শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম। তাই শিক্ষা লাভের অধিকার সবার। রাষ্ট্রব্যবস্থা তার নাগরিকদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে নানা রকম উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। সেই আদিকাল থেকে রাষ্ট্র তার চাহিদামত শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার নীতি থেকে কখনো সরে আসেনি। যোগোপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষে রাষ্ট্রের সবচেয়ে শিক্ষিত ও উপযুক্ত ব্যক্তি-বর্গের সমন্বয়ে শিক্ষা-কমিটি করা হয়। এই কমিটি তাদের গবেষণার আলোকে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। একটি জাতির শিক্ষার মানদন্ড কেমন হবে তার নির্ণায়ক তার শিক্ষানীতি। আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা-পদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যারা নিয়োজিত থাকেন, গবেষণাপত্র লেখেন এবং অনেক খাটা-খাটুনির পর শেষ পর্যন্ত জাতির ঘাড়ে যা চাপিয়ে দেন, তার সবই সম্পন্ন হয় প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায় বসে। বিশাল বাজেট ব্যায়ে প্রণীত শিক্ষানীতির পেছনে যারা শ্রম দেন তারা দেশের সবচেয়ে জ্ঞানীগুণী মানুষ। জ্ঞান-গরিমায় তারা নিঃসন্দেহে হিমালয়সম। তাদের যোগ্যতা নিয়ে দৃষ্টতা দেখানোর সাহস করছিনা। কিন্তু, আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রচলিত শিক্ষার কিছু বিষয় নিয়ে কথা না বললেই নয়। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ গ্রামের মানুষ। গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুযোগ-সুবিধা, জীবন-আচার ও মেধা মস্তিষ্কের খবর যেসব শিক্ষাবিদদের পক্ষে রাখা সম্ভব হয়ে উঠেনা তাদের গবেষণায় এসব সুবিধা-বঞ্চিত ও পিছিয়েপড়া শিশুদের কথা থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষানীতি যেহেতু একটি জাতির সমগ্র জনগোষ্ঠির জন্য প্রণীত হয়, তাই বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সর্বশেষ শিক্ষানীতির আলোকে বর্তমানে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু রয়েছে। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে এ পদ্ধতিটিকে সুধিমহলে পরিচিত করার সরকারী উদ্দ্যোগ নিঃসন্দেহে সফল বলা চলে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ, অভিভাবক ও সমাজের সচেতন মহলেও সৃজনশীল শিক্ষার ব্যাপারে একটা কৌতুহল কাজ করে। কিন্তু, সৃজনশীলতার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসলে কী পঠন-পাঠন হচ্ছে সেদিকে সরকারী কর্মতৎপরতা কিংবা নজরদারী সফল বলা যাবেনা! সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি নতুন হওয়ায় এ পদ্ধতিতে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এমনকি উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনেকেই বেশ জটিল ও বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেক শিক্ষক যেহেতু সৃজনশীল শিক্ষার মূল বিষয়টিই বুঝে উঠতে পারেননি তাই বাজারি নোট-গাইড থেকে কপি করে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়ায় সৃজনশীল করার প্রয়াস নিচ্ছেন! যদিও শিক্ষামন্ত্রণালয় নোট-গাইডের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষনা করেছেন। সৃজনশীল শিক্ষার প্রসঙ্গ আসলেই সংশ্লিষ্ট মহল তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন। শিক্ষার্থীরা আসলেই কতটুকু সৃজনশীল হচ্ছে সেদিকে তাকানোর যেন খেয়াল নেই। বাস্তবতা হল, শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের অবস্থা সেই আগের মত মুখস্থ নির্ভর। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সাজেশন কিংবা পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা গৎবাঁধা কতগুলো প্রশ্নের উত্তর নোট-গাইড কপি (মুখস্থ) করে তারপর তা পরীক্ষার উত্তরপত্রে পেষ্ট করে দেয়! অথচ সৃজনশীল শিক্ষা এসব ‘প্যারোটিং-লার্নিং’ অনুমোদন করেনা। তাছাড়া, আমাদের পাবলিক পরীক্ষায় কিছু বিষয়ে এমনভাবে প্রশ্ন তৈরি করা হয়, যা সরাসরি সৃজনশীলতার পরিপন্থী। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত এত এত বিদগ্ধজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে তা কিভাবে চলছে এটাই এক প্রশ্ন! পাবলিক পরীক্ষার মত গুরুত্বপুর্ণ একটি মাধ্যমে যখন সৃজনশীল শিক্ষা উপেক্ষিত হয় তখন এর ভবিষ্যত নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ অবশ্যই থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, সরকারী উদ্দ্যোগে সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণের ধরণ-ধারন কিংবা এর আউটপুট কী তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কখনো যাচাই করে দেখেননি। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীণ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে আসলে যা হয়, তা বিরাট এক কাহিনী। অন্য এক লেখায় তা আলোচনা করা যাবে। এবার অন্য বিষয়ে আসা যাক। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজীর শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান দুনিয়ায় ইংরেজী শিক্ষায় পিছিয়ে থেকে সামনে আগানোর কোন সুযোগ নেই। সময় ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই ইংরেজী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হয়। সস্তা আবেগ দিয়ে কোন কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা কখনোই মঙ্গলজনক হয়না। শিক্ষারমত একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়েও আমরা যুক্তি নির্ভর হতে পারিনি! তা নাহলে ইংরেজীর মত একটি বিদেশী ভাষা কিভাবে শিখানো হবে তা নিয়েও কেন আমরা মনঃস্থির করতে পারিনি? একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে শিক্ষার্থীদের ওল্ড (গ্রামার ট্রান্সলেশন) মেথডে ইংরেজী শেখানো হত। তারপর তা বাতিল করে চালু হল, ‘কমিউনিকেটিভ’ মেথড। প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত বর্তমানে আংশিক গ্রামার সম্বলিত কমিউনিকেটিভ মেথড চালু রয়েছে। ছাত্ররা ইংরেজী কী শিখছে কিংবা কতটুকু শিখছে তারচে’ গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছে প্রচলিত পদ্ধতিতে ছাত্ররা ইংরেজী বিষয়ে পরীক্ষায় ঈপ্সিত নাম্বার পাচ্ছে। আমাদের কর্তা-ব্যক্তিদের এটাই যদি হয় মনোবাসনা তাহলে ‘অভিযোগ’ কিংবা হায়-হুতাশ করার কিছুই থাকেনা। কিন্তু, বিদেশি একটি ভাষাকে ভালভাবে রপ্ত করতে হলে, ঐ ভাষার সাহিত্য জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সত্যিকার শিক্ষার স্বার্থেই তা স্বীকার করতে হবে। শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাসের জন্য ইংরেজী শেখার বর্তমান কৌশল ব্যবহারিক জীবনে সচল না অচল হবে, তাতে অবশ্য সন্দেহ থেকেই যায়। সাহিত্যের গুরুত্বকে অস্বীকার করে বর্তমানে প্রচলিত কমিউনিকেটিভ পদ্ধতি ইংরেজী শিক্ষায় কতটা সফলতা পাবে তা সময়েই বলে দিবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত এমন অনেকেই ‘কমিউনিকেটিভ’ শব্দটির সাথে এখন পর্যন্ত ভাল যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেনি! সম্ভবত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ না দিতে পারার কারণেই এমন বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা শিক্ষার জন্য গ্রামারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইংরেজীর মত একটি বিদেশী ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রচলিত সিস্টেমে গ্রামারকে যথেষ্ট গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে! ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রে গ্রামার পার্টে প্রশ্নের বর্তমান ধরণ ও তার মনবণ্টন পদ্ধতি শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় পাসের একটা সুযোগ করে দিয়েছে সত্য কিন্তু এধরণের গ্রামার শিখে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থে ইংরেজী কতটুকু শিখতে পারবে সেটাই আসল প্রশ্ন। ইংরেজী বিষয়ে ন্যুনতম বোধগম্যতা ছাড়াই শুধু পরীক্ষা পদ্ধতির কারনে শিক্ষার্থীরা এখন সহজেই ইংরেজিতে ঈপ্সিত নম্বর পেতে পারে! এমনকি অনেকে ইংরেজী বিষয়ে A+ পর্যন্ত পেয়ে যায়। পাওয়াটা দোষের নয় বরং আনন্দের। কিন্তু উপযুক্ত যোগ্যতা ব্যতীত শুধু একটা পদ্ধতিকে অবলম্বন করে এ অর্জন আসলে কতটা ‘অর্জন’ আর কতটা ‘বিসর্জন’ তার হিসাব করার সময় এসেছে। শুধু রেকর্ড ভাঙ্গা পাসের হার একটি রাজনৈতিক সরকারের ‘সাফল্য’কে প্রতিষ্ঠিত করলেও সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট সচেতন মহলের গভীর উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত তিন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কথিত ‘মেধাবী’দের ৮০ ভাগই পাস নম্বর পাননি! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজীতে ৩০ নম্বরের মধ্যে ন্যূনতম ৮ নম্বর পায়নি এমন পরীক্ষার্থীর হার যথাক্রমে ৫৫% ও ৫৬%! তাছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত শিক্ষাবর্ষে ইংরেজী বিষয়ে অনার্স পড়ার সুযোগ পেয়েছে মাত্র দুইজন! এটা স্বীকৃত সত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যারা অংশ গ্রহন করে থাকেন, তারা সাধারণত সময়ের সেরা ছাত্র। যারা বাংলা ও ইংরেজীতে ৩০ নম্বরের মধ্যে ন্যূনতম ৮ পায়নি তারাও কিন্তু চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের সেরা মেধাবী ছাত্র। খোঁজ নেলে দেখা যাবে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করা এসব শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পেয়েছে। ইংরেজী ও বাংলা বিষয়েও তাদের ‘কৃতিত্ব’ A+ ! এখন সময় এসেছে হিসাব করে দেখার; কমিউনিকেটিভ এবং সৃজনশীল পদ্ধতি আসলেই কতটা ফলপ্রসু হচ্ছে। না কি আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে! শিক্ষারমত অতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে রাজনীতির চমক হিসাবে না দেখে জাতির মেরুদন্ড হিসাবেই ভাবা উচিৎ। মূলত শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে যে আশঙ্কাজনক অধঃপতন হয়েছে, তার জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাটাই দায়ী। স্কুল-কলেজে ভাষা বিষয়ে যথাযথ শিক্ষা না দেওয়া, বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারা , গভীর পাঠদান ও পাঠাভ্যাসের অনুপস্থিতি, পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয়ে পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া, ‘শর্টকাট’ উপায়ে সফল হওয়ার প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীলতা, বাড়িয়ে বাড়িয়ে নম্বর দিয়ে কৃত্রিমভাবে মেধার বিস্ফোরণ ঘটানোর নীতি-এসব কিছুর সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে শিক্ষার মানে ধস। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই সতর্ক না হলে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক ফল গ্রাস করবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের টনক কবে নড়বে সেটাই দেখার বিষয়। লেখক: হাসিম উদ্দিন আহমেদ (সহকারী প্রধান শিক্ষক, সাখুয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ)।
সংবাদ শিরোনাম
লেখাপড়া নিয়ে কিছু কথা
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১১:০৬:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫
- ৪০৬ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ