ঢাকা ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৪৫ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৬:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫
  • ২৬৯ বার

১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল। মাঝখানে অতিবাহিত হয়েছে ৪৫টি বছর। দীর্ঘ এ সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নানাভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে। সরকার এসেছে, সরকার বিদায় নিয়েছে। কিন্তু, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান-বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি আজও।

বর্তমান সরকার ‍মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও হাইকোর্টের আদেশে তা স্থগিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চূড়ান্ত তালিকা কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে তার অনিশ্চয়তা কাটছেই না।

এ বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা করার জন্য সবকিছুই প্রস্তুত আছে। আদালতের আদেশে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। আদালতের আদেশ প্রত্যাহার হয়ে গেলে দুই মাসের মধ্যেই তা করে ফেলতে পারব।’

‘হাইকোর্ট সরকারের প্রতি যে রুল জারি করেছিল এর জবাব আমরা দিয়েছি’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রিট নিষ্পত্তির জন্য শুনানি হচ্ছে না। শুনানি শেষ হলেই আশা করছি, দ্রুত সময়েরে মধ্যে তালিকা মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত সঠিক তালিকা করতে পারব।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারিভাবে এ পর্যন্ত পাঁচটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ তালিকায় অনেক অ-মুক্তিযোদ্ধার নামও রয়েছে। ইতোমধ্যে তিন হাজারেরও বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অতীতের সরকারগুলো নিজেদের সুবিধার্থে বা ইচ্ছামতো মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এক্ষেত্রে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম যেমন বাদ পড়েছে, তেমনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তালিকায়।

মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অ-নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ জন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত সেক্টরসমূহ বিলুপ্তির পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তরিত দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। এক্ষেত্রে আগের তালিকার বাকি মুক্তিযোদ্ধার হদিস পাওয়া যায়নি। এটিই পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেটি ‘ভারতীয় তালিকা’ নামে পরিচিত।

১৯৭৮ সালের পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির কাজে হাত দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদকে এ দায়িত্ব দেন তিনি। ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে এ তালিকা গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।

১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার।

১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের শাসনামলে মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় ১ লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ডিজির নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তৈরি করা তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই এখন ‘লাল বই’ নামে পরিচিত। এতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে।

২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সে সময়ে আগের নীতি বাদ দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে বাদ রেখে ইউএনও ও ডিসিদের নিয়ে উপজেলা ও জেলায় যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। আগের যে কোনো দুটি তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদেরই সুপারিশ করে কমিটি। এ সুপারিশের আলোকেই ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট, যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার জনে। অর্থাৎ বিএনপি জোট সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪ হাজার বেড়ে যায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ৪৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ভুয়া বলে অভিযোগ তোলা হয়। অবশ্য মহাজোট সরকারও ক্ষমতায় এসে বিএনপির নীতিমালা মেনে ১১ হাজার ৫০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। ফলে বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার ৫০০ জনে দাঁড়িয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নে আওয়ামী লীগ সরকার ষষ্ঠবারের মতো উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে চলতি বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগেই একাত্তরের বীর সেনানীনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের ঘোষণা আসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনলাইন ও সরাসরি আবেদন আহ্বান করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সারাদেশ থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৭০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে অনলাইনে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৭০টি এবং বাকি ১০ হাজার আবেদন হার্ডকপি (কাগুজে আবেদন) জমা পড়ে।

এ ব্যাপারে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক (ডিজি) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বা গেজেট প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। জামুকা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ করে থাকে। আমাদের কাজ অনেক দূর এগিয়ে রেখেছি। প্রত্যেক উপজেলায় আবেদনগুলো পৌঁছে গেছে। এখন হাইকোর্টে যে রিট করা হয়েছে, তার সমাধান হলেই উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। এটি গঠন হলেই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শুরু হবে।’

প্রাপ্ত এসব নতুন আবেদন ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাওয়া নানা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সারাদেশে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৭টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়।

জামুকার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রস্তাবিত এ কমিটির প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য। তাকে অবশ্যই বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলে সে ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ইতোপূর্বের যে কোনো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য সভাপতি হবেন। তা না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন কমান্ডার কমিটির সভাপতি হবেন। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে সেখান থেকে সরে আসে জামুকা। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা না হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি কমিটির প্রধান হবেন। কমিটির অন্য সদস্য হবেন- মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা ইউনিটের উপজেলা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জামুকার সদস্য কর্তৃক মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি এবং সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।

গত বছর(২০১৪)২১ অক্টোবর জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে তার অধীনস্থ উপজেলাগুলোর যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতির নাম চাওয়া হয়। কিন্তু ওই চিঠি দেওয়ার তিন মাস পার হলেও সভাপতিদের সবার নাম মন্ত্রণালয়ে না আসায় চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পুনরায় সভাপতির নাম চেয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়।

উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের আগেই চলতি বছরের ১৮ মার্চ ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম কেন অবৈধ হবে না’ -তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ রুলেই আটকে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের প্রক্রিয়া। যদিও এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের এ রুলের জবাব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর নির্ধারণ করা নিয়ে মাঝখানে এক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘১৩ বছরের নিচে যাদের বয়স তারা যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হন তবে তারা অবশ্যই তালিকাভুক্ত হবেন। তবে ১৩ বছরের কম বয়সীদের তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই হবে। এরপর যদি প্রমাণিত হয় যে তিনি ১৩ বছরের কম বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাহলেই তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে।’

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর তারা (মুক্তিযোদ্ধা) যখন আবার স্কুলে গেছেন, তখন ভর্তি ফরম পূরণের সময় স্যারেরা ইচ্ছেমতো বয়স বসিয়ে দিয়েছেন। আর তখন তো বাপ-মায়েরাও তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। স্যারেরা আনুমানিক বয়স বসিয়ে দিয়ে পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দিয়েছেন। এতেও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের হেরফের হয়েছে।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

৪৫ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা

আপডেট টাইম : ১২:১৬:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল। মাঝখানে অতিবাহিত হয়েছে ৪৫টি বছর। দীর্ঘ এ সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নানাভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে। সরকার এসেছে, সরকার বিদায় নিয়েছে। কিন্তু, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান-বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি আজও।

বর্তমান সরকার ‍মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও হাইকোর্টের আদেশে তা স্থগিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চূড়ান্ত তালিকা কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে তার অনিশ্চয়তা কাটছেই না।

এ বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা করার জন্য সবকিছুই প্রস্তুত আছে। আদালতের আদেশে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। আদালতের আদেশ প্রত্যাহার হয়ে গেলে দুই মাসের মধ্যেই তা করে ফেলতে পারব।’

‘হাইকোর্ট সরকারের প্রতি যে রুল জারি করেছিল এর জবাব আমরা দিয়েছি’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রিট নিষ্পত্তির জন্য শুনানি হচ্ছে না। শুনানি শেষ হলেই আশা করছি, দ্রুত সময়েরে মধ্যে তালিকা মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত সঠিক তালিকা করতে পারব।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারিভাবে এ পর্যন্ত পাঁচটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ তালিকায় অনেক অ-মুক্তিযোদ্ধার নামও রয়েছে। ইতোমধ্যে তিন হাজারেরও বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অতীতের সরকারগুলো নিজেদের সুবিধার্থে বা ইচ্ছামতো মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এক্ষেত্রে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম যেমন বাদ পড়েছে, তেমনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তালিকায়।

মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অ-নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ জন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত সেক্টরসমূহ বিলুপ্তির পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তরিত দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। এক্ষেত্রে আগের তালিকার বাকি মুক্তিযোদ্ধার হদিস পাওয়া যায়নি। এটিই পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেটি ‘ভারতীয় তালিকা’ নামে পরিচিত।

১৯৭৮ সালের পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির কাজে হাত দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদকে এ দায়িত্ব দেন তিনি। ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে এ তালিকা গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।

১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার।

১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের শাসনামলে মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় ১ লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ডিজির নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তৈরি করা তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই এখন ‘লাল বই’ নামে পরিচিত। এতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে।

২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সে সময়ে আগের নীতি বাদ দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে বাদ রেখে ইউএনও ও ডিসিদের নিয়ে উপজেলা ও জেলায় যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। আগের যে কোনো দুটি তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদেরই সুপারিশ করে কমিটি। এ সুপারিশের আলোকেই ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট, যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার জনে। অর্থাৎ বিএনপি জোট সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪ হাজার বেড়ে যায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ৪৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ভুয়া বলে অভিযোগ তোলা হয়। অবশ্য মহাজোট সরকারও ক্ষমতায় এসে বিএনপির নীতিমালা মেনে ১১ হাজার ৫০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। ফলে বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার ৫০০ জনে দাঁড়িয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নে আওয়ামী লীগ সরকার ষষ্ঠবারের মতো উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে চলতি বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগেই একাত্তরের বীর সেনানীনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের ঘোষণা আসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনলাইন ও সরাসরি আবেদন আহ্বান করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সারাদেশ থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৭০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে অনলাইনে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৭০টি এবং বাকি ১০ হাজার আবেদন হার্ডকপি (কাগুজে আবেদন) জমা পড়ে।

এ ব্যাপারে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক (ডিজি) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বা গেজেট প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। জামুকা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ করে থাকে। আমাদের কাজ অনেক দূর এগিয়ে রেখেছি। প্রত্যেক উপজেলায় আবেদনগুলো পৌঁছে গেছে। এখন হাইকোর্টে যে রিট করা হয়েছে, তার সমাধান হলেই উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। এটি গঠন হলেই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শুরু হবে।’

প্রাপ্ত এসব নতুন আবেদন ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাওয়া নানা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সারাদেশে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৭টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়।

জামুকার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রস্তাবিত এ কমিটির প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য। তাকে অবশ্যই বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলে সে ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ইতোপূর্বের যে কোনো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য সভাপতি হবেন। তা না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন কমান্ডার কমিটির সভাপতি হবেন। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে সেখান থেকে সরে আসে জামুকা। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা না হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি কমিটির প্রধান হবেন। কমিটির অন্য সদস্য হবেন- মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা ইউনিটের উপজেলা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জামুকার সদস্য কর্তৃক মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি এবং সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।

গত বছর(২০১৪)২১ অক্টোবর জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে তার অধীনস্থ উপজেলাগুলোর যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতির নাম চাওয়া হয়। কিন্তু ওই চিঠি দেওয়ার তিন মাস পার হলেও সভাপতিদের সবার নাম মন্ত্রণালয়ে না আসায় চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পুনরায় সভাপতির নাম চেয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়।

উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের আগেই চলতি বছরের ১৮ মার্চ ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম কেন অবৈধ হবে না’ -তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ রুলেই আটকে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের প্রক্রিয়া। যদিও এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের এ রুলের জবাব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর নির্ধারণ করা নিয়ে মাঝখানে এক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘১৩ বছরের নিচে যাদের বয়স তারা যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হন তবে তারা অবশ্যই তালিকাভুক্ত হবেন। তবে ১৩ বছরের কম বয়সীদের তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই হবে। এরপর যদি প্রমাণিত হয় যে তিনি ১৩ বছরের কম বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাহলেই তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে।’

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর তারা (মুক্তিযোদ্ধা) যখন আবার স্কুলে গেছেন, তখন ভর্তি ফরম পূরণের সময় স্যারেরা ইচ্ছেমতো বয়স বসিয়ে দিয়েছেন। আর তখন তো বাপ-মায়েরাও তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। স্যারেরা আনুমানিক বয়স বসিয়ে দিয়ে পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দিয়েছেন। এতেও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের হেরফের হয়েছে।’