, হযরত খান জাহান ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর আগে কোন একসময়ে এই দিঘিতে মিঠাপানির এক জোড়া কুমির পুষেছিলেন। তাদের নাম ছিলো কালাপাহাড় আর ধলাপাহাড়। সেই থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের কাছে তারা এই নামেই সমাদৃত হয়ে আসছে।

khan-jahan

ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র বাংলা ১৩২১ সালে তার যশোর খুলনার ইতিহাস বইয়ের প্রথম খণ্ডে খাঞ্জেলী দিঘির এই কুমির প্রসঙ্গে বলেছেন-‘…তাহারা মানুষকে আক্রমন করে না, তবে তাহাদের নিকট খাদ্যের দাবি করিবার জন্য স্নানের সময় নিকটবর্তী স্থানে ভাসিয়া থাকে।’ সতীশচন্দ্র মিত্রের দেখা সেই দৃশ্য ততদিন পর্যন্ত ছিলো যতদিন পর্যন্ত কালাপাহাড় আর ধলাপাহাড় জীবিত ছিলো। এরা কখনো মানুষকে আক্রমন করত না। দিঘির উত্তর পাড়ে খাদেমদের বাড়ির আঙিনায় গিয়ে ডিম পাড়তো। দর্শনার্থীরা পরম শ্রদ্ধাভরে তাদের গায়ে- মাথায় হাত বুলিয়ে পূণ্য অর্জনের চেষ্টা করত। মানুষের সাহচর্য আর ঔৎসুক্যে কালাপাহাড়দের বিলুপ্তির প্রবণতাকে ঠেকাতে না পারলেও প্রলম্বিত করতে পেরেছে। খাদেমদের কাছ থেকেই জানা গেল, ১৯৭৫-৮০ সাল পর্যন্তও এই দিঘিতে ১৫-২০টি কুমির ছিলো। আশির দশকের পর থেকে এই সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। পরবর্তীতে মাদ্রাজ থেকে আরো কিছু কুমির এনে দীঘিতে ছাড়া হয়।

khan-jahan

মাজার দর্শন শেষে ষাটগম্বুজ মসজিদের উদ্দেশে পা বাড়ালাম। কলেজের পাঠ্যবইয়ে পড়া এই মসজিদ সম্পর্কে আগ্রহ বহুদিনের। প্রায় ৫৫০ বছর পূর্বে নির্মিত এই মসজিদ এখনো তার ঐতিহ্য, শক্তি আর সৌন্দর্য নিয়ে কালের গর্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদ এলাকায় ঢুকতেই হাতের ডানপাশে পড়লো বাগেরহাট যাদুঘর। মুসলিম স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন এই মসজিদ বাংলাদেশের যত পুরাকীর্তি আছে তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো এই মসজিদকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। খান জাহান আলীর মাজার থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত মসজিদটির গায়ে কোন শিলালিপি না থাকাতে এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিলো সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এর স্থাপত্যশৈলী দেখে ধারণা করা হয় যে, হযরত খান জাহান আলী (র.) ১৫শ’ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন। মূলত বৈঠক করার জন্য দরবার হল হিসেবে এটি ব্যবহৃত হত, যা পরবর্তীতে ষাটগম্বুজ মসজিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, এই মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর চট্টগ্রাম থেকে আবার কারো মতে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে খান জাহান আলীর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে আনা হয়েছিলো। এ বিশাল মসজিদের চারদিকের প্রাচীর ৮ ফুট চওড়া। বাইরের মাপ দৈর্ঘে্যর ১০৫ ফুট এবং প্রস্থে ৯৫ ফুট এবং গম্বুজের উচ্চতা ২১ ফুট। মসজিদের সামনের দিকে একটি বড় খিলান এবং দু’পাশে পাঁচটি করে খিলান রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমে ৭টি করে মোট ১১ সারিতে মোট ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি গম্বুজের উপরের দিকের আকৃতি গোলাকার এবং মধ্যকারের সারিতে চৌকোণাবিশিষ্ট ৭টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের ভিতরে পূর্ব-পশ্চিমে ৬টি করে ১০টি সারিতে মোট ৬০টি ̄স্তম্ভ রয়েছে এবং প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, শুধু ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মসজিদে দরজা আছে ২৫টি, এর মধ্যে একটি দরজা দেখতে পেলাম পশ্চিম দিকে যা মসজিদের জন্য একটি বিরল ঘটনা। সম্ভবত দরজা বন্ধ করার কপাটের কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলেই এমনটি মনে হয়েছে।

মসজিদের চারকোণে চারটি মিনার রয়েছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং এরা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা এবং পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মেহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ সেগুলো দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মত, বাকি ৭০টি গম্বুজ আধা গোলাকার। সামনের মিনার দুটোর ভিতর দিয়ে ওপরে যাওয়ার জন্য ঘোরানো সিঁড়িপথ রয়েছে। এ দুটি মিনারের ভিতর খিলানের সাহায্যে নির্মিত একটি করে ছোট কক্ষ রয়েছে। কক্ষ দুটির নাম ‘আন্ধারমানিক’ ও ‘শলক মালিক’। মিনার দুটি আজান দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হত বলে মনে করা হয়। আবার কারো মতে, এসব মিনারে খান জাহান আলীর সৈন্যরা পাহারা দিতো এবং শত্রুর চলাচলের ওপর নজর রাখত।

khan-jahan

মসজিদটিতে ৭৭টি গম্বুজ থাকা সত্ত্বেও এর নাম ষাটগম্বুজ হলো কেন তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে অনেকের মনেই। কেউ মনে করেন, ৬০টি স্তম্ভ আছে বলে এর নাম ষাটগম্বুজ। আবার কারো মতে, ৭টি সারিতে গম্বুজগুলো হওয়ায় এর নাম ষাটগম্বুজ মসজিদ। আবার অনেকের ধারণা, ৭৭টি গম্বুজ আছে বলে সাতাত্তর কথার স্থানীয় বিকৃতিতে ষাটগম্বুজ হয়েছে। তবে এই নামের প্রকৃত রহস্য এখনো অজানাই রয়ে গেছে।

ষাটগম্বুজ মসজিদের পশ্চিম পাশেই বড় একটি দীঘি চোখে পড়লো। কানায় কানায় পূর্ণ সেই দীঘিতে অসংখ্য লাল শাপলা ফুটে রয়েছে। উপস্থিত বিশিষ্ট একজন ব্যক্তি জানালেন, দীঘিটির নাম ‘ঘোড়া দীঘি’ এবং সম্ভবত এটিই খান জাহান আলী খননকৃত এ অঞ্চলের প্রথম দীঘি। কারো কারো মতে, খান জাহান (র.) তার প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য এ এলাকা উঁচু করা এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এ দীঘিটি খনন করেন। দূরে দেখতে পেলাম দীঘির পাড় ঘেঁষে মেলা বসেছে। এ দীঘিতে নাকি বারো মাসই পানি থাকে এবং এর গভীরতা কোথাও কোথাও প্রায় ২৪/২৫ ফুট। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, একটি ঘোড়া দৌড়ে যত দূর গিয়েছিলো, ঠিক ততটা খনন করা হয় এ দীঘি। কেউবা মনে করেন, দীঘি খননের পর হযরত খানজাহান (র.) ঘোড়ায় চড়ে দীঘির চারপাশে ভ্রমণ করতেন তা থেকে ‘ঘোড়া দীঘি’ নামকরণ হতে পারে। আবার কেউ মনে করেন, দীঘিটি খননের পূর্বে এ স্থানে তার সেনাদের কুচকাওয়াজ ও ঘোড়দৌড় হতো। আর এই ঘোড় দৌড় থেকেই ‘ঘোড়া দীঘি’ নামকরণ করা হয়েছে। অনেকের কাছে এটি শুধুই ‘ষাটগম্বুজের দীঘি’ হিসেবে পরিচিত।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর